ভারত দিয়েছে ১১ জঙ্গি ও বাংলাদেশ দিয়েছে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ৭ জঙ্গির তালিকা

আত্মঘাতী সেই নারী সুহানাকে ভারতে গ্রেফতার : রাজীব গান্ধীর আদলে শেখ হাসিনাকে হত্যার ষড়যন্ত্র

 

স্টাফ রিপোর্টার: বর্ধমানে বিস্ফোরণের ঘটনায় সন্দেহভাজন কয়েকজনসহ ১১ সন্ত্রাসীর একটি নামের তালিকা র‌্যাবকে দিয়েছে ভারতের এনআইএকে। অন্যদিকে র‌্যাব ভারতে পালিয়ে থাকা ১০ জঙ্গিসহ ৫১ অপরাধীর একটি তালিকা দিয়েছে ভারতের জাতীয় তদন্ত সংস্থাকে। গতকাল মঙ্গলবার সন্ধ্যায় র‌্যাব সদর দপ্তরে সংস্থার শীর্ষ কর্মকর্তাদের সাথে বৈঠকে এ তালিকা দুটি বিনিময় হয় বলে র‌্যাবের ‌মুখপাত্র মুফতি মাহমুদ খান জানিয়েছেন।

জানা গেছে, ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধীর আদলে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যা করার মিশন নিয়েছিলো জঙ্গিরা। বিএনপি চেয়ারপারসন সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়াও ছিলেন তাদের টার্গেটে। মিশন বাস্তবায়নের আগেই বর্ধমানে বিস্ফোরণ ঘটনায় ভারতের জাতীয় তদন্ত সংস্থার বিশেষ তৎপরতায় ধরাপড়েছে নারী সুজনাসহ কয়েকজন। এ তথ্য দিয়ে সূত্র বলেছে, বাংলাদেশের শীর্ষ নেতৃকে হত্যার জন্য একজন নারীও ঠিক করা হয়েছিলো, যিনি কি-না নিজের শরীরে বোমা বেঁধে নেত্রীকে ফুলের মালা দিতে গিয়ে বোমার বিস্ফোরণ ঘটাবেন। কিন্তু তার আগেই সুজানা নামের ও নারী গ্রেফতার হওয়ায় তা ভেস্তে গেছে। ভারতের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা (এনআইএ) গত ৭ নভেম্বর সন্ধ্যায় আসামের গোহাটি বাসস্ট্যান্ড থেকে তাকে গ্রেফতার করেছে। গত ২ অক্টোবর পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমানে জঙ্গি আস্তানায় বোমা বিস্ফোরণে দুজন নিহত ও একজন আহত হওয়ার ঘটনায় রাজিয়া বিবি ও আমিনা বেগম নামে ইতঃপূর্বে গ্রেফতার হওয়া দু নারীর দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে সুজানাকে গ্রেফতার করা হয়েছে। বাংলাদেশের গোয়েন্দাদের সঙ্গে গতকাল মঙ্গলবার ঢাকায় অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে এই তথ্য প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ সফররত এনআইএ টিমের সদস্যরা। সকাল এগারটা থেকে দীর্ঘ তিন ঘণ্টা এ বৈঠক চলে।

বৈঠকে উভয় পক্ষ জঙ্গিদের তালিকা হস্তান্তর করেছে। এনআইএ দিয়েছে ১১ জন জঙ্গির তালিকা। আর বাংলাদেশ দিয়েছে সাতজন মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত জঙ্গির তালিকা। এর বাইরে পাঁচজন জঙ্গির একটি পৃথক তালিকা ও ৪১ জন সন্ত্রাসীর অপর একটি তালিকাও এনআইএ টিমের কাছে দিয়েছে বাংলাদেশ প্রতিনিধি দল। উভয় দেশ তালিকা ধরে কাজ করবে বলে সম্মত হয়েছে। বাংলাদেশের তালিকাটি প্রস্তুত করেছে ৱ্যাব। ৱ্যাবের পক্ষে অতিরিক্ত মহাপরিচালক কর্নেল জিয়াউল আহসান এনআইএ টিমের প্রধান শারদ কুমারের কাছে তালিকাটি হস্তান্তর করেন।

