অবরোধের ২৪ দিন : পেট্রলবোমায় দগ্ধ দেশের অর্থনীতি

স্টাফ রিপোর্টার: টানা ২৪ দিনের অবরোধ ও হরতালে দেশের অর্থনীতির ক্ষতি সাড়ে ৫৪ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। পাঁচটি খাতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে। পরিবহনে ৭ হাজার ২৪৮ কোটি, ক্ষুদ্র দোকানিদের ৭ হাজার ২শ’ কোটি, কৃষি খাতে ৬ হাজার ৯১২ কোটি, শিল্প খাতে ৫ হাজার ২৫৫ কোটি ও পোশাক খাতের ক্ষতি ৫ হাজার ১৬০ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। এ ক্ষতি চলতি অর্থবছরের জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে বড় বাধা হয়ে দাঁড়াবে। সংশ্লিষ্ট ডিসিসিআই, দোকান মালিক সমিতিসহ সংশ্লিষ্ট অ্যাসোসিয়েশন সূত্রে এ তথ্য পাওয়া গেছে পরিস্থিতি দ্রুত স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে সম্প্রতি আলাদাভাবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ২০ দলের নেত্রী খালেদা জিয়াকে চিঠি দিয়েছে বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতি, বিজিএমইএসহ ৪০টি বাণিজ্যিক সংগঠন এবং বাংলাদেশ পোলট্রি শিল্প সমন্বয় কমিটির নেতারা। পাশাপাশি অবরোধ ও হরতালের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিতে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই একটি পরামর্শক কমিটি গঠন করেছে। আর বাংলাদেশ রফতানিকারক সমিতি রাজনৈতিক দলের দুই নেত্রীকে সংলাপে বসার আহ্বান জানিয়েছে।

এ প্রসঙ্গে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা ড. এবিএম মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, সরকারে ৭ দশমিক ৩ শতাংশ জিডিপির প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা অর্জন অসম্ভব। হরতাল ও অবরোধের কারণে বেসরকারি খাতের বিনিয়োগে স্থবির হয়ে পড়েছে। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়ন কঠিন হবে। তিনি বলেন, প্রবৃদ্ধি অর্জনের প্রধান উৎস হচ্ছে বিনিয়োগ। কিন্তু বিনিয়োগ বাড়াতে না পারলে প্রবৃদ্ধির মাত্রা কম হবে।

৫ জানুয়ারি থেকে টানা অবরোধ চলছে। এর মধ্যে দেয়া হয়েছে হরতালও। ২৪ দিনের অবরোধ ও হরতালে সহিংসতায় এবং পেট্রলবোমায় মারা গেছেন ৩৮ জন, দগ্ধ হয়েছেন ২০৮ জন। ৭৫৯টি যানবাহন ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে। পাঁচ দফা নাশকতা চালানো হয়েছে রেলে। ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (ডিসিসিআই) হিসাব মতে, অবরোধ ও হরতালে প্রতিদিন বিভিন্ন খাতে দুই হাজার ২৭৭ কোটি টাকার আর্থিক ক্ষতি হচ্ছে।

সার্বিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে দেশের বিশিষ্টজনরা মনে করছেন পেট্রোলবোমায় দগ্ধ হচ্ছে অর্থনীতি। তাদের মতে, ক্ষতবিক্ষত হয়ে পড়ছে বিভিন্ন খাত। পরিবহন, কৃষি, পোশাক ও উৎপাদন শিল্পসহ অন্য খাতগুলোর ক্ষতি ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। ব্যাহত হচ্ছে শিল্পের উৎপাদন। অনিশ্চতয়তার মুখে পোশাক রফতানির অর্ডার বাতিল করছেন ক্রেতারা। সহিংস রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে জাতীয় অর্থনীতিতে প্রায় অচলাবস্থা বিরাজ করছে। ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্প-কারখানা সমগ্র অর্থনীতি বিপর্যয়ের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছেছে বলে তারা মনে করেন।

ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা বলেন, তারা দোকানপাট খুলতে না পেরে বাধ্য হয়ে প্রতিবাদের জন্য রাজপথে নামছেন। পরিবহন ব্যবস্থা ব্যাহত হওয়ায় বাধাগ্রস্ত হচ্ছে রফতানি পণ্য সরবরাহ। চলমান পরিস্থিতিতে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন কৃষকরা। পরিবহনের অভাবে সবজি ক্ষেতেই নষ্ট হচ্ছে। দাম পাবে না বিধায় ক্ষেত থেকে ফসল তুলছে না। অথচ দেশজ মোট উৎপাদন (জিডিপিতে) শাকসবজির অবদান হচ্ছে এক দশমিক ৯১ শতাংশ। কিন্তু বর্তমান এ ক্ষতির কারণে কৃষি প্রবৃদ্ধি অর্জন নিয়ে শঙ্কা রয়েছে। কৃষক ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের ভাষায় পরিস্থিতি এতটাই খারাপ এখন রক্তক্ষরণ শুরু হয়েছে।

এ প্রসঙ্গে কৃষি অর্থনীতিবিদ ব্র্যাকের নির্বাহী পরিচালক ড. মাহবুব হোসেন বলেন, কৃষক সবজি ক্ষেত থেকে তুলে পরিবহনের অভাবে বিক্রি করতে পারছে না। এতে কৃষকের লোকসান হচ্ছে। কৃষকের ফসল নষ্ট হলে প্রবৃদ্ধিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। এ খাতের পাশাপাশি পোলট্রি খাতেও বিপর্যয় নেমে এসেছে। কৃষক ও পোলট্রি খাতের উদ্যোক্তারা বলছেন, এ পরিস্থিতিতে গ্রামীণ অর্থনীতিতে অচিরেই ধস নেমে আসবে। এ ব্যাপারে বাংলাদেশ পোলট্রি শিল্প সমন্বয়ক মসিউর রহমান যুগান্তরকে বলেন, প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এ শিল্পের ক্ষতি ৮শ’ কোটি টাকার ওপরে চলে গেছে। তবে মানুষের খাদ্যের জোগান নিশ্চিত করতে হলে এখনই রাজনৈতিক স্থিতিশীল পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে হবে।

এদিকে পোশাক খাতের উৎপাদন বাদ দিয়ে রাস্তায় নেমে এসেছে পোশাক শিল্পসহ ৪০টি বাণিজ্যিক সংগঠন। কারণ এ পর্যন্ত পোশাক খাতে ১১৮ কোটি টাকার অর্ডার বাতিল হয়েছে। এ শিল্প বড় ধরনের সংকটের মুখে পড়েছে। ক্রিসমাস শেষে নতুন অর্ডার পাওয়ার সময় হলেও ক্রেতারা অর্ডার দিতে বাংলাদেশে আসতে পারছেন না। বিজিএমইএ প্রেসিডেন্ট আতিকুল ইসলাম বলেন, বিদ্যমান অবস্থায় বিদেশী ক্রেতারা ভীত হয়ে পড়ছেন। ইতিমধ্যে পোশাক শিল্পে অর্ডার প্রায় ৩০ শতাংশ কমে গেছে। দেশের রফতানির আয়ের অন্যতম পোশাক খাতে এ ক্ষতির পরিমাণ হচ্ছে ৫ হাজার ১৬০ কোটি টাকা এবং বিদেশী ক্রেতারা এ খাতের অর্ডার বাতিল করেছে ১১৮ কোটি টাকার। পর্যটন খাতে ক্ষতি হয়েছে ৪ হাজার ৮শ’ কোটি টাকা, ফ্যাশন শিল্প খাতে ৭শ’ কোটি টাকা, পোলট্রি খাতে ক্ষতি ৪৩২ কোটি টাকা, বীমা খাতে ৩৬০ কোটি টাকা, ফুটপাতের হকারদের ক্ষতি হয়েছে ৩৬০ কোটি টাকা ও প্লাস্টিক খাতে ক্ষতির পরিমাণ হচ্ছে ২৮৮ কোটি টাকা। এ ক্ষতির তালিকায় রয়েছে সব বন্দর, নির্মাণ খাত, শেয়ারবাজার।

