জিহাদ প্রাণপণ চেষ্টা করেছিলো বাঁচতে

মৃত্যু হয় পানিতে ডুবে : নাসিরের ওপর নির্যাতনকারী পুলিশের শাস্তি দাবি

 

স্টাফ রিপোর্টার: শাহজাহানপুর রেলওয়ে কলোনিতে ওয়াসার পরিত্যক্ত পাইপের ভেতরে পড়ার পর জিহাদ (৪) বাঁচার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করেছিলো। তবে তার সব চেষ্টাই ব্যর্থ হয়। শেষে পানিতে ডুবে মারা যায় সে। গতকাল রোববার সকালে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালমর্গে ময়নাতদন্তে চিকিত্সকরা জিহাদের হাত, মাথা ও দেহের আলামত দেখে এমন মতামত দেন। এদিকে ময়নাতদন্ত শেষে জিহাদের লাশ শরীয়তপুর জেলার গোসাইরহাট উপজেলার পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়। হাজার হাজার মানুষ চোখের জলে জিহাদকে শেষ বিদায় জানান। অন্যদিকে শাহাজাহানপুর থানায় নিয়ে জিহাদের পিতা নাসির উদ্দিনকে জিজ্ঞাসাবাদের নামে শারীরিক নির্যাতনের সাথে জড়িত পুলিশ কর্মকর্তাদের শাস্তির দাবি জানিয়েছে এলাকাবাসী।

Jiad-3

ঢাকা মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. হাবিবুজ্জামানের নেতৃত্বে তিন সদস্যের মেডিক্যাল বোর্ড জিহাদের ময়নাতদন্ত সম্পন্ন করেন। ময়নাতদন্তকালে চিকিত্সকরা জিহাদ দু হাত দিয়ে পাইপ খামচানোর আলামত দেখতে পান। জিহাদের দু হাতের নখের ভেতরে মাটি পাওয়া যায় এবং হাত ছিলো কর্দমাক্ত। সে বাঁচার জন্য ওপরে ওঠার চেষ্টাকালে মাথার সামনে ও পেছনে আঘাত পায়। ময়নাতদন্তকালে চিকিত্সকরা জিহাদের মাথায় সেই ধরনের আঘাতের আলামত পান। সব চেষ্টা ব্যর্থ হয়ে পাইপ দিয়ে নিচে পড়ে যায় জিহাদ। পাইপের নিচে পানি ছিলো। পেটের ভেতরে পানি এবং শরীর পানিতে ডুবে যাওয়ার আলামতও চিকিত্সকরা ময়নাতদন্তকালে দেখতে পান। চিকিত্সকরা জানান, মাথার আঘাতে জিহাদের মৃত্যু হয়নি। পাইপে পড়ার ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যে পানিতে ডুবে শ্বাসরোধে জিহাদের মৃত্যু হয়। জিহাদের দেহ পুরো সময় পানিতে ডুবে থাকায় পচন ধরেনি বলে বোর্ডের প্রধান জানান।

ময়নাতদন্তকারী টিমের অপর দু সদস্য হচ্ছেন ফরেনসিক বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. অখম শফিউজ্জামান ও প্রভাষক ডা. প্রদীপ। জিহাদের শরীরের চামড়া ছিলে যাওয়া প্রসঙ্গে চিকিত্সকরা জানান, জিহাদকে টেনে ওঠানোর সময় চামড়া ছিলে গেছে। চিকিত্সকরা যখন ময়নাতদন্ত করছিলেন তখন হাসপাতালমর্গে জিহাদের পিতা নাসির উদ্দিন ও মা খাদিজা বেগম উপস্থিত ছিলেন। ময়নাতদন্ত শেষে তার লাশ কফিনে নেয়া হয়। ওই সময় জিহাদের বাবা-মা ও ভাই-বোনরা কফিন ধরে কান্নায় ভেঙে পড়ে। তখন মর্গ এলাকায় এক হৃদয়বিদারক দৃশ্যের সৃষ্টি হয়। মর্গে বিভিন্ন এলাকা থেকে কয়েক শত লোক জিহাদের লাশ এক নজর দেখার জন্য উপস্থিত ছিলেন। ওই সময় কান্না বিজড়িত কণ্ঠে একদল ব্যক্তি বলেন, পুত্রহারা নাসির উদ্দিনকে থানায় নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের নামে যে সব কর্মকর্তারা শারীরিকভাবে নির্যাতন করেছেন তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে। ময়নাতদন্ত শেষে জিহাদের মামা মনির হোসেন ভাগ্নের লাশ গ্রহণ করেন।

