২০ দলের ডাকা অনির্দিষ্টকালের অবরোধ : সারাদেশে পুলিশের ব্যাপক ধরপাকড়
স্টাফ রিপোর্টার: ২০ দলের ডাকা অনির্দিষ্টকালের অবরোধের ৯ম দিনে প্রাণ হারিয়েছেন ৭ জন। এর মধ্যে গতকাল রংপুরে বাসে পেট্রোল বোমা নিক্ষেপে অগ্নিদগ্ধ হয়ে মারা গেছে শিশুসহ ৫ জন। মঙ্গলবার মধ্যরাতে দুর্বৃত্তদের ছোড়া ওই পেট্রোলবোমায় দগ্ধ হয়েছেন আরও ৩০ জন। সেনবাগে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন এক যুবলীগ নেতা। মঙ্গলবার মারধরের শিকার হয়ে আহত হয়েছিলেন তিনি। চট্টগ্রামে অবরোধ চলাকালে শিবিরের এক কর্মীর মৃত্যু হয়েছে। এছাড়া প্রতিদিনের মতোই গতকালও বিভিন্ন জায়গায় পুলিশের গুলিতে আহত হয়েছেন ২০ দলের বেশ কয়েকজন নেতাকর্মী। রাস্তা কেটে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে বেশ কয়েক জায়গায়। অগ্নিসংযোগ, ভাঙচুর এবং সহিংসতার ঘটনা ছিলো দেশজুড়েই। এর মধ্যেই অবরোধ ও হরতালের সমর্থনে বিক্ষোভ-মিছিল হয়েছে। কোথাও কোথাও পাল্টা কর্মসূচিও পালন করেছে সরকার সমর্থকরা। গতকাল রাজধানীতে ৭টি গাড়িতে অগ্নিসংযোগ করেছে দুর্বৃত্তরা। ফেনীতে অন্তত ১০টি গাড়িতে ভাঙচুর চালিয়ে অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে। এছাড়া নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর চাঁপাই নবাবগঞ্জ, সিলেট, নেত্রকোনা, সীতাকুণ্ডুসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে অন্তত ৫০টি গাড়ি ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে। এদিনেও মামলা হয়েছে বেশ কয়েকটি। বিক্ষিপ্ত ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে অনেক এলাকায়।
এদিকে রংপুরে পুলিশ পাহারার মধ্যেই যাত্রীবাহী বাসে পেট্রোল বোমা ছুড়েছে দুর্বৃত্তরা। এতে বাসটিতে আগুন ছড়িয়ে পড়লে দু শিশু ও এক নারীসহ চারজন বাসের ভেতরেই পুড়ে মারা যান। বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের অবরোধ চলাকালে গত মঙ্গলবার গভীর রাতে মিঠাপুকুর উপজেলার বাতাসন দুর্গাপুর এলাকায় এই মর্মান্তিক ঘটনা ঘটে। বাসটি কুড়িগ্রামের উলিপুর থেকে ঢাকা যাচ্ছিলো। পৈশাচিক এই ঘটনার শিকার মা রহিমা বেগম তার শিশুসন্তানকে বুকে জড়িয়ে ধরেও আগুনের লেলিহান শিখা থেকে রক্ষা করতে পারেননি। পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিস সদস্যরা বাসের ভেতর থেকে বুকে জড়ানো অবস্থায় মা ও শিশুর লাশ উদ্ধার করে। এ ঘটনায় এক সেনা সদস্যের পরিবারের ১১ সদস্যসহ আরো ২৫ যাত্রী অগ্নিদগ্ধ হয়েছেন। আহতদের রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) ভর্তি করা হয়েছে। এদের মধ্যে ৩ জনের অবস্থা আশঙ্কাজনক বলে জানিয়েছেন চিকিত্সকরা। তাদের শরীরের বেশিরভাগ অংশই পুড়ে গেছে।
