রাজধানীতে ট্রেন-কাভার্ডভ্যান সংঘর্ষে নিহত ৬

স্টাফ রিপোর্টার: রাজধানীর কমলাপুর কনটেইনার ডিপোতে স্টেশনমুখি একটি ট্রেনের সাথে কাভার্ডভ্যানের সংঘর্ষে ছয়জন প্রাণ হারিয়েছেন এবং আহত হয়েছেন ১০ জন। এ মর্মান্তিক দুর্ঘটনা ঘটে গতকাল সোমবার দুপুর সোয়া ১টায়। ট্রেনটি নারায়ণগঞ্জ থেকে আসছিলো। সংকেত অমান্য করে রেললাইন অতিক্রম করে আইসিডির এক পাশ থেকে অন্য পাশে যাওয়ার চেষ্টা করছিলো কাভার্ডভ্যানটি। আইসিডির পশ্চিম পাশের দেয়ালে ট্রেনের ধাক্কা খেয়ে কাভার্ডভ্যানটি সজোরে আঘাত হানে প্রথম কামরায়।

প্রচণ্ড আঘাতে ঘটনাস্থলেই দুজনের মৃত্যু হয়। হাসপাতালে নেয়ার পর মারা যান আরও চারজন। আহত অন্তত ১০ জন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন।
রেলপথমন্ত্রী মুজিবুল হক ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে সাংবাদিকদের বলেন, কাভার্ডভ্যান চালক নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলায় অথবা তার গাফিলতির ফলে ট্রেনের সাথে সংঘর্ষের
ঘটনা ঘটে। ঘটনাটি তদন্তে রেলওয়ের বিভাগীয় পরিবহন কর্মকর্তা নাজমুল ইসলামকে প্রধান করে তিন সদস্যের কমিটি করা হয়েছে।

নিহতদের মধ্যে চারজন হলেন- মজিবর রহমান (৬০), আলমগীর (৫০), ইসমাইল হোসেন (৪৫) ও নাঈম ইসলাম (১৫)। বাকি দুজনের পরিচয় পাওয়া যায়নি। এ ছাড়া আহতদের মধ্যে রয়েছেন_ আনসার সদস্য মিজানুর রহমান (২৫), মো. বাবুল (৪০), নাসির (২৫), মোস্তফা প্রধান (২৫), বিল্লাল হোসেন (২৬), কালাম (২৭), জাবেদ (৪৫), হারুন (৪০), সুমন (২৬) ও জিন্না (২৫)। আনসার মিজানুর রহমান ঘটনাস্থলে দায়িত্ব পালন করছিলেন। অন্য আহতরা ট্রেনের যাত্রী ছিলেন বলে জানা গেছে।

প্রত্যক্ষদর্শী আনসার সদস্য আবদুল হান্নান জানান, দুপুর ১২টা ৫০ মিনিটে নারায়ণগঞ্জ থেকে ছেড়ে আসা ২১৯ নম্বর লোকাল ট্রেনটি কমলাপুর স্টেশনে ঢুকছিলো। তখন আইসিডির ফটকে তিনি ও মিজানুর রহমান দায়িত্ব পালন করছিলেন। ট্রেন আসতে দেখে তিনি কাভার্ডভ্যানটিকে থামার সংকেত দেন। চালক নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে রেললাইন পার হয়ে ডিপোর পশ্চিম পাশে যাওয়ার চেষ্টা করে। এ সময় ট্রেনটি গিয়ে কাভার্ডভ্যানকে ধাক্কা দিলে দুর্ঘটনা ঘটে।
সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, ট্রেনটির ইঞ্জিন আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত কামরাটির একাংশের দেয়াল পুরোপুরি ভেঙে গেছে। দুমড়ে-মুচড়ে রয়েছে কাভার্ডভ্যানটির সামনের ও মাঝের অংশ। ভ্যানের পেছনের চাকাগুলো বিচ্ছিন্ন অবস্থায় পড়ে রয়েছে। রেললাইনে পড়ে আছে ছোপ ছোপ রক্ত। রেললাইন ও রেলের টুলবক্স ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