আর্থিক ক্ষতি তুলে ধরে দু নেত্রীকে ব্যবসায়ীদের চিঠি: হরতাল ও অবরোধে দেশের ২৫ লাখ দোকানপাট বন্ধ থাকছে। চরমভাবে ক্ষতির শিকার হচ্ছেন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বিরোধী দলের নেত্রী খালেদা জিয়ার কাছে ২৬ জানুয়ারি বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতি চিঠি দিয়েছে। ওই চিঠিতে বলা হয়, দেশের ক্ষুদ্র দোকান ব্যবসার সঙ্গে এক কোটি লোক জড়িত। তাদের পরিবারের চার কোটি সদস্য নির্ভর করে এ খাতের আয়ের ওপর। কিন্তু প্রতিদিন হরতাল ও অবরোধের কারণে তিন হাজার কোটি টাকার ব্যবসার ক্ষতি হচ্ছে। এ ব্যবসার মাধ্যমে দোকানিদের ১০ শতাংশ মুনাফা হতো। সে হিসাবে ৩শ’ কোটি টাকা মুনাফা থেকে এ খাতের ২৫ লাখ ব্যবসায়ী হারাচ্ছেন। গত ২৪ দিনের টানা অবরোধের কারণে ব্যবসায়ীদের মুনাফা নষ্ট হয়েছে ৭ হাজার ২শ’ কোটি টাকা। এ ক্ষয়ক্ষতির চিত্র চিঠিতে তুলে ধরে দ্রুত এ পরিস্থিতি নিরসনে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেয়ার আহবান জানানো হয়। বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির সভাপতি এসএ কিরণ ও মহাসচিব শাহ আলম স্বাক্ষরিত এ চিঠি দুই নেত্রীর কাছে দেয়া হয়েছে।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির সিনিয়র সভাপতি রেজাউল ইসলাম মন্টু যুগান্তরকে বলেন, হরতাল ও অবরোধে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের রক্তক্ষরণ শুরু হয়েছে। আগামীতে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা টিকে থাকতে পারবে কিনা সে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। কারণ অনেকে ব্যাংক নিয়ে, ব্যক্তিগতভাবে ঋণ নিয়ে ব্যবসা চালাচ্ছেন।

সংলাপের আহ্বান ব্যবসায়ীদের: অবরোধে ৩০ হাজার কোটি টাকার রফতানি বাণিজ্য হুমকির মধ্যে পড়েছে। বিশেষ করে পোশাক, হিমায়িত খাদ্য, প্লাস্টিক, পাট ও পাটজাত পণ্য, নিটওয়্যার, চিংড়ি, চামড়াসহ অন্যান্য রফতানি পণ্য খাত ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। অবরোধ-হরতাল শিল্প খাতে আমদানি ও রফতানিসহ পণ্য উৎপাদন, পরিবহন ও জাহাজীকরণে বাধা হচ্ছে। এতে বিদেশী ক্রেতাদের কাছে ইমেজ সংকট তৈরি হচ্ছে। এছাড়া শিল্প প্রতিষ্ঠানে শ্রমিকদের আসা-যাওয়ায় পরিবহন সংকটে পড়তে হচ্ছে। এ প্রসঙ্গে এক্সপোর্টার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ইএবি) প্রেসিডেন্ট সালাম মুর্শেদী যুগান্তরকে বলেন, রফতানি পণ্য সময়মতো জাহাজীকরণ করতে ব্যর্থ হয়ে বিশেষে মূল্যছাড়, ১০ গুণ খরচ বৃদ্ধিসহ আকাশপথে পণ্য পাঠাতে হচ্ছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে জাহাজীকরণ নির্ধারিত সময়ে না হলে বিদেশী ক্রেতারা পণ্যের কনসাইনমেন্ট বাতিল করছেন। এ অবস্থায় উভয় দলকে সংলাপে বসে পরিস্থিতি স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনার আহ্বান জানানো হয়েছে ইএবির পক্ষ থেকে।

Leave a comment