স্টাফ রিপোর্টার: দেশের কল্যাণ ও শান্তি-সমৃদ্ধির পাশাপাশি বিশ্ব মুসলিম উন্মার সুদৃঢ ঐক্য, ভ্রাতৃত্ববোধ ও উন্নতির জন্য মহান আল্লার অশেষ অনুগ্রহ কামনা করে আখেরি মোনাজাতের মধ্যদিয়ে গতকাল রোববার সম্পন্ন হলো তাবলিগ জামাত আয়োজিত ৫০তম বিশ্ব ইজতেমার প্রথম পর্ব। বিশেষ তাত্পর্যপূর্ণ এ মোনাজাতে আত্মশুদ্ধি ও নিজ নিজ গুনা মাফের পাশাপাশি দুনিয়ার সব বালা-মুসিবত থেকে হেফাজত করার জন্য দু হাত তুলে মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের দরবারে বিশেষ রহমত প্রার্থনা করা হয়। অনেকেই এ সময় চোখের পানিতে বুক ভাসান। সর্বশক্তিমান আল্লাহর নিকট নিজেকে আত্নসর্মপর্ণে ব্যাকুল হয়ে পড়েন। ইজতেমা ময়দান ও আশেপাশের এলাকায় পিনপতন নিরবতা নেমে আসে। এক অভূতপূর্ব ভাবাবেগের সৃষ্টি হয়। ইজতেমার আখেরি মোনাজাত পরিচালনা করেন বিশ্ব তাবলিগ জামাতের শীর্ষস্থানীয় মুরব্বি ভারতের হযরত মাওলানা মুহাম্মদ সা’দ। তিনি বিশেষ তাত্পর্যপূর্ণ এ আখেরি মোনাজাত আরবি ও উর্দু ভাষায় পরিচালনা করেন। মোনাজাতে দেশ-বিদেশের প্রায় ৩০ লাখ মানুষ অংশ নিয়েছেন বলে ইজতেমা আয়োজকসহ সংশ্লিষ্ট সূত্রের ধারণা। তবে অবরোধের কারণে এবার গত বছরের চেয়ে মুসল্লির সংখ্যা অনেকটা কম হয়েছে বলে সংশ্লিষ্টারা মনে করছেন। বেলা ১১টা ১৭ মিনিটে শুরু করে ১১টা ৪৮ মিনিট পর্যন্ত ৩১ মিনিট স্থায়ী এ আখেরি মোনাজাত চলাকালে সমগ্র ইজতেমাস্থল ও আশপাশের বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে আমিন আমিন ধ্বনিতে চারপাশ প্রকম্পিত হয়ে ওঠে।
মোনাজাতে অংশ নিতে গতকাল রোববার ভোর থেকে চার দিক থেকে লাখ লাখ মুসল্লি পায়ে হেঁটেই ইজতেমাস্থলের দিকে পৌঁছান। সকাল ৯টার আগেই ইজতেমা মাঠ কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে মুসল্লিরা মাঠের আশে-পাশের রাস্তা, অলি-গলিতে অবস্থান নেন। ইজতেমাস্থলে পৌঁছাতে না পেরে কয়েক লাখ মানুষ আশুলিয়া, কামাড়পাড়া সড়ক, ঢাকা-কালীগঞ্জ সড়ক ও ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে অবস্থান নেন। গতকাল রোববার ভোর থেকেই ফজরের নামাজ ও আখেরি মোনাজাতের জন্য পুরোনো খবরের কাগজ, পাটি, সিমেন্টের বস্তা ও পলিথিন সিট বিছিয়ে বসে পড়েন। এছাড়াও পাশ্ববর্তী বাসা-বাড়ি, কলকারখানা-অফিস, দোকানের ছাঁদে, যানবাহনের ছাঁদে ও তুরাগ নদীতে নৌকায় মুসল্লিরা অবস্থান নেন। যেদিকেই চোখ যায় সে দিকেই দেখা যায় শুধু টুপি-পাঞ্জাবি পরা মানুষের কাফেলা। সবাই অপেক্ষায় আছেন কখন শুরু হবে সেই আখেরি মোনাজাত। ইজতেমাস্থলের চারপাশের ৫-৬ বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে কোথাও তিল ধারণের ঠাঁই ছিলো না। আখেরি মোনাজাতের জন্য রোববার আশেপাশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, কলকারখানাসহ বিভিন্ন অফিস-আদালতে ছিলো ছুটি। কোনো কোনো প্রতিষ্ঠানে ছুটি ঘোষণা না করলেও কর্মকর্তাদের মোনাজাতে অংশ নিতে বাধা ছিলো না। নানা বয়সী ও পেশার মানুষ এমনকি মহিলারাও ভিড় ঠেলে মোনাজাতে অংশ নিতে রোববার সকালেই টঙ্গী এলাকায় পৌঁছেন। বিশ্ব ইজতেমায় আগত লাখ লাখ মুসল্লির সঙ্গে ইজতেমা ময়দানের পূর্ব পাশে শহীদ আহসান উল্লাহ মাষ্টার স্টেডিয়ামে স্থাপিত পুলিশ কন্ট্রোল রুমে বসে আখেরি মোনাজাতে অংশ নেন মুক্তিযুদ্ধ বিষয়কমন্ত্রী অ্যাডভোকেট আ.ক.ম মোজাম্মেল হক এমপি, স্থানীয় সংসদ সদস্য জাহিদ আহসান রাসেল এমপি, জেলা প্রশাসক মো. নূরুল ইসলাম, পুলিশের ঢাকা রেঞ্জের অতিরিক্ত ডিআইজি শফিকুল ইসলাম, পুলিশ সুপার মুহাম্মদ হারুন অর রশীদ পিপিএম প্রমুখ।