জিহাদের পিতা নাসির উদ্দিনকে থানায় নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের নামে নির্যাতন প্রসঙ্গে পুলিশের আইজি হাসান মাহমুদ খন্দকার ও মহানগর পুলিশ কমিশনার বেনজির আহমদ বলেন, থানায় নিয়ে নাসির উদ্দিনকে কোনো ধরনের নির্যাতন করা হয়নি। গভীর রাত পর্যন্ত পাইপের ভেতরে তার কোনো সন্ধান না পাওয়ায় বিষয়টি সম্পর্কে খোঁজখবর নেয়ার জন্য তার বাবাকে থানায় নিয়ে যাওয়া হয়। এটা তদন্তের একটি প্রাথমিক কৌশল বলে তারা জানান। যেকোনো ঘটনা ঘটলে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারকেই আগে তথ্যের জন্য পুলিশ জিজ্ঞাসাবাদ করে। ঠিক একই ঘটনা জিহাদের বাবার বেলায় ঘটেছে বলে দু শীর্ষ পুলিশ কর্মকর্তা জানান। তবে কেউ যদি তাকে নির্যাতন করে থাকে, তাহলে তদন্ত করে দায়ী ব্যক্তিদের ব্যাপারে ব্যবস্থা নেয়া হবে।

শিশু জিহাদের মরদেহ আসবে এমন খবর পেয়ে কয়েক হাজার লোক সমবেত হয় জিহাদের গ্রামের বাড়ি শরীয়তপুরের গোসাইরহাট উপজেলার নাগেরপাড়ায়। নাগেরপাড়া বহুমুখি উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে জিহাদের নামাজে জানাজা অনুষ্ঠিত হবে এ খবর আগেই প্রচার করা হয় মাইকে। নাগেরপাড়া ও আশপাশের বিভিন্ন গ্রামের মানুষ জিহাদের বাড়িতে ছুটে আসে।

বিকেল সাড়ে ৫টার দিকে জিহাদের মরদেহ বহনকারী গাড়িটি নাগেরপাড়া উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে পৌঁছায়। যাদের অসতর্কতায় জিহাদের করুণ মৃত্যু হয়েছে তাদের শাস্তির দাবিতে অনেক মানুষ বিক্ষোভ করে। বিকেল ৫টার পর জিহাদের নামাজে জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার দিকে পারিবারিক কবরস্থানে তাকে দাফন করা হয়। এর আগে বিকাল সাড়ে ৪টার দিকে ডামুড্যা উপজেলার শীতলকাঠি গ্রামে তার নানা বাড়িতে প্রথম নামাজে জানাজা অনুষ্ঠিত হয়।

শরীয়তপুরের জেলা প্রশাসক রাম চন্দ্র দাস দাফন কাফনের খরচ বাবদ জিহাদের পরিবারকে ২০ হাজার টাকা প্রদান করেছেন। জিহাদের বাবা নাছির ফকির ১২ বছর আগে শরীয়তপুরের গোসাইরহাট উপজেলার নাগেরপাড়া গ্রাম ছেড়ে কাজের সন্ধানে ঢাকায় যান। গতকাল দুপুরে জিহাদের গ্রামের বাড়ি নাগেরপাড়ায় গিয়ে দেখা যায় তার দাদা আজিজ ফকির, চাচা রতন ফকির, ফুফু সুফিয়া বেগম বিলাপ করছেন। গ্রামের মানুষ তাদের সান্ত্বনা দিচ্ছেন।

শিশু জিহাদের বাবার দায়ের করা মামলায় অভিযুক্ত রেলওয়ের সিনিয়র উপসহকারী প্রকৌশলী জাহাঙ্গীর  আলম ও ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান জেএসআর’র মালিক আব্দুস সালাম গতকাল রোববার পর্যন্ত গ্রেফতার হননি। এদিকে গতকালও দিনভর ঘটনাস্থলে (শাহজাহানপুর রেল কলোনি মৈত্রীসঙ্ঘ মাঠের কাছে) ভিড় করেছেন বহু উত্সুক মানুষ। সেখানে মোয়াতেন করা হয়েছে অতিরিক্ত পুলিশ। পরিত্যক্ত নলকূপের পাইপে পড়ে শিশু জিহাদের মৃত্যুতে সংশ্লিষ্ট প্রকল্পের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের মালিক আব্দুস সালাম ও উপসহকারী প্রকৌশলী জাহাঙ্গীর আলমকে আসামি করে শনিবার রাতে শাহজাহানপুর থানায় মামলা করেন জিহাদের বাবা নাসির উদ্দিন ফকির। মামলা নম্বর-২১। ফৌজদারি আইনের ৩০৪/ক ধারায় করা এ মামলায় আসামিদের বিরুদ্ধে দায়িত্বে অবেহেলার কারণে জিহাদের মৃত্যু হয়েছে বলে অভিযোগ করা হয়েছে।