ডিঙ্গেদহ প্রতিনিধি জানিয়েছেন, ঝিনাইদহগামী লোকাল বাসে পেট্রোল বোমা নিক্ষেপ করেছে দুর্বৃত্তরা। অল্পের জন্য রক্ষা পেয়েছে বাসের যাত্রীরা। এ ব্যাপারে উৎসুক জনতা জানায়, গতকাল বুধবার সন্ধ্যা আনুমানিক ৭টার দিকে চুয়াডাঙ্গা থেকে ঝিনাইদহগামী বাস ডিঙ্গেদহ হায়দারপুর ব্রিজ পার হয়ে হাজি আনসার আলীর মুরগি খামারের নিকটে পৌঁছুলে দুর্বৃত্তরা বাসটি লক্ষ্য করে পেট্রোল বোমা নিক্ষেপ করে পালিয়ে যায়। তবে বোমাটি বিস্ফোরণ না ঘটায় প্রাণে রক্ষা পায় বাসের যাত্রীরা ও অক্ষত থেকে স্থান ত্যাগ করে বাসটি। এছাড়াও গত মঙ্গলবার রাতে আট পুকুরের ফিসারি অফিসের নিকট একটি ট্রাক লক্ষ্য করে বোমা নিক্ষেপ করে দুর্বৃত্তরা। এ ঘটনায় এলাকায় আতঙ্ক বিরাজ করছে।
জীবননগর ব্যুরো জানিয়েছে, বিএনপির ডাকা টানা অবরোধের গতকাল বুধবার জীবননগরে একটি নৈশকোচ ভাঙচুর করা হয়েছে। রাতে ঢাকাগামী নৈশকোচ এআর ডিলাক্স ভাঙচুর করা হয়। জীবননগর-কালীগঞ্জ সড়কের বাঁকায় অবরোধকারীরা এ নৈশকোচ ভাঙচুর করে বলে খবর পাওয়া গেছে। তবে এ ভাঙচুরের পর রাতে বিজিবি প্রহরায় ৭টি নৈশকোচ ঢাকার উদ্দেশে ছেড়ে যেতে দেখা গেছে।
মেহেরপুর অফিস জানিয়েছে, নাশকতার আশঙ্কায় জেলার বিভিন্ন এলাকা থেকে ১৭ বিএনপি কর্মীকে আটক করেছে পুলিশ। এদের মধ্যে মেহেরপুর সদর থানা পুলিশ ৮ জনকে, গাংনী থানা পুলিশ ৫ জনকে এবং মুজিবনগর থানা পুলিশ আরো ৩ জনকে আটক করেছে। মঙ্গলবার রাতে অভিযান চালিয়ে তাদের আটক করা হয়। আটকৃতরা হলেন- মেহেরপুর সদর উপজেলার রাইপুর গ্রামের জান মোহাম্মদের ছেলে মেহেদী হাসান (৪৫), আব্দুল জলিলের ছেলে মোমিনুল হক (৪০), রাজনগর গ্রামের আব্দুর রশিদের ছেলে রুহুল আমিন (৪০), শুকুর আলীর ছেলে আব্দুল জব্বার (৩৫), হারুনের ছেলে সাহাবুদ্দিন (৩৫), আব্দুর রহিমের ছেলে মজিবর (৪০), জাদু মণ্ডলের ছেলে জামাল হোসেন (৩৫) ও আওরাজের ছেলে বকুল শেখ (৩৫)। গাংনী থানার বামন্দী গ্রামের মুনছারের ছেলে আনছারুল (৩০), রকবুলের ছেলে মতিয়ার (২৭), নওদাপারা গ্রামের মৃত নজিরের ছেলে মিরাজ খান (৫০), শামসুদ্দিনের ছেলে একরামুল (৪৮), সাহেবনগর গ্রামের