শেষ দিনে বয়ানকারী: বিশ্ব ইজতেমার প্রথম পর্বের শেষ দিন রোববার বাদ ফজর থেকে হেদায়েতির বয়ান করেন তাবলিগ জামাতের শীর্ষ মুরব্বি ভারতের হযরত মাওলানা মুহাম্মদ সা’দ। বয়ানের বাংলায় তরজমা করেন বাংলাদেশের মাওলানা ওয়াসিফুল ইসলাম। এশিয়া, ইউরোপ, আফ্রিকা, উত্তর আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়াসহ কমপক্ষে ৯০টি দেশের তাবলিগ জামাতের প্রায় ১০ হাজার বিদেশি মেহমান এবারের ইজতেমায় অংশগ্রহণ করেছেন। এদের মধ্যে ভারত, পাকিস্তান থেকে সর্বোচ্চ সংখ্যক বিদেশি মেহমান আগমন করেন। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের তাবলিগের কাজে বের হওয়ার জন্য এবার ইজতেমা স্থলে প্রথম পর্বে প্রায় সাড়ে তিন হাজার জামাত তৈরি হয়েছে বলে ইজতেমার আয়োজক সূত্রে জানা গেছে। আগামী ১৫-২০ দিনের মধ্যে এসব জামাত বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়বে বলে জানিয়েছে তাবলিগ সূত্র ।
আরো চার মুসল্লির মৃত্যু: গত শনিবার সন্ধ্যা থেকে রোববার পর্যন্ত বিশ্ব ইজতেমা মাঠে আরো চার মুসল্লি মারা গেছেন। এরা হচ্ছেন- চুয়াডাঙ্গা জেলার মৃত রূপচাঁদ সরকারের ছেলে মকবুল হোসেন (৭৫), একই জেলার মোক্তার হোসেনের ছেলে তোয়াজ্জেল হোসেন (৫৯), সিলেটের সামসুদ্দিনের ছেলে সাইদুর রহমান (২০) ও গাজীপুরের কালীগঞ্জের মৃত সাহেব আলীর ছেলে সোবহান (৭০)। এনিয়ে ইজতেমায় আগত মুসল্লিদের মৃতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১০এ।
ভ্রাম্যমান আদালতের জরিমানা: ইজতেমার প্রথম পর্বের শেষ দিনে জেলা প্রশাসন পরিচালিত ভ্রাম্যমাণ আদালত ইজতেমা স্থলের আশপাশ এলাকায় অভিযান চালিয়ে বিশুদ্ধ খাদ্যদ্রব্য আইনে দুটি মামলায় ২৫ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়।
গাজীপুর ও টঙ্গীর সকল কারখানায় ছুটি: বিশ্ব ইজতেমার প্রথম পর্বের আখেরি মোনাজাত উপলক্ষে গাজীপুর ও টঙ্গীর সকল কারখানায় ছুটি ছিলো ফলে এবার এসব কারখানার শ্রমিকদের ইজতেমায় আখেরি মোনাজাতে অংশ নিতে সমস্যা হয়নি।
প্রথম পর্বে সাড়ে ৩ হাজার জামাত তৈরি: বিভিন্ন দেশে তাবলিগের কাজে বের হতে এবার ইজতেমা স্থলে প্রথম পর্বে প্রায় সাড়ে ৩ হাজার জামাত তৈরি হয়েছে বলে জানান ইজতেমা আয়োজক কমিটির মুরুব্বি গিয়াস উদ্দিন। এসব জামাতে কেউ কেউ তিন চিল্লা, এমনকি আজীবন চিল্লার জন্য প্রস্তুত হয়েছেন। আগামী ১৫-২০ দিনে মধ্যে এসব জামাত বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়বে বলে সূত্র জানায়।
মোনাজাতে মহিলাদের অংশগ্রহণ: আখেরি মোনাজাতে অংশ নিতে বিভিন্ন এলাকা থেকে কয়েক হাজার মহিলা মুসল্লিও আগের দিন রাত থেকে ইজতেমা ময়দানের আশেপাশে, বিভিন্ন মিলকারখানা, বাসা-বাড়িতে ও বিভিন্ন দালানের ছাদে বসে আখেরি মোনাজাতে অংশ নেন।
