স্কুলছাত্রী তাহেরার মৃতদেহ ৪০ দিন পর কবর থেকে তুলে পুনঃময়নাতদন্ত

চুয়াডাঙ্গার আলমডাঙ্গায় সন্দেহভাজনদের নিয়ে নানা গুঞ্জন : মামলার বাদীর দীর্ঘশ্বাস

 

আলমডাঙ্গা ব্যুরোঃ দাফনের ৪০ দিনের মাথায় গতকাল রোববার স্কুলছাত্রী তাহেরা খাতুনের লাশ কবর থেকে তুলে পুনঃময়নাতদন্ত করা হয়েছে। প্রথম ময়নাতদন্ত চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালে করা হয়। মামলার বাদীর আবেদনের প্রেক্ষিতে আদালতের আদেশে গতকাল লাশ কবর থেকে তুলে দ্বিতীয় দফা ময়নাতদন্ত কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতাল মর্গে করা হয়েছে। দ্বিতীয় দফা ময়নাতদন্ত শেষে একই কবরস্থানে পুনঃদাফন কাজও গতকাল সম্পন্ন করা হয়েছে। অপরদিকে তাহেরার অস্বাভাবিক মৃত্যু নিয়ে নানা গুঞ্জন অব্যাহত রয়েছে। হত্যার দৃশ্য মোবাইলফোনে ধারণ করা হয় বলেও জোর গুঞ্জন রয়েছে। অবশ্য এর সত্যতা নিশ্চিত করা সম্ভব না হলেও স্থানীয়দের অনেকেই বলেছেন- হত্যাকারীদের ধরে সুষ্ঠু জিজ্ঞাসাবাদে বেরিয়ে আসতে পারে চাঞ্চল্যকর বহু তথ্য।

Tahera-1

জানা গেছে, তাহেরার লাশ পুনঃতদন্তের জন্য সম্প্রতি তাহেরার পিতা আলমডাঙ্গার ছাত্রপাড়ার শাহজাহান আলী আদালতে আবেদন করেন। আবেদনের প্রেক্ষিতে বিজ্ঞ আদালত কবর থেকে লাশ তুলে পুনঃময়নাতদন্তের আদেশ দেন। এ আদেশবলে গতকাল রোববার নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট আলমডাঙ্গা উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) আসিফুর রহমানের উপস্থিতিতে ছত্রপাড়া গ্রামের কবর থেকে তাহেরার লাশ উত্তোলন করা হয়। সকাল ১০টার দিকে লাশ উত্তোলনকালে অন্যান্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন আলমডাঙ্গা থানার ওসি (তদন্ত) নাজমুল হুদা, এসআই আনিস, এসআই বদিউর রহমান ও তাহেরার পিতা-মাতাসহ আত্মীয়-স্বজন। উৎসুক জনতাও ভিড় জমাতে থাকে। লাশ তোলার পর দেখে স্থানীয়রা বলেন, উত্তোলিত লাশের মুখমণ্ডল বিকৃত হলেও শরীরের অধিকাংশ প্রায় অক্ষতই দেখা গেছে। ম্যাজিস্ট্রেটের উপস্থিতিতে পুলিশ উত্তোলিত লাশের সুরতহাল রিপোর্ট প্রণয়ন করে। বেলা সাড়ে ১১টার দিকে লাশ পুনঃময়নাতদন্তের জন্য কুষ্টিয়া মেডিকেল কলেজ হাসপাতালমর্গে নেয়া হয়। সেখানে ৪ জন ডাক্তারের একটি টিম প্রায় ২ ঘন্টা যাবত লাশের ময়নাতদন্ত করেন। বিকেলে লাশ গ্রামে ফিরিয়ে নেয়া হয়। বাদ আছর পুনরায় তাহেরার লাশ দাফন করা হয়েছে।