নিজামুদ্দিনের ছেলে শাহাবুদ্দিন (৫০), বদরের ছেলে রেজাউল (৪৮) এবং মুজিবনগর থানার কোমরপুর গ্রামের শওকত মণ্ডলের ছেলে মুক্তি (৪০) বিশ্বনাথপুর গ্রামের সোলেমানের ছেলে শাহাবুদ্দিন (৪০) এবং ভগিরথপুর গ্রামের ইসলামের ছেলে লিখন (৩২)। মেহেরপুর পুলিশ সুপার হামিদুল আলম জানান, অবরোধে নাশকতার আশঙ্কায় বিএনপি কর্মীদের আটক করা হয়েছে।
ঝিনাইদহ অফিস জানিয়েছে, ঝিনাইদহে নাশকতার অভিযোগে জেলা বিএনপির যুব বিষয়ক সম্পাদকসহ ১০ বিএনপি-জামায়াত নেতা-কর্মীকে আটক করেছে পুলিশ। বুধবার ভোরে জেলার বিভিন্ন উপজেলা থেকে তাদের আটক করা হয়। ঝিনাইদহের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মোহাম্মদ হাসানুজ্জামান জানান, ২০ দলীয় জোটের একটানা অবরোধে নাশকতার আশঙ্কায় রাত থেকে সকাল পর্যন্ত জেলার বিভিন্ন উপজেলায় অভিযান চালায় পুলিশ। অভিযানে ১০ বিএনপি-জামায়াত নেতা-কর্মীকে আটক করা হয়েছে। এর মধ্যে জেলার সদর উপজেলা থেকে জেলা বিএনপির যুব বিষয়ক সম্পাদক এনামুল কবির মুকুল, সরকারি কেসি কলেজ ছাত্রদলের সভাপতি মনিরুজ্জামান মাসুমসহ পাঁচ বিএনপি-জামায়াত, হরিণাকুণ্ডু থেকে এক জামায়াত, শৈলকুপা থেকে দুজন বিএনপি ও মহেশপুর থেকে দুজন বিএনপি-জামায়াত নেতা-কর্মীকে আটক করা হয়। আটকের প্রতিবাদে ঝিনাইদহ জেলা বিএনপির সভাপতি মসিউর রহমান ও সাধারণ সম্পাদক আবদুল মালেকসহ বিএনপি নেতারা তীব্র নিন্দা জানিয়ে অবিলম্বে আটককৃতদের মুক্তির দাবি জানান।
ঝিনাইদহ অফিস আরও জানিয়েছে, ঝিনাইদহের কালীগঞ্জে রেললাইনে অবরোধকারীদের নাশকতামুক্ত ঠেকাতে আনসার সদস্য মোতায়েন করা হয়েছে। বুধবার কালীগঞ্জ উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে কালীগঞ্জ উপজেলা আনছার ভিডিপি কর্মকর্তা ইস্কেন্দার কামাল ও থানার এসআই ইমরান হোসেনের নেতৃত্বে ৭২ জন আনসার সদস্যের একটি টিম গঠন করা হয়েছে। টিমের সদস্যরা বারবাজার রেলস্টেশন থেকে সুন্দরপুর রেলস্টেশন পর্যন্ত প্রায় ২৫ কিলোমিটার রেলপথে নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করবেন। কালীগঞ্জ থানার অফিসার্স ইনচার্জ আনোয়ার হোসেন জানান, সারাদেশে জামায়াত-বিএনপির ডাকা অবরোধে স্থানীয় প্রশাসন আইনশৃঙ্খলা রক্ষা ও রেললাইনে নাশকতামুক্ত ঠেকাতে কালীগঞ্জে আনসার সদস্য মোতায়েন করা হয়েছে। উপজেলা প্রশাসনের দুজন কর্মকর্তার তত্ত্বাবধানে ৭২ সদস্যের আনসার টিম দিনরাত ২৪ ঘণ্টা পাহারার দায়িত্বে থাকবে।