ট্রেনের যাত্রী জাকির হোসেন জানান, দুপুর সাড়ে ১২টায় তিনি নারায়ণগঞ্জের পাগলা স্টেশনে ট্রেনে ওঠেন। কামরায় অন্তত ৮০ যাত্রী ছিলেন। ট্রেনটি কমলাপুরে ঢোকার মুখে হঠাত প্রচণ্ড ঝাঁকুনি অনুভব করেন। কী হয়েছে দেখার জন্য তিনি দ্রুত জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে কামরার সাথে কাভার্ডভ্যানকে লেগে থাকতে দেখেন। তখনই তিনি জানালা দিয়ে লাফিয়ে পড়েন।
প্রত্যক্ষদর্শী দোকানি মুক্তা ও আইসিডির শ্রমিক আসলাম জানান, আইসিডির স্টিলের তৈরি ফটক সাধারণত লাগানো থাকে। ট্রেন এলে গেটম্যান তা খুলে দেন। ফটকগুলোতে আনসার সদস্যরা দায়িত্ব পালন করেন। দুপুরে দুর্ঘটনার আগে কাভার্ডভ্যানের চালককে রেললাইন পার না হওয়ার সংকেত দেয়া হয়। চালক না শুনে এগিয়ে গেলে সংঘর্ষ ঘটে। অন্তত দুজনের শরীর ছিন্নভিন্ন হয়ে ঘটনাস্থলেই তাদের মৃত্যু হয়। ট্রেনের ছাদেও অনেক যাত্রী ছিলেন। তারাও ছিটকে পড়ে আহত হন।
হাসপাতালে চিকিসাধীন ১০: ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) জরুরি বিভাগের আবাসিক সার্জন রিয়াজ মোর্শেদ সমকালকে জানান, ঘটনাস্থল থেকে গুরুতর আহত অবস্থায় ১৪ জনকে উদ্ধার করে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। তাদের মধ্যে চারজন চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। তাদের মধ্যে কয়েকজনের অবস্থা গুরুতর বলে জানান রিয়াজ মোর্শেদ।

নিহতদের পরিচয়: দুর্ঘটনায় নিহত নাইমের বাবার নাম ইউনুস আলী। গ্রামের বাড়ি বরিশালের বাকেরগঞ্জের খোদাবক্সকাঠি। সে স্থানীয় নেছারিয়া মাদরাসার নবম শ্রেণির ছাত্র ছিলো। বিকেলে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নাইমের লাশ শনাক্ত করেন তার খালু আবদুর রশিদ। তিনি জানান, নাঈম ১০ দিন আগে ঢাকায় বেড়াতে আসে। তিন দিন আগে সে নারায়ণগঞ্জে খালাতো ভাই মাসুদের বাসায় যায়। সেখান থেকে ফেরার পথে এ দুর্ঘটনা ঘটে। চিকিৎসাধীন অবস্থায় ৫টার দিকে মারা যান আলমগীর। তার বাবার নাম মিজানুর রহমান। গ্রামের বাড়ি কুমিল্লার চন্দনপুর। ঢাকায় তিনি দক্ষিণ কেরানীগঞ্জের চুনকুটিয়ায় বসবাস করতেন। গতকাল সন্ধ্যায় তার স্ত্রী পারভীন ঢাকা মেডিকেল কলেজ মর্গে লাশ শনাক্ত করেন। ইসমাইল হোসেন পেশায় লেপ-তোশক তৈরি দোকানের কর্মচারী। তার বাবা আবদুল জলিল। বাসা ফতুল্লা নারায়ণগঞ্জ। স্ত্রী সেলিনা বেগম গতকাল সন্ধ্যায় ঢামেক মর্গে লাশ শনাক্ত করেন। নিহত অজ্ঞাতপরিচয় দুজনের মধ্যে একজন নারী। তার বয়স আনুমানিক ৩০ বছর।

তদন্ত কমিটি: দুর্ঘটনার কারণ অনুসন্ধানে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছে রেলপথ মন্ত্রণালয়। কমিটিকে আগামী তিন দিনের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে।
বিকেলে ঢামেক হাসপাতালে আহতদের দেখতে গিয়ে রেলমন্ত্রী জানান, নিহতদের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দেয়া হবে। এ সময় মন্ত্রী আহত পাঁচজনকে চিকিৎসার জন্য ২০ হাজার টাকা করে দেন। তবে অন্য আহতরা অস্ত্রোপচার কক্ষে থাকায় তাৎক্ষণিক কোনো সাহায্য পাননি। তাদের পরে অর্থসহায়তা দেয়া হবে বলে জানিয়েছেন মন্ত্রী। এমপি সানজিদা খানমও আহতদের চিকিৎসার খোঁজ-খবর নিতে হাসপাতালে যান। এদিকে আহত তিনজনকে রাতে উন্নত চিকিৎসার জন্য অন্য হাসপাতালে নিয়ে যান স্বজনরা।

চালককে আসামি করে মামলা: ঢাকা রেলপথ থানার ওসি আবদুল মজিদ জানান, ট্রেন-কাভার্ডভ্যান সংঘর্ষে হতাহতের ঘটনায় রেলওয়ের উপসহকারী প্রকৌশলী আবদুল মতিন মণ্ডল বাদী হয়ে মামলা করেছেন। এতে কাভার্ডভ্যানের চালককে আসামি করা হয়েছে। তবে তার নাম উল্লেখ করা হয়নি। দুর্ঘটনাকবলিত কাভার্ডভ্যানটি এসআর কার্গো সার্ভিসেস লিমিটেডের বলে জানা গেছে।