স্টাফ রিপোর্টার: ঢাকার যাত্রাবাড়ীতে বাসে পেট্রলবোমা ছুড়ে আগুন দেয়ার ঘটনায় বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে হুকুমের আসামি করে মামলা করেছে পুলিশ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অবরোধের মধ্যে নাশকতার জন্য খালেদা জিয়াকে দায়ী করে তাকে ‘হুকুমের আসামি’ করার পক্ষে মত দেয়ার দুই দিনের মাথায় এ মামলা হলো। এ ঘটনায় বিএনপিতে তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে। তারা এ ঘটনাকে নিষ্ঠুর ও অমানবিক বলে উল্লেখ করেছেন।
জানা গেছে, এর আগে বিএনপির অধিকাংশ জ্যেষ্ঠ নেতার নামে বিভিন্ন সময়ে নাশকতার মামলা হলেও দলটির চেয়ারপারসনের বিরুদ্ধে এ ধরনের মামলা এই প্রথম। দুর্নীতির দুই মামলায় অভিযুক্ত খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে সমপ্রতি ধর্মীয় উসকানির অভিযোগেরও একটি মামলা হয়।
যাত্রাবাড়ী থানার উপপরিদর্শক কে এম নুরুজ্জামান শনিবার বিকালে যে দুটি মামলা করেছেন, তাতে পেট্রলবোমা নিক্ষেপের পরিকল্পনাকারী হিসেবে বিএনপির ১৮ নেতার নাম উল্লেখ করা হয়েছে। এছাড়া পরিকল্পনা বাস্তবায়নকারী হিসেবে যাত্রাবাড়ী বিএনপির ৫০ নেতাকর্মীকে আসামি করেছেন তিনি।
এর মধ্যে ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইনের ১৫/২৫ (ঘ) ধারায় করা ৫৮ নম্বর মামলায় আসামিদের বিরুদ্ধে অন্তর্ঘাতমূলক অপরাধের অভিযোগ আনা হয়েছে।
আর ৫৯ নম্বর মামলাটি হয়েছে দ-বিধির ১৪৩, ৩২৬, ৩০৭, ১১৪, ৩৪ ধারায়, যাতে অবৈধভাবে বিস্ফোরক দ্রব্য ব্যবহার, হত্যা চেষ্টা ও বেআইনি জমায়েতের অভিযোগ রয়েছে।
গত শুক্রবার রাতে যাত্রাবাড়ীর কাঠেরপুল এলাকায় একটি যাত্রীবাহী বাসে পেট্রলবোমা ছোড়া হলে ৩১ জন দগ্ধ হন। দগ্ধদের মধ্যে অন্তত সাতজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক। তারা ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে চিকিৎসাধীন।
এসআই নুরুজ্জামান বলেন, খালেদা জিয়াকে মামলায় হুকুমের আসামি করা হয়েছে। এজাহারে বলা হয়েছে, বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া গত ৫ জানুয়ারি দেশব্যাপী অবরোধের ডাক দেন এবং সরকারের পতন না হওয়া পর্যন্ত দেশে অচলাবস্থা নিশ্চিত করতে নেতাকর্মীদের নির্দেশ দেন। তার ওই নির্দেশেই আসামিরা বাসে নাশকতা ঘটায়।
বাসে পেট্রোলবোমা নিক্ষেপের পরিকল্পনাকারী হিসেবে বিএনপির যে ১৮ নেতার নাম উল্লেখ করা হয়েছে তারা হলেন- বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য এমকে আনোয়ার, রফিকুল ইসলাম মিয়া, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা খন্দকার মাহবুব হোসেন, শওকত মাহমুদ, বিশেষ সহকারী শিমুল বিশ্বাস, ভাইস চেয়ারম্যান সেলিমা রহমান, যুগ্ম মহাসচিব রিজভী আহমেদ, বরকতউল্লা বুলু, আমানউল্লাহ আমান, মহিলা দলের সাধারণ সম্পাদিকা শিরিন সুলতানা, বিএনপি চেয়ারপারসনের প্রেসসচিব মারুফ কামাল খান, দলের প্রেস উইংয়ের কর্মকর্তা শায়রুল কবির খান, শামসুদ্দিন দিদার, ঢাকা মহানগর বিএনপির সদস্যসচিব হাবিবুন্নবী খান সোহেল, শরফুদ্দিন সফু, ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি আজিজুল বারী হেলাল, ঢাকার সাবেক কমিশনার আব্দুল কাইয়ুম ও লতিফ।