এনআইএ টিম গতকাল দুপুরে পুলিশ সদর দফতরেও পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সাথে সৌজন্য সাক্ষাৎ করে। এছাড়া সন্ধ্যায় র্যাব সদর দফতরে আরো একটি বৈঠক হয়। বৈঠকগুলোতে তালিকায় থাকা জঙ্গিদের নিয়ে আলোচনা হয়েছে। তবে ভারতের দেয়া তালিকায় যাদের নাম আছে বাংলাদেশের গোয়েন্দারা তাদের চিনতে পারেনি। ভিন্ন নামেও তারা সেখানে অবস্থান করতে পারে। তাই এনআইএর দেয়া তালিকা নিয়ে ৱ্যাব ও ডিবি বিস্তারিত কাজ করবে। গোয়েন্দা কর্মকর্তারা বলছেন, তালিকা ধরে আরো কাজ করলেই বোঝা যাবে এরা কারা।

বৈঠক সূত্র জানায়, সুজানাকে গ্রেফতারের পর জিজ্ঞাসাবাদে বেশ কিছু চাঞ্চল্যকর তথ্য পেয়েছে এনআইএ। বাংলাদেশে তাদের কর্ম এলাকা, পরবর্তী মিশনের অনেক কিছুই জানে সুজানা। খুব শিগগিরই তার বাংলাদেশে আসার কথা ছিল। বৈঠক সূত্র জানায়, এনআইএ’র পক্ষে যে ১১ জনের তালিকা দেয়া হয়েছে তাদের মধ্যে আছে পশ্চিমবঙ্গের বীরভূমের বলপুরের কাওসার (২৮), তালহা শেখ (২৮), রেজাউল করিম (২৬), আমজাদ আলী শেখ (৩০) ও হাবিবুর রহমান শেখ ওরফে শেখ (২৪); মঙ্গলকোর্টের মাওলানা ইউসুফ শেখ ওরফে বক্কর ওরফে মো. ইউসুফ (৩২), বোরহান শেখ (২৯), আবুল কালাম ওরফে আজাদ (২৩), আসামের শাহ নূর আলম ওরফে ডক্টর (৩৩), নদীয়ার জহিরুল শেখ (২৬) ও বর্ধমানের নাসিরুল্লাহ (৩৬)।

আর বাংলাদেশ যে সাতজন মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত জঙ্গির তালিকা দিয়েছে তাদের মধ্যে আছে নারায়ণগঞ্জের বন্দর থানার সালাহউদ্দিন ওরফে সালেহীন ওরফে সজীব ওরফে তৌহিদ (৩১), কুষ্টিয়া কুমারখালীর আবু সাঈদ শেখ ওরফে হোসাইন (৩৪), জামালপুর সদরের শিকারভিটার জাহিদুল ইসলাম ওরফে সুজন ওরফে বোমারু মিজান ওরফে হারুন ওরফে কামরুল (৩৫), টাঙ্গাইলের গোপালপুরের মাওলানা তাজউদ্দিন (৪৮), ঢাকার দোহারের হাফেজ জাহাঙ্গীর আলম বদর, কিশোরগঞ্জের ভৈরবের মুফতি শফিকুর রহমান ও কুমিল্লার দাউদকান্দির মুফতি আবদুল হাই।

এর বাইরে আরো পাঁচজন জঙ্গির একটি তালিকা দিয়েছে বাংলাদেশের গোয়েন্দারা। এর মধ্যে তিনজন ৫ জানুয়ারির সংসদ নির্বাচনের আগে বা পরে কৌশলে জামিন পেয়ে পালিয়েছে।  গোয়েন্দা সূত্রমতে, কারাগার থেকে জামিনে বেরিয়ে যাওয়া আবু সাঈদ ওরফে মাহফুজ ওরফে সোহেল (৩১), তরিকুল ইসলাম (৩৫) ও সালেহীন (৩৪) ভারতের মুর্শিদাবাদে পালিয়ে আছে। আর দুই জনের মধ্যে একজন ময়মনসিংহের ত্রিশালে পুলিশ হত্যা করে জঙ্গি ছিনতাইয়ে নেতৃত্ব দেয়া আনোয়ারুল ইসলাম ওরফে আনোয়ার হোসেন ওরফে ফারুক ওরফে সাখাওয়াত (৩৬) ও অপরজন ছিনতাই হওয়া জঙ্গি বোমারু মিজান (৩৫)।

