জিল্লুর রহমান সিদ্দিকীর প্রয়াণ

চলে গেলেন বরেণ্য শিক্ষাবিদ অধ্যাপক জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী। তিনি ছিলেন মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তচিন্তা ও অসাম্প্রদায়িক চেতনার ধারক। সারাজীবনের সাধনায় জাতিকে বনস্পতির মতো ছায়া দিয়েছেন এ জ্ঞানতাপস। জ্ঞানভিত্তিক সমাজ গঠনে বিপুল অবদান রেখেছেন। খ্যাতনামা এ শিক্ষাবিদ গত মঙ্গলবার রাত পৌনে ১২টার দিকে ঢাকা বনানীর নিজ বাড়িতে ইন্তেকাল করেন (ইন্নালিল্লাহে….রাজেউন)। তার বয়স হয়েছিলো ৮৬ বছর। তিনি স্ত্রী, তিন ছেলে, এক মেয়ে, আত্মীয়স্বজন এবং অসংখ্য গুণগ্রাহী রেখে গেছেন। তার মৃত্যুতে দেশের বুদ্ধিজীবী মহলসহ সর্বস্তরে শোকের ছায়া নেমে এসেছে।

 

আজীবন জ্ঞানচর্চায় নিবেদিত মৃদুভাষী এ মানুষটি নিজেকে নিয়োজিত রেখেছিলেন সৃজনশীল কাজে। পরিণত বয়সে মৃত্যু হলেও এটাকে অকালপ্রয়াণই বলতে হবে। কারণ বাংলাদেশ এখনো সংকটের ভেতর দিয়ে অতিক্রম করছে। সংকটকালে তার মতো দৃঢ়চেতা মানুষের বড় প্রয়োজন এদেশে। উদাহরণযোগ্য চারিত্রিক দৃঢ়তা তাকে অনেকের চেয়ে আলাদা করে পরিচিত করেছিলো। সস্তা ও ঠুনকো জনপ্রিয়তার কাছে আত্মসমর্পণ না করে জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী সৃজনশীলতার সব শাখায়ই বিচরণ করেছেন। দেশে ও বিদেশে প্রশংসিত হয়েছে তার কাজ। অনুবাদ সাহিত্যকে আলাদা মাত্রা এনে দিয়েছিলেন তিনি।

 

জন্ম ঝিনাইদহের প্রত্যন্ত গ্রাম দুর্গাপুরে। শৈশবেই পিতার কর্মক্ষেত্রের সাথে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে লেখাপড়া করেছেন। ছাত্রজীবনেও তিনি তার মেধার পরিচয় দিয়েছেন। ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় স্টার মার্কসসহ উত্তীর্ণ হয়েছিলেন। আইএ পরীক্ষায়ও সে সময় উত্তীর্ণ হয়েছিলেন প্রথম বিভাগে। স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শ্রেণিতে ইংরেজি সাহিত্যে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান অধিকার করে সরকারি বৃত্তি নিয়ে গিয়েছিলেন অক্সফোর্ডে। পিতার বদলির চাকরিসূত্রে ঘুরেছেন অবিভক্ত ভারতের বিভিন্ন এলাকা। উচ্চতর শিক্ষার জন্য বিদেশে গেছেন। নানা রকম মানুষের সাথে তার পরিচয় হয়েছে। আর এসবের ভেতর থেকে পরিশুদ্ধ জীবনাচারে নিজেকে গড়ে নিতে পেরেছিলেন তিনি। অর্জন করেছিলেন ঈর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব। উচ্চারিত প্রতিটি শব্দ তার জ্ঞানের গভীরতার পরিচয় বহন করে। আপাতগম্ভীর, স্বল্পভাষী জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী তার সারাটি জীবন জ্ঞানচর্চাকেই প্রাধান্য দিয়ে এসেছেন। শিক্ষা ও গবেষণায়ই অতিবাহিত করেছেন জীবনের পুরোটা সময়। ঢাকা কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেছেন। দু দফায় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের দায়িত্ব পালন করেছেন। বিশ্বভারতীর মতো প্রতিষ্ঠানে ভিজিটিং প্রফেসর হিসেবে কাজ করেছেন। এই শিক্ষাব্রতী আবার জাতীয় সংকটে, দেশের প্রয়োজনে দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিতেও বিন্দুমাত্র সিদ্ধান্তহীনতায় ভোগেননি।

 

১৯৯০ সালের গণ-আন্দোলনে সরকার পতনের পর যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হয়েছিলো, তার একজন উপদেষ্টা হিসেবে তিনি দায়িত্ব পালন করেন। বাংলা একাডেমি, এশিয়াটিক সোসাইটির মতো প্রতিষ্ঠানের সাথে জড়িত থেকে এসব প্রতিষ্ঠানকে সমৃদ্ধ করেছেন তিনি। বাংলা প্রবন্ধ সাহিত্য, কবিতা ও অনুবাদ সাহিত্য সমৃদ্ধ হয়েছে তার লেখায়। আলাওল পুরস্কার, বাংলা একাডেমি পুরস্কার, স্বাধীনতা পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। কিন্তু তার সেরা পুরস্কার মানুষের সম্মান অর্জন। মুক্তচিন্তার এ মানুষটি যখন পরপারে পাড়ি জমালেন, তখন আমরা এক অস্থির সময় অতিক্রম করছি। যখন পরমতসহিষ্ণুতা শূন্যের কোঠায়, যত্রতত্র দৃষ্ট হচ্ছে পরিমিতিবোধের অভাব, তখন জিল্লুর রহমান সিদ্দিকীর মতো আলোকিত মানুষদের বেশি প্রয়োজন। তার অনুসরণীয় জীবনাচার আমাদের জন্য উদাহরণ হয়ে থাকবে। তাকে আমাদের অনেক শ্রদ্ধা।