জিহাদ তুমি ক্ষমা করো আমাদের

দায়িত্বশীলরা ২৩ ঘণ্টায় পারলেন না, গুটি কয়েক সাধারণ মানুষ পারলো মাত্র ১৩ মিনেটে। এরপরও কি বলতে হবে, রাষ্ট্র যাদেরকে উদ্ধার তৎপরতা চালানোর কাজে নিযুক্ত রেখেছে তারা যোগ্য! দীর্ঘসময় ধরে উদ্ধার অভিযানের মধ্যদিয়ে অসহায়ত্ব তো ফুটে উঠেছেই, উল্টো গুজব বলেও বিভ্রান্ত ছড়ানো হয়েছে। শিশুসন্তান সরকারেরই এক বিভাগের অরক্ষিত পাইপে পড়েছে, তাকে উদ্ধার করতে না পারার কষ্টে যখন পিতা অস্থির, তখন তাকে উল্টো আটকে রাখা হয়। যারা উদ্ধারে সফলতার বদলে গুজব ছড়িয়ে চরম অনিশ্চয়তার মাঝে পড়া পিতাকে উল্টো হয়রানি করার কাজে মত্ত ছিলেন বৈদ্যুতিন গণমাধ্যমের বদৌলতে তাদের চেহারা দেশবাসী দেখেছে। সরকারের দায়িত্বশীলরা যখন উদ্ধার তৎপরতা স্থগিত ঘোষণা করে স্থানটি ছেড়ে দিলেন, তখন স্বল্প খরচে দেশে তৈরি যন্ত্রপাতি দিয়ে যেন চোখের পলকেই জিহাদের নিথর দেহ পাইপের গভীর থেকে তুলে আনলেন গুটি কয়েক সাধারণ মানুষ। এরপরও কি সরকারের পদে অধিষ্ঠত সংশ্লিষ্ট কর্তারা লজ্জিত হয়েছেন? তেমন কিছু উপলব্ধি বোধ থাকলে নিশ্চয় ব্যর্থতার দায় নিয়ে দু একজনের স্বেচ্ছায় পদত্যাগের খবর সংবাদমাধ্যমে পাওয়া যেতো।