এদিকে দুপুরে পুলিশ সদর দফতরে এনআইএর সাথে বৈঠক শেষে ঢাকা মেট্টোপলিটন পুলিশের যুগ্ম কমিশনার (ডিবি) মনিরুল ইসলাম বলেন, ত্রিশালে পুলিশ হত্যা করে জঙ্গি ছিনতাইয়ের ঘটনায় পলাতক জেএমবি সদস্য সালাউদ্দিন সালেহীন ওরফে সানি ও জাহিদুল ইসলাম ওরফে বোমারু মিজান এবং ওই ঘটনার সন্দেহভাজন পরিকল্পনাকারী ফারুক হোসেনকে ভারতের জাতীয় তদন্ত সংস্থাও (এনআইএ) খুঁজছে।

তিনি বলেন, বর্ধমান বিস্ফোরণের ঘটনায় সন্দেহভাজনদের যে তালিকা এনআইএ কর্মকর্তারা সোমবারের বৈঠকে দিয়েছেন, তাতে সানি, মিজান ও ফারুকের কথা রয়েছে। আর বাংলাদেশের তদন্ত সংস্থাগুলোও তাদের খুঁজছে।

গত ২৬ ফেব্রুয়ারি ত্রিশালের সাইনবোর্ড এলাকায় প্রিজন ভ্যানে হামলা চালিয়ে পুলিশ হত্যা করে জেএমবির শুরা সদস্য রাকিবুল হাসান ও সালাউদ্দিন সালেহীন ওরফে সানি (৩৮) এবং বোমা বিশেষজ্ঞ মিজানকে (৩৫) ছিনিয়ে নেয়া হয়। পালানোর পথে ওইদিনই মির্জাপুরে গ্রেফতার হন রাকিবুল হাসান। পরে পুলিশের সাথে কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত হন তিনি। বাকি দুজনের কোনো খোঁজ না পেয়ে বাংলাদেশের পুলিশ তাদের ধরিয়ে দেয়ার জন্য পাঁচ লাখ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করে।

মনিরুল ইসলাম বলেন, এনআইএ মনে করছে, বর্ধমানের ঘটনায় তাদের সম্পৃক্ততা আছে। এ কারণেই তাদের খুঁজছেন ভারতের গোয়েন্দারা। বোমা বিশেষজ্ঞ মিজান পশ্চিমবঙ্গে জেএমবির তরুণ জঙ্গিদের বোমা বানানোর প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন বলেও এনআইএ কর্মকর্তাদের সন্দেহ। এ বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে মনিরুল ইসলাম বলেন, এনআইয়ের হাতে গ্রেফতার সাজিদই যে নারায়ণগঞ্জের মাসুম সে বিষয়েও পুলিশ এখন অনেকটাই নিশ্চিত।

পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান বিস্ফোরণের ঘটনা তদন্তের দায়িত্বে থাকা ভারতের জাতীয় তদন্ত সংস্থার গোয়েন্দারা হায়দরাবাদ থেকে মিয়ানমারের এক নাগরিককে গ্রেফতার করেছে। খালিদ ওরফে খালিদ মোহাম্মদ নামের ওই যুবক রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশনের সদস্য, যে সংগঠনটির সাথে বাংলাদেশের জঙ্গিদের সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ রয়েছে।

ভারতীয় গোয়েন্দারা বলছেন, ২৮ বছর বয়সী খালিদ একজন বিস্ফোরক বিশেষজ্ঞ। বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্ত এলাকায় তার জঙ্গি ক্যাম্প রয়েছে। সোমবার বিকালে হায়দরাবাদের একটি হোটেল থেকে খালিদকে গ্রেফতার করে এনআইএ। তার কাছে এমন কিছু ভিডিও পাওয়া গেছে, যাতে জঙ্গি প্রশিক্ষণের বিষয় এসেছে। মধ্যপ্রাচ্যের জঙ্গি সংগঠন আইএস এর কার্যক্রম, বোমা তৈরি ও বিষের গুণাগুণ নিয়ে লেখা কিছু বইও তার কাছে পাওয়া গেছে বলে এনআইএর এক বিবৃতিতে জানানো হয়। এনআইএ বলছে, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে মিয়ানমারের উগ্রপন্থি সংগঠন তেহেরিক-ই-আজাদি আরাকান এর হয়ে পাকিস্তানের তেহেরিক-ই তালিবানের কাছ থেকে জঙ্গি প্রশিক্ষণ নেয়ার কথা স্বীকার করেছেন খালিদ। ভুয়া নাম পরিচয়ে তিনি হায়দ্রাবাদের ওই হোটেলে উঠেছিলেন। তার সঙ্গে বৈধ কাগজপত্রও ছিলো না।