তাদের করা নাশকতার পরিকল্পনা বাস্তবায়নের অভিযোগ আনা হয়েছে যাত্রাবাড়ী এলাকার ৫০ বিএনপি নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে, যাতে প্রথমেই আছে ঢাকা মহানগর বিএনপির সমবায়বিষয়ক সম্পাদক সালাউদ্দিন আহমেদের নাম।
এ আসামিরা ছাড়াও অজ্ঞাতপরিচয় কিছু ব্যক্তি এবং জামায়াত-বিএনপি জোটের নেতাকর্মীরা নাশকতায় জড়িত বলে এজাহারে উল্লেখ করা হয়। এতে বলা হয়, যাত্রাবাড়ীতে বাসে নাশকতার ঘটনায় ৩১ জন দগ্ধ হওয়ার পাশাপাশি গাড়িটি পুড়ে পাঁচ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে।
উল্লেখ্য, নির্বাচনের বর্ষপূর্তির দিনে ৫ জানুয়ারি ঢাকায় সমাবেশ করতে না পেরে পুলিশের ঘেরাওয়ের মধ্যে নিজের গুলশানের কার্যালয় থেকেই সারাদেশে লাগাতার এ অবরোধের ঘোষণা দেন বিএনপি প্রধান খালেদা জিয়া। এ অবরোধের মধ্যে প্রতিদিনই দেশের বিভিন্ন স্থানে যানবাহনে অগ্নিসংযোগ ও বোমাবাজি চলছে। এ নাশকতা ও সহিংসতায় এ পর্যন্ত ৩৪ জনের মৃত্যু হয়েছে, দগ্ধ হয়েছে বহু মানুষ।
এ প্রেক্ষাপটে গত বুধবার সংসদ অধিবেশনে ক্ষমতাসীন ও বিরোধী দল- দু পক্ষ থেকেই খালেদা জিয়াকে গ্রেফতারের দাবি জানানো হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও বলেন, পুড়িয়ে মানুষ হত্যার জন্য খালেদা জিয়াকে হুকুমের আসামি করা যুক্তিযুক্ত। এ প্রেক্ষাপটে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল গত বৃহস্পতিবার বলেন, খালেদা জিয়াকে গ্রেফতারের বিষয়ে আইনি প্রক্রিয়া দেখা হচ্ছে।
শোকগ্রস্ত খালেদার বিরুদ্ধে মামলা, বিবেকশূন্য সরকার: এদিকে যাত্রাবাড়ীতে বাসে পেট্রোলবোমা মেরে অনেক মানুষকে দগ্ধ করার ঘটনায় বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াসহ জ্যেষ্ঠ নেতাদের বিরুদ্ধে মামলা করার প্রতিবাদ জানিয়েছেন দলের যুগ্ম-মহাসচিব অ্যাডভোকেট রুহুল কবির রিজভী। গতকাল রোববার সন্ধ্যায় এক বিবৃতিতে তিনি বলেন, বর্তমান জবরদখলকারী ভোটারবিহীন সরকার হিংস্র অমানবিকতার যে আরেকটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন তাহলো পুত্রশোকে কাতর খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দায়ের করে। কতোখানি নিষ্ঠুর ও বিবেকশূন্য হলে একটি সরকার এই জঘন্য অপকর্মটি করতে পারে তা দুনিয়াতে মনে হয় নজিরবিহীন। এই ভোটারবিহীন সরকার মনুষ্যত্বের সব বৈশিষ্ট্যগুলোকে জলাঞ্জলি দিয়েছে।
রিজভী বলেন, এ সরকার ও তাদের আন্দোলনের ফসল ১/১১’র সরকারের মানসিক ও শারীরিক নির্যাতনে প্রায় সাড়ে সাত বছর ধরে অসুস্থতায় ভুগছিলেন আরাফাত রহমান কোকো। ২০০৭ সালের মঈনউদ্দিন-ফখরুদ্দিনের সরকার বেগম খালেদা জিয়াকে গ্রেফতারের দিনই কোকোকে আটক করে। আটকের পর তার ওপর চালানো হয় অমানুষিক অত্যাচার। এ অত্যাচারেই গুরুতর হৃদরোগে আক্রান্ত হন আরাফাত রহমান কোকো। এরপর আওয়ামী মহাজোট সরকার একের পর এক মিথ্যা মামলা দায়ের করতে থাকে কোকোর বিরুদ্ধে। মায়ের কাছ থেকে সন্তান ও সন্তানের পরিবারকে বিচ্ছিন্ন করে রাখা হয়। মানসিক ও শারীরিক নির্যাতনের ফলে অসুস্থতায় ভুগতে ভুগতে গতকাল আরাফাত রহমান কোকো মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের পরিবারকে ধারাবাহিকভাবে ধ্বংস করার একটি মাত্র উদ্দেশ্য হচ্ছে তার বহুদলীয় গণতন্ত্রকে উচ্ছেদ করে এক ব্যক্তির একক রাজত্ব চালিয়ে যাওয়ার পথে বাধা দূর করা।
