অবমাননা : মিজানুর ও মতিউর রহমানকে ফের তলব

স্টাফ রিপোর্টার: প্রধান বিচারপতি নিয়োগ নিয়ে এক নিবন্ধের কারণে আদালত অবমাননার রুল জারি করে প্রথম আলোর সম্পাদক ও প্রকাশক মতিউর রহমান এবং যুগ্ম সম্পাদক মিজানুর রহমান খানকে তলব করেছেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ। আগামী ৫ জানুয়ারি তাদের আপিল বিভাগে হাজির হয়ে ওই নিবন্ধের বিষয়ে ব্যাখ্যা দিতে বলা হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে কেন আদালত অবমাননার অভিযোগে ব্যবস্থা নেয়া হবে না- তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেছেন আপিল বিভাগ। প্রধান বিচারপতি মো. মোজাম্মেল হোসেনের নেতৃত্বে আপিল বিভাগের আট সদস্যের বেঞ্চ সোমবার এ আদেশ দেন বলে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম জানান। আদালতের গুরুতর অবমাননার দায়ে এর আগেও মিজানুর রহমান খানকে সাজা দিয়েছেন আদালত, সতর্ক করে দেয়া হয়েছে প্রথম আলোকে। গতকাল সোমবার প্রথম আলোতে প্রধান বিচারপতি বেছে নেয়া শিরোনামে মিজানুর রহমান খানের লেখা ওই নিবন্ধ প্রকাশিত হয়, যাতে বলা হয়, বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি ১৬ জানুয়ারি ২০১৫ অবসরে যাওয়ার কারণে আরেকজন নতুন প্রধান বিচারপতি নিয়োগের বিষয়টি সামনে এসেছে। এ পদে নিয়োগে কী প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হবে, তা নিয়ে তেমন আলোচনা কখনো হয়নি। দ্বাদশ সংশোধনী প্রধান বিচারপতি নিয়োগে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ রদ করেছিলো। কিন্তু বাস্তবে তা ঘটছে। বর্তমান প্রধান বিচারপতির টানা তিন বছর এই পদে থাকা বিরল ঘটনা। জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ব্যারিস্টার রোকনউদ্দিন মাহমুদ বিষয়টি আপিল বিভাগের নজরে আনলে আদালত তাকে আবেদন করতে বলেন। পরে ব্যারিস্টার সিরাজুম মুনির আদালত অবমাননার অভিযোগ এনে আবেদন করলে আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ মতিউর রহমান ও মিজানুর রহমান খানকে তলব করেন বলে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম জানান। শুনানিতে ব্যারিস্টার রোকন উদ্দিন মাহমুদ বলেন, মিজানুর তার পুরো লেখায় আপিল বিভাগের মর্যাদাহানি করেছেন। তার লেখা পড়ে মনে হয়, যেন কেবিনেট সেক্রেটারি অথবা উত্তর পাড়া থেকে কোন লোক এনে প্রধান বিচারপতি করা হয়.. আপনাদের কারও যোগ্যতা নেই প্রধান বিচারপতি হওয়ার। এ সময় আপিল বিভাগের একজন বিচারপতি বলেন, এটা বোঝার জন্য শিক্ষা থাকতে হয়। এরকম অর্ধ শিক্ষিত কীভাবে এটা বুঝবে? রোকন উদ্দিন মাহমুদ এ সময় বলেন, এজন্য অর্ধশিক্ষিত থেকে অশিক্ষিত ভালো। কোনো এক জ্ঞানী মনীষী বলেছেন, তোমরা অশিক্ষিতের কাছে যাও কিন্তু অর্ধশিক্ষিতের কাছে যেও না। ওই নিবন্ধের একটি অংশ পড়ে শুনিয়ে তিনি বলেন, তিনি লিখেছে, নিম্ন আদালতের বিচারক অথবা বাইরে থেকে যোগ্য যে কাউকে প্রধান বিচারপতি নিয়োগ দিতে সংবিধান বাধা নয়। এ উক্তির মাধ্যমে তিনি আদালতের কর্তৃত্বকে চ্যালেঞ্জ করেছেন।

উনি লিখেছেন, বিচারপতি মো. আব্দুল ওয়াহহাব মিঞা ও বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানার নিয়োগ বিএনপি সরকারের আমলে স্থায়ী হয়। এ লেখার দ্বারা উনি কি বোঝাতে চেয়েছেন? এ সময় আপিল বিভাগের একজন বিচারপতি বলেন, এ তথ্য সঠিক নয়। বিচারপতি এসকে সিনহার চাকরিও বিএনপির আমলে স্থায়ী হয়।

ব্যারিস্টার রোকন বলেন, উনি লিখেছেন, প্রধান বিচারপতি নিয়োগে সংসদ এবং নির্বাহী বিভাগের মতামত নিতে হবে। উনি নির্বাহী বিভাগের প্রেমে পড়েছেন। এ সময় একজন বিচারপতি বলেন, এটা খুবই বিপজ্জনক কথা। আদালত এ পর্যায়ে সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল মাহমুদুল ইসলামকে শুনানিতে অংশ নিতে ডাকেন।