মোনাজাত শেষে যানজট ও জনজট: আখেরি মোনাজাত শেষ হওয়ার পরপরই বিভিন্ন স্থান থেকে আশা মানুষ নিজ গন্তব্যে পৌঁছার চেষ্টা করে। আগে যাওয়ার জন্য মুসল্লিরা তাড়াহুড়া করতে শুরু করে। এতে টঙ্গীর আশপাশের সড়ক-মহাসড়কগুলোতে সৃষ্টি হয় দীর্ঘ জনজট ও যানজট। এতে টঙ্গীর কামারপাড়া সড়ক, ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক, টঙ্গী- কালীগঞ্জ সড়কের আহসান উল্লাহ মাস্টার উড়াল সেতু ও আশপাশের সড়ক-মহাসড়ক এবং সংযোগ সড়কগুলোতে সৃষ্টি হয় দীর্ঘ জনজট ও যানজট। ফলে গাজীপুরের জেলা প্রশাসকসহ প্রশাসনের কর্মকর্তাদের গাড়ি দীর্ঘ যানজটের কবলে পড়ে।
মোবাইল নেটওয়ার্ক সমস্যা: গতকাল রোববার ইজতেমা ময়দান ও টঙ্গী থেকে কোনো মোবাইলেই দেশের বিভিন্ন স্থানে নেটওর্য়াক যোগাযোগ সম্ভব হয়নি। মাঝে মধ্যে লাইন পেলেও মুহূর্তেই কেটে যাচ্ছিলো। মোবাইলফোন কোম্পানিগুলো নেটওর্য়াক সুবিধা দিতে ইজতেমা উপলক্ষে ইজতেমার আশপাশ এলাকায় অতিরিক্ত মোবাইল টাউয়ার সংযোগ করেও এ সমস্যার পুরো সমাধান দিতে পারেনি।
দ্বিতীয় পর্বে যে সব জেলা অংশ নেবে: বিশ্ব ইজতেমার দ্বিতীয় পর্বে ৩৩টি জেলা ধর্মপ্রাণ মুসল্লিরা ৪০টি খিত্তায় অংশ নেবেন। জেলা ও খিত্তাগুলো হচ্ছে- ১ ও ২ নং খিত্তায় নারায়ণগঞ্জ জেলা, ৩ ও ৪ নং খিত্তায় ঢাকা জেলা, ৫নং খিত্তায় কক্সবাজার জেলা, ৬ নং খিত্তায় মানিকগঞ্জ জেলা, ৭ নং খিত্তায় পিরোজপুর জেলা, ৮ নং খিত্তায় পটুয়াখালী জেলা, ৯ নং খিত্তায় টাঙ্গাইল জেলা, ১০ নং খিত্তায় জামালপুর জেলা, ১১ নং খিত্তায় বরিশাল জেলা, ১২ নং খিত্তায় নেত্রকোনা জেলা, ১৩ নং খিত্তায় কুমিল্লা জেলা, ১৪ নং খিত্তায় মেহেরপুর জেলা, ১৫ ঝিনাইদহ, ১৬, ১৭ ও ১৮ নং খিত্তায় ময়মনসিংহ জেলা, ১৯ নং খিত্তায় লক্ষ্মীপুর জেলা, ২০ নং খিত্তায় ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা, ২১ নং খিত্তায় কুড়িগ্রাম জেলা, ২২ নং খিত্তায় বগুড়া জেলা, ২৩ নং খিত্তায় পঞ্চগড় জেলা, ২৪ নং খিত্তায় চাপাই নবাবগঞ্জ জেলা, ২৫ নং খিত্তায় নীলফামারী জেলা, ২৬ নং খিত্তায় নোয়াখালী জেলা, ২৭ নং খিত্তায় ঠাকুরগাঁও জেলা, ২৮ নং খিত্তায় পাবনা জেলা, ২৯ নং খিত্তায় নওগাঁ জেলা, ৩০ ও ৩১ নং খিত্তায় মুন্সিগঞ্জ জেলা, ৩২ নং খিত্তায় মাদারীপুর জেলা, ৩৩ নং খিত্তায় গোপালগঞ্জ জেলা, ৩৪ নং খিত্তায় সাতক্ষীরা জেলা, ৩৫ নং খিত্তায় মাগুরা জেলা, ৩৬ নং খিত্তায় কুষ্টিয়া জেলা, ৩৭ নং খিত্তায় সুনামগঞ্জ জেলা ও ৩৮ নং খিত্তা, খুলনা জেলা ও ৩৯ নং খিত্তায় মৌলভীবাজার জেলার জন্য নির্ধারণ করা রয়েছে।
ইজতেমার আয়োজক কমিটির মুরুব্বি মো. গিয়াস উদ্দিন জানান, প্রথম পর্বের ইজতেমা শেষ হওয়ার পর ময়দানের সকল আবর্জনা-নোংরা পরিষ্কার করার উদ্যোগে নেয়া হবে। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার জন্য ৪ দিন বিরতি দিয়ে আগামী ১৬ জানুয়ারি থেকে ৫০তম বিশ্ব ইজতেমার দ্বিতীয় পর্বের আনুষ্ঠানিকতা শুরু হবে। ১৮ জানুয়ারি দ্বিতীয় পর্বের বিশ্ব ইজতেমার আখেরি মোনাজাতের মধ্যদিয়ে সম্পন্ন হবে ৫০তম ইজতেমার সকল পর্ব।