ইজতেমা শেষেই যৌথবাহিনীর অভিযান

স্টাফ রিপোর্টার: অবরোধের নামে দেশের বিভিন্ন স্থানে নাশকতার ঘটনা বেড়েই চলেছে। সড়কে যানবাহনে হামলা হচ্ছে, পুড়ে অঙ্গার হচ্ছে মানুষ। উপড়ে ফেলা হচ্ছে রেললাইনের ফিশপ্লেট, লাইনচ্যুত হচ্ছে ট্রেন। দিন দিন আরো বেপরোয়া হয়ে উঠছে দুর্বৃত্তরা। গত বছরের ৫ জানুয়ারি দশম সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে যেসব স্থানে নাশকতা হয়েছিলো, এবারও সেসব জায়গাতেই ঘটছে অপরাধ কর্মকাণ্ড। তাই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে এবার পুরোপুরি হার্ডলাইনে যাচ্ছে সরকার।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, নাশকতাকারীদের ঠেকাতে সরকারের নীতিনির্ধারকরা আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর সাথে দফায় দফায় বিশেষ বৈঠক করছেন। আগামী এক সপ্তার মধ্যে দেশের সার্বিক পরিস্থিতি পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশ-ৱ্যাবকে বিশেষ নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। বিশ্ব ইজতেমার পর পরই নাশকতাপ্রবণ এলাকাগুলোতে শুরু হচ্ছে যৌথবাহিনীর বিশেষ অভিযান। বিজিবি, পুলিশ, ৱ্যাব, আনসার ও গোয়েন্দা সংস্থার সমন্বয়ে কাজ করবে যৌথবাহিনী। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর এবং যানবাহনে হামলা বা অগ্নিসংযোগ করলেই নাশকতাকারীদের লক্ষ্য করে গুলি চালানো হবে। তবে সাধারণ লোকজন যাতে হয়রানির শিকার না হয়, সেদিকে বিশেষ নজর দিতে বলা হয়েছে। যৌথবাহিনীতে সেনাবাহিনীকে রাখা হচ্ছে না। পরিস্থিতি নাগালের বাইরে চলে গেলে তাদের ডাকা হতে পারে।

সরকারের নির্দেশে ইতোমধ্যে সারাদেশে নাশকতাকারীদের তালিকা করেছে পুলিশ ও ৱ্যাব। তাতে যোগ হয়েছে প্রায় ১০ হাজার নাম। তাদের মধ্যে সহিংসতার পরিকল্পনাকারী হিসেবে নাম আছে সহস্রাধিক জনের। তালিকাভুক্তদের বেশির ভাগই বিএনপি-জামায়াত জোটের নেতাকর্মী। তাছাড়া সন্ত্রাসী ও বোমাবাজদের নামও আছে তালিকায়। নাশকতা প্রতিরোধে জেলায় জেলায় নাশকতা প্রতিরোধ কমিটি গঠনের কাজও শুরু হয়েছে। কমিটিতে ক্ষমতাসীন ১৪ দলীয় জোটের নেতা-কর্মীদের পাশাপাশি এলাকার গণমান্য ব্যক্তিদের রাখা হচ্ছে। ভিভিআইপি ব্যক্তিদের ওপর বড় ধরনের হামলা হতে পারে বলে তথ্য রয়েছে গোয়েন্দাদের কাছে। এ কারণে গত বুধবার থেকে মন্ত্রী-এমপিদের বাসাবাড়ি ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে কঠোর নিরাপত্তা বলয় গড়ে তোলার জন্য পুলিশ কমিশনার ও পুলিশ সুপারদের বিশেষ চিঠি দিয়েছে পুলিশ হেডকোয়ার্টার্স।