আদালতে উপস্থিত মাহমুদুল ইসলাম বলেন, আদালতের এখতিয়ার কখনও চ্যালেঞ্জ করা যায় না। আপনারা তো তাদের বিরুদ্ধে এখনই কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছেন না। শোকজ করা যেতে পারে। তারা তাদের ব্যাখ্যা দিক। আদালতের আহ্বানে আরেক জ্যেষ্ঠ আইনজীবী আজমালুল হোসেন কিউসি বলেন, মিজানুর রহমান খান একজন স্বভাবজাত আদালত অবমাননাকারী। অতীতে তিনি অনেকবার আদালত অবমাননা করেছেন। আপনারা হলফনামায় ব্যাখ্যাসহ ব্যক্তিগত হাজিরার আদেশ দিতে পারেন। নিবন্ধের কিছু অংশ আদালতে উপস্থাপন করে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেন, তার এ লেখা অবমানাকর। ১৯৪৭ সালের পর আমাদের কোর্টকে এভাবে কেউ মেলাইন করেনি। পরে মাহবুবে আলম সাংবাদিকদের বলেন, প্রথম আলোতে বিচারপতি নিয়োগ, বিশেষ করে প্রধান বিচারপতি নিয়োগ নিয়ে লেখায় মিজানুর রহমান খান যেসব উক্তি করেছেন তা আদালতের গোচরে আনা হয়েছে। একজন আইনজীবীও দরখাস্ত করেছেন।

তাদের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার পদক্ষেপ নেয়ার জন্য আবেদন করা হয়েছে। আদালত সেই দরখাস্তের ভিত্তিতে রুল দিয়ে তাদের হাজির হতে বলেছেন। ৫ জানুয়ারি দুজনকে আদালতে সশরীরে হাজির থাকতে হবে। মাহবুবে আলমের দাবি, আদালত ও প্রধান বিচারপতি নিয়োগ নিয়ে এ ধরনের লেখা অন্তত ১৯৪৭ সালের পরে আর লেখা হয়নি। পরোক্ষভাবে লেখক যেটা প্রকাশ করতে চেয়েছেন, সেটা হলো, প্রধান বিচারপতি পদে নিয়োগের জন্য বিচারক হিসাবে আসীন কেউ উপযুক্ত নন। মর্মার্থ সেটাই দাঁড়ায়। যদিও সরাসরি এ ধরনের কোনো কথা বলেননি। কিন্তু পরোক্ষভাবে, বিচারকদের দক্ষতা, পারদর্শিতা এবং অন্যান্য বিষয়গুলোর উল্লেখ করে যে কটাক্ষ তিনি করেছেন, সেটা গর্হিত এবং আদালত অবমাননাকর। আইনজীবীরা সবাই একই বক্তব্য দিয়েছেন। তারা বলেছেন, এ ধরনের লেখার ফলে আদালতের ওপর মানুষের আস্থা নষ্ট হয়ে যাবে। সব ক’জন আইনজীবী একবাক্যে বলেছেন, আদালতের প্রতি আস্থা নষ্ট করার এটা একটা প্রয়াস।

সম্প্রতি সংবাদ মাধ্যমের বিরুদ্ধে একাধিক আদালতের আদেশে সংবাদ মাধমের স্বাধীনতা ক্ষুণ্ণ হচ্ছে কি-না এমন প্রশ্নে সরকারের প্রধান আইন কর্মকর্তা বলেন, না। একেবারেই না। দরখাস্তকারীর আইনজীবী বারবার বলেছেন, এ সাংবাদিক রিপিটেডলি আদালতের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করতে একটার পর একটা কাজ করে যাচ্ছেন। কাজেই একজন বিশেষ সাংবাদিকের বিষয়ে পদক্ষেপ নেয়ার অর্থ এই না যে, সমগ্র মিডিয়ার ওপরে কোনোরকম হস্তক্ষেপ বা প্রভাব বিস্তার করা। অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, সর্বোচ্চ বিচারালয়ের আট বিচারকের সবাই এ শুনানিতে উপস্থিত ছিলেন এবং তারা সবাই মিলেই রুল দিয়েছেন। বাংলাদেশের ইতিহাসে এ ধরনের ঘটনা ঘটেছে বলে আমার মনে হয় না। এর আগে মিনিটে একটি আগাম জামিন কীভাবে? এবং ছয় থেকে আট সপ্তার স্বাধীনতা শিরোনামে দৈনিক প্রথম আলোয় প্রকাশিত দুটি লেখা নিয়ে গত ২ মার্চ মিজানুর রহমান খানকে তলব করেন হাইকোর্টের এ বেঞ্চ। গত ১৩ মার্চ ওই মামলার রায়ে বিচারপতি নাঈমা হায়দার ও বিচারপতি জাফর আহমেদের হাইকোর্ট বেঞ্চ শুনানি ও রায়ের পাঁচদিন আদালতে মিজানুর রহমান খানের দাঁড়িয়ে থাকাকে দণ্ড হিসেবে গণ্য করে এবং তাকে পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা করেন। প্রথম আলোর সম্aপাদক, প্রকাশক ও মুদ্রাকর মতিউর রহমানের নিঃশর্ত ক্ষমা প্রার্থনা করায় তাকে সতর্ক করে অভিযোগের দায় থেকে অব্যাহতি দেন আদালত।