ফলোআপ : ইরাকের নাজাফে এখনো বন্দী মেহেরপুরের ৪২ জনসহ দেড় শতাধিক বাংলাদেশি

মাজেদুল হক মানিক: সুখের আশায় এসেছিলাম বিদেশে। কাজ পাওয়া তো পড়ে থাক এখন খেতেই পাচ্ছি নে। এক বেলা কোনো রকম খেয়ে বেঁচে আছি। বাইরের আলো চোখে পড়ে না। খাবার ও কাজ চাইলেই পিঠে পড়ে লাঠির বাড়ি। ধু ধু মরুভূমির বন্দীশালায় নিত্যসঙ্গী নির্যাতন। জমি জিরাত বিক্রি করে দালালদের হাতে দিয়েছিলাম সর্বস্ব। এখন প্রাণটা যাওয়ার আশঙ্কায় প্রহর গুনছি। ইরাকের নাজাফে বন্দী মেহেরপুর সদর উপজেলার টেঙ্গারমাঠ গ্রামের আব্দুল হালিম এভাবেই তার জীবনের বিভীষিকাময় পরিস্থিতির বর্ণনা করছিলেন। স্থানীয় আদমব্যাপারীদের মাধ্যমে কাতারে যাওয়ার পথে আব্দুল হালিমসহ দেড় শতাধিক বাংলাদেশির ঠাঁই হয়েছে নাজাফের মরুভূমিতে ইরাকের কয়েকজন দালালের বন্দীশালায়। প্রতারণায় শিকার এসব বাংলাদেশিদের মধ্যে মেহেরপুর জেলার রয়েছেন ৪২ জন।

বন্দী কয়েকজনের পরিবারের অভিযোগের বিষয়ে গত ২২ নভেম্বর মোবাইলফোনে যোগাযোগ করা হয় গাংনী উপজেলার কাজিপুর গ্রামের সুজন মিয়াসহ কয়েকজনের সাথে। তারা বন্দীশিবিরের বর্ণনা দেন। কিন্তু এতে তাদের ভাগ্যে জোটে আরো নির্যাতন। মোবাইলফোনে কথা বলায় ওই শিবিরের ৪জন পাহারাদার তাদের ব্যবহৃত মোবাইল ফোন কেড়ে নেন। এরপর থেকে পরিবারের সাথে তাদের কোনো যোগাযোগ ছিলো না। পরে সোমবার একজন পাহারাদারকে ম্যানেজ করে তার মোবাইলফোন দিয়ে পরিবারের সাথে যোগাযোগ করেন টেঙ্গরমাঠ গ্রামের আব্দুল হালিম।

বুধবার রাত এগারটার দিকে আব্দুল হালিমের সাথে মোবাইলফোনে কথা হয়। তিনি কথার শুরুতেই কান্নায় ভেঙে পড়েন। তিনি জানান, নাজাফ এলাকায় মরুভূমির মধ্যে একটি ঘরে তারা দেড় শতাধিক বাংলাদেশি আটক রয়েছেন। ঘরের একটি মাত্র দরজা। তার সামনে সর্বদা পাহারা করে ইরাকের স্থানীয় বাসিন্দা চার পাহারাদার। তাদের হাতে থাকে অত্যাধুনিক আগ্নেয়াস্ত্র। তারা দিনে একবার কিছু আটা ও সবজি দিয়ে যায়। রান্নার সরঞ্জামও তেমন দেয় না। রান্না করে কোনো রকম এক বেলা তাদের খাবার জোটে। খাবার ও বাইরে যাওয়ার কথা বললেই পাহারাদাররা তাদের বেধড়ক মারপিট করে। কিছু কিছু সময় ফাঁকা গুলি ছুড়ে প্রাণনাশের ভয় দেখায়। তবে গুলি করা লাগবে না। এভাবে আর কিছু দিন পার হলে অনেকেই মারা যাবেন। খেতে না পেরে বেশির ভাগ বন্দীর এখন রুগ্ন অবস্থা। কাজ চাই না, পরিবার পরিজনদের কাছে ফিরে যেতে চাই। আপনারা আমাদের জন্য কিছু করুন। এমন দাবি করে আবারো কান্নায় ভেঙে পড়েন আব্দুল হালিম। ইরাকে বাংলাদেশ দূতাবাসে তারা বারবার যোগাযোগ করেও কোনো সহযোগিতা পাচ্ছেন না বলে অভিযোগ করেন তিনি। এদিকে বন্দী বাংলাদেশিদের পরিবার অজানা নানা আশঙ্কায় দিন কাটাচ্ছেন। স্বজনদের চিন্তায় দিশেহারা পরিবারের সদস্যরা। তাদের পরিবারে এখন শুধুই কান্নার রোল।

টেঙ্গরমাঠ গ্রামের আব্দুল হালিমের স্ত্রী আকলিমা খাতুন জানান, তিন ছেলেমেয়ে নিয়ে তিনি নির্ঘুম রাত কাটান। উদ্বেগ ও উৎকন্ঠায় দিন পার হচ্ছে। সন্তানদের স্কুলে যাওয়া বন্ধ। স্বামীর বন্দির সাত মাসের মধ্যে মাত্র তিন দিন কথা বলেছেন তাও আবার মাত্র চার মিনিট। সে শুধুই বলেছে আমাকে তোমরা বাড়ি ফিরিয়ে আনো না হয় মারা যাবো। তবে হতাশা ছাড়া তাদের আর কিছুই করার নেই।

উল্লেখ্য, জেলার টেংগার মাঠ, কাজিপুর ও সাহেবনগরসহ কয়েকটি গ্রামের ৪২ জন কাতার যাওয়ার জন্য ভিটেমাটি বিক্রি করে স্থানীয় কয়েকজন দালালের হাতে তুলে দেন ৪ লাখ করে টাকা। ঢাকার গুলশান-২ এ অবস্থিত ক্যারিয়ার ওভারসিজ কনসাল্টেন্ট লিমিটেডের মাধ্যমে সাত মাস আগে তাদেরকে নেয়া হয় ইরাকে। ইরাকের নাজাফ শহরের আবু তোরাব হাউজিং কোম্পানিতে লোভনীয় কাজের সুযোগের আশ্বাস দিয়ে তাদেরকে কয়েকদিন নাজাফ এলাকায় রাখে ওই এজেন্সির প্রতিনিধিরা। সেখানে দেশের বিভিন্ন স্থানের আরো শতাধিক লোকের সাথে তাদের রাখা হয়। পরে কৌশলে তাদের সবাইকে মরুভূমির একটি ঘরে আটকে রাখা হয়। তার পর থেকে এজেন্সির কেউ তাদের সাথে দেখা করেনি। তবে কি উদ্দেশে তাদের আটকে রাখা হয়েছে তা নিশ্চিত নয় বন্দী হতভাগ্য বাংলাদেশি এসব লোকজন। ভাগ্যবিড়ম্বিত এসব মানুষগুলোকে ফিরিয়ে আনতে মেহেরপুর জেলা প্রশাসকের কাছে আবেদন করেছেন জেলার ভুক্তভোগী ১৬টি পরিবারের সদস্যরা।