এ প্রসঙ্গে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, নাশকতাকারীদের তালিকা প্রস্তুত করা হয়েছে। তাদের ধরতে বিশেষ অভিযান শুরু হচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর হামলা বা নাশকতা চালানো হলে আত্মরক্ষার্থে তারা (আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী) নাশকতাকারীদের গুলি করতে পিছপা হবে না। বিজিবির প্রধানও একই কথা বলেছেন। কোনো দুর্বৃত্তকে আমরা ছাড় দেব না। তবে নিরপরাধ লোকজনকে হয়রানি করার প্রশ্নই আসে না। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, রাজনৈতিক নিধন করা সরকারের কাজ নয়। যারা রাজনৈতিক দুর্বৃত্ত তাদের শায়েস্তা করা হবে। রংপুরের পিঠাপুকুরে বাসে পেট্রোলবোমা মেরে পাঁচ যাত্রীকে যারা হত্যা করেছে তারা সবাই বিএনপি-জামায়াত জোটের ক্যাডার।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, গত ৫ জানুয়ারি থেকে বিএনপি-জামায়াত জোটের ডাকে সারাদেশে অবরোধ চলছে। অবরোধকারীরা যানবাহনে হামলা চালিয়ে ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ চালাচ্ছে। আতঙ্ক নিয়ে রাস্তায় চলাচল করছে সাধারণ মানুষ। এ পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে সরকার নানা কৌশল নিয়েছে। সরকারের নীতিনির্ধারকরা প্রতিদিন বৈঠক করছেন, পুলিশ-ৱ্যাবকে বিশেষ নির্দেশনা দিচ্ছেন। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা আইন প্রয়োগকারী সংস্থার শীর্ষ কর্মকর্তাদের সাথে বৈঠক করছেন। বিভিন্ন স্থানে নাশকতার ঘটনা বেড়ে যাওয়ায় এবার সরকার হার্ডলাইনে যাচ্ছে। সিদ্ধান্ত হয়েছে বিশেষ অভিযান চালানোর।

বিশ্ব ইজতেমার পরপরই অভিযান: সূত্র জানায়, বিশ্ব ইজতেমার পরপরই যৌথবাহিনীর বিশেষ অভিযান শুরু হচ্ছে। ইতোমধ্যে রংপুর অঞ্চলে যৌথহিনীর অভিযান শুরু হয়েছে। এছাড়া চাঁপাইনবাবগঞ্জ, শিবগঞ্জ, কানসাট, খুলনা, সাতক্ষীরা, শেরপুর, বগুড়ার শাহজাদপুর, গাবতলী, গাইবান্দার বামুনডাঙ্গা, গোবিন্দগঞ্জ, পলাশবাড়ী, রাজশাহী এবং বরিশাল ও চটগ্রাম বিভাগে অভিযান চালাবে যৌথবাহিনী। এ প্রসঙ্গে পুলিশ হেডকোয়ার্টার্সের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘বিশেষ অভিযান চালানো হবে। যে উপায়েই হোক অবরোধ প্রতিরোধসহ সব ধরনের পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনা হবে। জনগণ যাতে নির্ভয়ে চলাফেরা করতে পারে, সেজন্য আমরা হার্ডলাইনে চলে গেছি। পর্যায়ক্রমে সারা দেশে যৌথবাহিনীর অভিযান চালানো হবে।

পুলিশের মহাপরিদর্শক একেএম শহীদুল হক গতকাল বলেন, নাশকতাকারীদের ধরা হবেই। এজন্য আমরা সব ধরনের প্রস্তুতি নিয়েছি। অল্প সময়ের মধ্যেই দেশের পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে বলে আশা করছি। নাশকতাকারীদের তালিকা নিয়ে শিগগির দেশব্যাপী বিশেষ অভিযান শুরু হবে। দু-একটি স্থানে জোরেশোরে অভিযান শুরু হয়ে গেছে। রাষ্ট্রের সম্পদ রক্ষা করা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাজ। এ ক্ষেত্রে যা যা করা দরকার তাই করা হবে।