রাজধানীর শাহজাহানপুর রেলওয়ে কলোনির মৈত্রী সঙ্ঘের মাঠের কাছে রেলওয়ের পানিপাম্পের পাইপটি ছিলো অরক্ষিত। গত বুধবার এক শিশু পাইপে পড়লেও অল্পের জন্য রক্ষা পায়। একদিন পরই শুক্রবার বিকেলে খেলতে গিয়ে শিশু জিহাদ পড়ে যায় পাইপের গভীরে। বিষয়টি জানাজানি হতেই উৎসুক জনতার ভিড় জমে। বৈদ্যুতিন গণমাধ্যমের বহু ক্যামেরা নিয়ে দলে দলে পৌঁছান সংবাদকর্মীরা। খবর পেয়ে উদ্ধার তৎপরতা শুরু করেন ফায়ার স্টেশন ও সিভিল ডিফেন্সের সদস্যরা। বৈদ্যুতিন গণমাধ্যমের বদৌলতে দেশবাসী উদ্ধার অভিযান প্রত্যক্ষ করে। কোটি কোটি মানুষ জিহাদকে জীবিত উদ্ধার কামনায় দোয়া করতে থাকে। দীর্ঘসময় ধরে উদ্ধার অভিযানে ফুটে ওঠে আমাদের অসহায়ত্ব। আধুনিক যন্ত্রপাতির অপ্রতুলতাই শুধু নয়, অদক্ষতার বিষয়টিও বিরক্তের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। ৭/৮ ঘণ্টার মাথায় পাইপে নামানো হয় ক্যামেরা। ওয়াসার ক্যামেরায় পাওয়া দৃশ্য দেখে দায়িত্বশীল কর্তাদের কয়েকজন ঘটনাকে গুজব বলে দাবি করতে থাকেন। স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীও বলেন, পাইপে শিশুর অস্তিত্ব নেই। এ মন্তব্য করলেও অবশ্য তিনি উদ্ধার তৎপরতা অব্যাহত রাখার নির্দেশনা দেন। সময় গড়ানোর সাথে সাথে পাইপে শিশু পড়ার ঘটনাটি বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দোলাচলে পড়ে। ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের সদস্যদের পূর্বের অর্জিত সুনামে ভাটা পড়তে থাকে। উদ্ধার তৎপরতায় অংশগ্রহণকারীদেরই একেক সময় একেক তথ্য প্রদানে দানা বাধা প্রশ্ন দেশবাসীকে ক্ষতবিক্ষত করতে থাকে। শিশুর পিতাকেও আটক করা হয়। ঘটনার ২৩ ঘণ্টার মাথায় উদ্ধার তৎপরতা আনুষ্ঠানিকভাবে বন্ধ ঘোষণার পরই স্থানীয় কয়েকজন তাদের মেধায় সামান্য কিছু অর্থ ব্যয়ে তৈরি করা দেশি যন্ত্র দিয়ে উদ্ধার করেন শিশু জিহাদকে। তবে জীবিত উদ্ধার করতে পারেননি। এরপরও সান্ত্বনা, দেহটা তো উদ্ধার হয়েছে। তা না হলে শিশু জিহাদের পিতাকে কতোটা হয়রানির শিকার হতে হতো, স্থানীয় প্রত্যক্ষদর্শীদের মিথ্যা প্ররোচনাকারী হিসেবেও অভিযুক্ত করা হতো। এসব হয়রানি থেকে রক্ষা পাওয়ার পাশাপাশি উদ্ধার কাজে অংশ নেয়া সরকারি পদস্থ কর্তাদের দক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠা যেমন সঙ্গত, তেমনই এ ঘটনাকে গুজব বলে আড়ালের অপচেষ্টা চালানোদেরও বিচারের মুখোমুখি করার দাবি রাখে।

জিহাদ তুমি ক্ষমা করো আমাদের। আমরা তোমাকে জীবিত উদ্ধার করতে পারিনি। আবার কবে তোমার মতো কাকে হারাতে হবে তা ভেবে শরীর শিউরে উঠলেও পরিবেশ নিরাপদ করার দায়িত্বে নিয়োজিতরা দায়িত্বশীল হবেন কি-না তাও জানি না। ‘এ পৃথিবী একবার পায় তারে, পায় নাকো আর’ জীবনানন্দ দাসের লেখা ‘শঙ্খমালা’ নামের কবিতার শেষ লাইন এটি। কবিতার লাইনটির মতোই শিশু জিহাদকে একবার পেয়েছে এ পৃথিবী। এ পৃথিবী আর কখনোই পাবে না তাকে। তার এই মৃত্যু চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলো এ সমাজের জীর্ণতাকে। আরও কতো কতো মৃত্যুকূপ জাল বিছিয়ে রয়েছে রাজধানীসহ সারাদেশে সেই ভাবনাই সামনে এনেছে প্রবলভাবে। ছাড়পত্র কবিতায় সুকান্ত ভট্টাচার্য লিখেছিলেন, ‘প্রাণপণে পৃথিবীর সরাব জঞ্জাল/এ বিশ্বকে এ-শিশুর বাসযোগ্য করে যাবো আমি/নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার।’ শিশুদের জন্য নিরাপদ পৃথিবী গড়ার অঙ্গীকার কী কোনোদিনও পূরণ হবে না? যে যেখানেই আছি, আমাদের সকলকেই নিজ নিজ ক্ষেত্রে নিজ নিজ অবস্থানে থেকে দায়িত্ব পালনে আন্তরিক হলে অবশ্যই পূরণ হবে সুকান্তের অঙ্গীকার। হারাতে হবে না আর কোনো জিহাদকে। একই সাথে দেশের সিভিল ডিফেন্সকে আধুনিকায়নে সরকারের আন্তরিক হতে হবে। অদক্ষদের দক্ষতা বৃদ্ধির বাস্তবমুখি পদক্ষেপ গ্রহণ জরুরি।