তিনি বলেন, কোকোর মৃত্যুতে খালেদা জিয়ার সাথে প্রধানমন্ত্রীর সাক্ষাৎ করতে আসাটাকে আমরা ইতিবাচক অর্থেই গ্রহণ করেছিলাম। রাজনীতির বাইরে সামাজিক দায়িত্ববোধের তাগিদেই প্রধানমন্ত্রী বেগম জিয়াকে সমবেদনা জানাতে আসছেন বলে ধরে নিয়েছিলাম। কিন্তু বেগম জিয়ার বিরুদ্ধে মামলা দায়েরের ঘটনায় এটা সুস্পষ্ট যে, গতকাল কোকোর মৃত্যুর সংবাদে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার গুলশান কার্যালয়ে প্রধানমন্ত্রীর সহানুভূতি জানাতে আসাটা ছিলো নিছকই ছলনা, একটি প্রহসনের মহড়া মাত্র। কোকোর জন্য প্রধানমন্ত্রীর সমবেদনা জানানোটা যেন কুমিরের কান্না।
রুহুল কবির রিজভী বলেন, প্রধানমন্ত্রী তার রাজনৈতিক বিরোধীদের গভীর শোকের সময়ও তাদের বিরুদ্ধে নিজের অন্তরের বিদ্বেষ-বিষ দূরীভূত করতে পারেননি। বেগম জিয়াকে কারাগারে বন্দি করার নীল নকশা তারা অনেক দিন ধরেই এঁটে আসছে। বেগম জিয়াকে দায়ী করে আটক করার জন্যই একের পর এক পেট্রলবোমা মেরে নাশকতার ঘটনা ঘটানো হচ্ছে। বিএনপির পক্ষ থেকে দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে বারবার বলা হয়েছে যে, সরকারি এজেন্টরাই এ নাশকতাগুলো করছে বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে। সেই উদ্দেশ্যটা হচ্ছে গণবিরোধী ভোটারবিহীন সরকারের বিরুদ্ধে মানুষের ক্ষোভকে ভিন্ন দিকে ঘুরিয়ে দেয়া। চলমান আন্দোলনের বিরুদ্ধে নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি করা। আর সেজন্যই বেগম জিয়াসহ নেতাদের নামে মিথ্যা মামলা দায়ের করা হয়েছে।’
রিজভী আহমেদ বলেন, বেগম জিয়াকে নিজ বাড়ি থেকে উচ্ছেদ, তাকে এবং তার ছেলেদের বিরুদ্ধে একের পর এক মিথ্যা মামলা দায়ের, ছেলেদের মায়ের কাছ থেকে দূরে রাখতে বাধ্য করাসহ এমন কোনো উৎপীড়নের পন্থা নেই যা এই সরকার অবলম্বন করেনি। কিন্তু তারপরও জাতীয়তাবাদী শক্তিকে দমিয়ে রাখতে পারেনি।
চলমান আন্দোলন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, জনগণ এখন রাস্তায় নেমে এসেছে। গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের আন্দোলন গন্তব্যে না পৌঁছানো পর্যন্ত শান্তিপূর্ণভাবে জনগণের সম্মিলিত শক্তিতে অবরোধ-হরতাল অব্যাহতভাবে চলতে থাকবে।
বিএনপির যুগ্ম-মহাসচিব সরকারকে হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন, অবিলম্বে বিএনপি চেয়ারপারসনসহ সব নেতার বিরুদ্ধে দায়েরকৃত ষড়যন্ত্রমূলক মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার করতে হবে, অন্যথায় এ সরকারকে ভয়াবহ পরিণতির জন্য আর বেশিদিন অপেক্ষা করতে হবে না। তিনি যাত্রাবাড়ীতে পেট্রোলবোমা হামলার ঘটনায় তীব্র নিন্দা জানিয়ে অবিলম্বে প্রকৃত দোষীদের গ্রেফতার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির জোর দাবি জানান।