উল্লেখ্য, গত ৮ ডিসেম্বর আলমডাঙ্গা শহরের আনন্দধামের ভাড়াবাড়ির একটি ঘরে গলায় ফাঁস দেয়া অবস্থায় স্কুলছাত্রী তাহেরার লাশ উদ্ধার করা হয়। মৃতদেহে ছিলো কাটা ও আঁচড়ানোর স্পষ্ট দাগ। জিন তাকে হত্যা করেছে বলে একটি মতলববাজগোষ্ঠী শুরু থেকেই গুজব ছড়াতে থাকে। তাহেরার ওপর বর্বরোচিত হামলা চালিয়ে তাকে হত্যা করে লাশ ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে বলে স্থানীয়রা মন্তব্য করে। লাশ উদ্ধারের সময় পুলিশেরও ঘোরতর সন্দেহ হয়। বিশেষ করে মৃত তাহেরার ডান হাতের তালুতে ‘আই লাভ ইউ’ লেখার তাৎপর্যকে গুরুত্ব দেন সকলে। মৃত তাহেরার হাত, বুক ও পুরো পেটে ব্লেড বা ধারালো কিছু দিয়ে অসংখ্য কাটার দাগ ছিলো লক্ষণীয়। দাগগুলো রক্তাক্ত দেখালেও রক্ত বের হয়নি। লাশ উদ্ধার করে পরদিন চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালমর্গে ময়নাতদন্ত করা হয়। পৈত্রিক গ্রাম ছত্রপাড়ায় দাফন কাজ সম্পন্ন করা হয়। তাহেরার পিতা বাদী হয়ে আলমডাঙ্গা থানায় হত্যা মামলা দায়ের করেন। তিনি যে এজাহার লিখে নিয়ে থানায় হাজির হয়েছিলেন সেটা না নিয়ে পরে লিখে নিয়ে তাতে স্বাক্ষর নেয়া হয় বলেও মৌখিক অভিযোগ তোলেন তিনি। স্কুলছাত্রী তাহেরা হত্যার প্রতিবাদে ও হত্যাকারীদের গ্রেফতারের দাবিতে স্কুল শিক্ষার্থী, শিক্ষকসহ সুধীসমাজ রাস্তায় নামে। অভিযোগ ওঠে, হত্যাকাণ্ড ভিন্নখাতে নেয়ার চক্রান্ত চলছে। এরই মাঝে ময়নাতদন্তের সপ্তাহ না ঘুরতেই ময়নাদন্ত রিপোর্ট পুলিশের হাতে পৌঁছায়। স্কুলছাত্রী তাহেরা আত্মহত্যা করেছে মর্মে ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন পেয়ে মামলার মোড় ঘোরায়। অপরদিকে ময়নাতদন্ত রিপোর্ট সঠিক হয়নি বলে দাবি করে মামলার বাদী অভিযোগ তোলেন। তিনি আদালতে মেয়ের পুনঃময়নাতদন্তের আবেদন করেন। বিজ্ঞ আদালত পুনঃময়নাতদন্তের জন্য আদেশ দেন। আদেশমতে গতকাল লাশ তুলে কুষ্টিয়া হাসপাতালমর্গে নিয়ে পুনঃময়নাতদন্ত সম্পন্ন করা হয়।

এদিকে তাহেরার রহস্যজনক মৃত্যুর পর সন্দেহের শীর্ষে উঠে আসে বাড়ি মালিকের ছেলে বাচ্চুসহ তার কয়েকজন সহযোগীর নাম। এদের তেমন কাউকে পুলিশ গ্রেফতার না করলেও তাহেরা খাতুনের গৃহশিক্ষক রাশেদকে গ্রেফতার করে। অপরদিকে সন্দেহভাজনদের একজন গত ৩১ ডিসেম্বর টার্কিস এয়ারলাইনে কোস্টারিকায় চলে গেছে বলে জোর গুঞ্জন রয়েছে। সন্দেহভাজনদের নিয়ে আলোচনার মাঝে ওঠে এসেছে তাদেরই একজনের মোবাইলফোনে হত্যার দৃশ্য ধারণের গুঞ্জন। এসব গুঞ্জনের সত্যতা যেমন নিশ্চিত করা সম্ভব হয়নি, তেমনই তাহেরা হত্যা মামলার বাদী নানা শঙ্কা প্রকাশ করে বলেছেন, জানি না, বিচার পাবো কি-না। নাকি প্রভাবশালীদের কাছে হেরে যাবো, তাও বুঝতে পারছি না। তাহেরা খাতুনের পিতার এ উক্তির প্রেক্ষিতে পুলিশের সাথে যোগাযোগ করা হলে পুলিশেরই এক দারোগা বলেছেন, এ মামলার বিষয়ে পুলিশ সুপারের বিশেষ দৃষ্টি রয়েছে। হতাশ হওয়ার কারণ নেই। তাহেরা সত্যি সত্যিই হত্যার শিকার হলে ঘাতকদের কেউ পার পাবে না।