তালিকা প্রস্তুত: দেশের বিভিন্ন স্থানে নাশকতার ঘটনা বেড়ে যাওয়ায় সরকার নাশকতাকারীদের তালিকা প্রস্তুত করার নির্দেশ দেয়। নির্দেশনা পেয়ে তিন দিন আগে পুলিশ-ৱ্যাব ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলো তালিকা প্রস্তুত করে। তালিকায় নাশকতাকারী হিসেবে প্রায় ১০ হাজার নাম আছে। তাদের রাজনৈতিক পরিচয়, শিক্ষাগত যোগ্যতা, তাদের বিরুদ্ধে মামলার সংখ্যা ও এলাকায় তাদের ভাবমূর্তি কেমন তালিকায় তার উল্লেখ রয়েছে। তালিকাভুক্তদের মধ্যে বেশির ভাগই রাজশাহী, খুলনা, রংপুর, বগুড়া, চট্টগ্রাম ও সাতক্ষীরা অঞ্চলের। তাদের মধ্যে বিএনপি-জামায়াত জোটের নেতাকর্মীর সংখ্যাই বেশি। আর তালিকায় নাশকতার পরিকল্পনাকারী হিসেবে এক হাজারের বেশি নাম রয়েছে। তাদের মধ্যে নওগাঁ জেলার ৮৭, পাবনার ১৭, সিরাজগঞ্জের ৪৭, বগুড়ার ৩২, রাজশাহীর ১৭৪, নাটোরের ৫৪, জয়পুরহাটের ৭৫, চাঁপাইনবাবগঞ্জের ১১২, খুলনার ১২৭, যশোরের ৯৭, ঝিনাইদহের ৮৬, নড়াইলের ৬৮, কুষ্টিয়ার ৫৪, সাতক্ষীরার ১৪৩, বাগেরহাটের ৯৬, রংপুরের ৫৪, কুড়িগ্রামের ৪৩, গাইবান্ধার ৮৬, দিনাজপুরের ৭৫, ঠাকুরগাঁওয়ের ১৩১, লালমনিরহাটের ৬৫, নীলফামারীর ৭৭, চট্টগ্রামের ১১২, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ৪৩, ফেনীর ২২, লক্ষ্মীপুরের ৪৩, কুমিল্লার ৩৭, চাঁদপুরের ৯৫, কক্সবাজারের ৬৮, নোয়াখালীর ২৩, মানিকগঞ্জের ৪৬, ময়মনসিংহের ১৪৩, নারায়ণগঞ্জের ৪৭, নেত্রকোরার ৮৬, শেরপুরের ৯৭, জামালপুরের ৪৬, টাঙ্গাইলের ৫৬, গাজীপুরের ৪৮, নরসিংদীর ৪৯, ফরিদপুরের ৮৭, বরিশালের ১৫৪, ঝালকাঠির ৩৮, পিরোজপুরের ৩৭, পটুয়াখালীর ৪৮, ভোলার ৫৮, সিলেটের ১৭৫, মৌলভীবাজারের ৯৬, হবিগঞ্জের ৩৯ ও সুনামগঞ্জের ৭৭ জন রয়েছেন।

হামলা চালালেই গুলি: আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর বা কোনো যানবাহনের ওপর হামলা চালালে নাশকতাকারীদের গুলি করতে দ্বিধা করবে না আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যরা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পুলিশের এক কর্মকর্তা গতকাল বলেন, দু দিন আগে আমাদের কাছে নির্দেশ এসেছে, যে উপায়েই হোক রাজনৈতিক দুর্বৃত্তদের রুখতে হবে। বিশেষ করে নাশকতাকারীদের রুখতে সব জেলার পুলিশ সুপারদের কাছে বিশেষ নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। নির্দেশনায় গুলি করার কথাটিও বলা আছে।

এক সপ্তাহের মধ্যেই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার নির্দেশ: আগামী এক সপ্তার মধ্যে বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশ-ৱ্যাবকে নির্দেশ দিয়েছে সরকারের হাইকমান্ড। প্রয়োজনে কমান্ডো স্টাইলে অভিযান চালানোর কথা বলা হয়েছে। পুলিশের বিভিন্ন স্তরের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য নিশ্চিত হওয়া গেছে।

মন্ত্রী-এমপিদের বাসা-ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে নিরাপত্তা বাড়াতে বিশেষ চিঠি: সরকারের মন্ত্রী ও এমপিদের বাসা বাড়ি ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে নিরাপত্তা বাড়াতে পুলিশ হেডকোয়ার্টার্স থেকে বিশেষ চিঠি পাঠানো হয়েছে পুলিশ কমিশনার ও এসপিদের কাছে। নির্দেশনা পেয়ে গত বুধবার থেকেই নিরাপত্তা জোরদার করা হয়। মন্ত্রীরা কোথাও গেলে তাদের গাড়ির সামনে-পেছনে পুলিশের কঠোর নিরাপত্তা থাকে। আর ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলোর সামনে টহল দিচ্ছে শাদা পোশাকধারী পুলিশ।

নাশকতা প্রতিরোধ কমিটি গঠন শুরু: সূত্র মতে, নাশকতা বেড়ে যাওয়ায় দেশের সব জায়গায় নাশকতা প্রতিরোধ কমিটি গঠনের কাজ শুরু হয়েছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা জানান, কমিটিতে মুক্তিযোদ্ধার চেতনায় বিশ্বাসী লোকজন, ১৪ দলীয় জোটের নেতাকর্মী, এলাকার গণমান্য ব্যক্তিদের রাখা হচ্ছে। মসজিদের ইমামদের রাজনৈতিক আমলনামা যাচাই-বাছাই করে কমিটিতে রাখা হবে। বিভাগীয় কমিশনার, ডিসি, এসপিদের পাশাপাশি স্থানীয় সংসদ সদস্যরাও কমিটির ব্যাপারে সার্বক্ষণিক খোঁজখবর রাখবেন।