স্ত্রীর ঝিয়ের কাজের বেতনের টাকায় সংসার চলে জীবননগরের উথলীর অসহায় মুক্তিযোন্ধা নজরুল ইসলামের

সালাউদ্দীন কাজল: জীবননগর উপজেলার উথলী গ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা নজরুইল ইসলাম জুড়োনের বয়স ৭১ বছর। বয়সের ভারে ন্যুয়ে হয়ে পড়া নজরুল ইসলাম জুড়োন দু ছেলে ও স্ত্রীকে নিয়ে চারজন অন্যের জমিতে ছোট্ট একটি দোচালা ঘরে জীবনযুদ্ধের সংসারে কোনো রকম বেঁচে আছেন। অর্থের অভাবে অষ্টম শ্রেণির পর আর লেখাপড়া করাতে পারেননি বড় ছেলে মামুনকে (১৮)। নিজের জমিজমা বলতে কিছুই নেই। এ কারণে এতোদিন তিনি পরের জমিতে দিনমজুরের কাজ করেছেন। মজুরের কাজ চললে পেটে ভাত পড়তো, না হলে উপস থকতে হতো। গত ২০ বছর ধরে এভাবেই খেয়ে না খেয়েই কেটেছে তার জীবন। এরই মধ্যে ৭ বছর আগে আখের জমিতে মজুরের কাজ করার সময় তার ডান চোখে আঘাত লাগে। অভাবের সংসারে ওষুধ খেতে না পারায় ওই চোখটি একেবারে অন্ধ হয়ে গেছে। এছাড়া অর্ধাহারে-অনাহারে থাকার কারণে তার শরীরে নানা অসুখ বাসা বেঁধেছে এবং অসুস্থতা লেগেই আছে। ফলে তিনি এখন আর মজুরের কাজ করতে পারেন না। প্রতি মাসে তিনি মুক্তিযোদ্ধার যে সম্মানিভাতা পান তা দিয়ে ওষুধ কিনতেই টাকা শেষ হয়ে যায়। এ কারণে তার স্ত্রী সাজেদা বেগম অন্যের বাড়িতে ঝিয়ের কাজ করে খাবার জোগাড় করেন। ঝিয়ের কাজ করে যা পান তা দিয়ে দু বেলার খাবারও ঠিকমতো জোটে না।

কথা হয় মুক্তিযোদ্ধা নজরুল ইসলাম জুড়োনের সাথে। তিনি বলেন, যখন তিনি যুদ্ধে গিয়েছিলেন তখন সে ২৮ বছরের টগবগে যুবক। পাকহানাদার বাহিনীদের আক্রমণের কারণে গোটা দেশ তখন উত্তাল। চারদিকে চলছে জ্বালাও-পোড়াও। পিতা না থাকায় যুদ্ধে যাওয়ার অনুমতি চেয়েছিলেন মাতা নিছারন বিবির কাছে। তিনি পুত্রকে ছাড়তে রাজি হয়নি। কিন্তু সব বাধা উপেক্ষা করেই দেশমাতৃকাকে রক্ষার জন্য তিনি চোখের পানি মুছতে মুছতে সীমান্ত পেরিয়ে হেঁটেই চলে যান ভারতে। গিয়ে ওঠেন মাঝদিয়া ক্যাম্পে। সেখানে ২৫ দিন প্রশিক্ষণ নিয়ে চলে যান চাপড়া ক্যাম্পে। সেখানে ১৫ দিন প্রশিক্ষণের পর যুদ্ধের ওপর প্রশিক্ষণের জন্য চলে যান কুচবিহার ক্যাম্পে। সেখানে ১৫ দিনের প্রশিক্ষণ নিয়ে মুক্তিযোদ্ধা আমজেদ, নাজমুল হক শান্তি, আব্দুল হান্নান ফাকি, মাহমুদ, আবুল হাসেম ও মির্জা সুলতান রাজাসহ অন্যান্য সহযোদ্ধার সাথে হানাদার মোকাবেলার প্রস্তুতি শুরু করেন। এরপর তিনি দেশ স্বাধীনের জন্য নিজের জীবন উৎসর্গ করে জীবননগর উপজেলার ধোপাখালী গ্রামে আক্রমণ করে হানাদারদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। সেই থেকে শুরু হয় তার দেশ স্বাধীনের যুদ্ধ। এভাবে সে দিনের পর দিন যুদ্ধ করেন। ৪ ডিসেম্বর ১৯৭১ সাল। হানাদারমুক্ত হয় জীবননগর। বীরের বেশে নজরুল ইসলাম ফিরে আসেন নিজ বাড়িতে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর সরকারের আহ্বানে অস্ত্র জমা দিয়ে মিশে যান সাধারণ মানুষের কাতারে। বিয়ে করে সংসারি হন। এরপর শুরু হয় দরিদ্র নজরুল ইসলামের জীবন যুদ্ধ। পরিবারের খরচ চালাতে কোনো উপায় না পেয়ে দিনমজুরের কাজ শুরু করেন। মজুরের টাকায় পরিবারের ব্যয় নির্বাহ করতে না পেরে সামান্য সম্বল ভিটেটুকু বিক্রি করে আশ্রয় নেন অন্যের জমিতে। একটি মাত্র দোচালা ঘরে এখন পুরো পরিবারের বাস। অতিরিক্ত কায়িক পরিশ্রম ও অপুষ্টির কারণে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন তিনি। স্ত্রী সাজেদা বেগম অন্যের বাড়িতে ঝিয়ের কাজ করেন। বর্তমানে খেয়ে না খেয়ে কাটছে তাদের দিন।