পানের গোড়া ও কাণ্ড পঁচা এবং পান পাতায় দাগ

মেহেরপুরের পানচাষিদের অর্থনৈতিক মেরুদণ্ড ভেঙে যাচ্ছে

 

মহাসিন আলী: পান বাংলাদেশের একটি অর্থকরি ফসল। লাভজনক ফসল হলেও মেহেরপুরের পানচাষিরা ফলন বিপর্যের মুখে পড়েছেন। গত বছরের ক্ষতি কাটিয়ে ওঠার আশায় এ বছরও পানচাষ করেছেন চাষিরা। পানের গোড়া ও কাণ্ড পঁচা এবং পান পাতায় দাগ রোগ পানচাষিদের হতাশায় ফেলেছে। পরপর কয়েক বছরের ক্ষতিতে এ জেলার পানচাষিদের অর্থনৈতিক মেরুদণ্ড ভেঙে যেতে পারে এমন আশঙ্কা খোদ কৃষি বিভাগের। জরুরি প্রয়োজনে মেহেরপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর পানের রোগ প্রতিরোধে চাষিদের জন্য করণীয় শীর্ষক লিফলেট বিতরণ করছে।

মেহেরপুর জেলা সদরের পিরোজপুর ইউনিয়নের নূরপুর এ জেলার পানচাষের গ্রাম। এ গ্রামের চাষিরা বাপ-দাদার আমল থেকে পানচাষ করে আসছেন। অর্ধশত বছরের পুরাতন পানবরজ এ গ্রামের মাঠে রয়েছে। নূরপুর গ্রামের মাঠে ওই গ্রামের নাসিরউদ্দিন, জালালউদ্দিন ও জাহাঙ্গীর হোসেন তিন বিঘা করে, তাছিরউদ্দিন ও আক্কাস আলীর দু বিঘা করে এবং একই গ্রামের আরমান আলী এক বিঘা জমিতে পানচাষ করেছেন। চলতি বছরে নূরপুর ও পিরোজপুরের মাঠে প্রায় ৩শ বিঘা জমিতে পানচাষ হয়েছে।

দুশ বছর আগে যখন এলাকায় বারুইরা বাস করতেন তখন থেকেই এ এলাকায় পানচাষ হচ্ছে। তবে আশির দশকের পর থেকে ধীরে ধীরে পানচাষ বৃদ্ধি পেতে থাকে। পানচাষ লাভজনক হওয়ায় নূরপুরবাসীর আয়ের প্রধান উৎস হয়ে উঠেছে পান। তবে এ সময়ে তাদের পানের গোড়া ও কাণ্ড পঁচা এবং পান পাতায় দাগ রোগ লেগেছে। গত বছর একই ধরনের রোগে চাষি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। ক্ষতি পুষিয়ে নিতে অধিকাংশ চাষিই এ বছর নবোদ্যমে পানচাষ করেছে। কিন্তু বিধিবাম। তাদের সে আশা নিরাশায় পরিণত হয়েছে।

স্থানীয় পানচাষি আক্কাস আলী জানান, চাষি লাভের আশায় পানচাষ করেন। প্রতি সপ্তায় এলাকা থেকে ৮-১০ ট্রাক পান জেলার বাইরের জেলায় রপ্তানি হতো। ভালো লাভ পেতেন এলাকার চাষিরা। কিন্তু সেই লাভে তাদের ভাটা পড়েছে। এ বছর পানে গোড়া ও কাণ্ড পঁচা এবং পান পাতায় দাগ রোগ লেগেছে। পরিচর্যা করেও কোনো লাভ হচ্ছে না। এ বছর চাষিদের পানচাষে লাভ হবে না। গত বারের মতো বছরের পরিচর্যা খরচ উঠবে না। মাঠের শতকরা ৯০ ভাগ পানে রোগ লেগেছে।

নূরপুর গ্রামের পানচাষি তাছিরউদ্দিন জানান, পান ১২ মাসী ফসল। বোশেখ-জ্যৈষ্ঠ মাসে পানচাষের জন্য জমিতে পিলে তৈরি করতে হয়। আষাঢ়, শ্রাবণ ও ভাদ্র মাসে পরিচর্যা করতে হয়। জমিতে জৈব সার খৈল-মাটি দিতে হয়। ১২ মাসী ফসল পান তাই ১২ মাসই পরিচর্যা করতে হয়। একবার পানচাষ করতে বর্তমান বাজার দরে ৮০ হাজার টাকা খরচ হয়। এরপর বছরের পর বছর চলে ওই বরজ। প্রতিবছর পানে জৈব সার খৈল-মাটি দিতে ও পরিচর্যা করতে প্রায় ৫০ হাজার টাকা খরচ। ভালো পান হলে প্রতিবিঘা জমি থেকে বছরে ৮০ হাজার থেকে এক লাখ টাকা পর্যন্ত লাভ করা যায়। গত বছর এলাকার হাতে গোনা অল্প কয়েক জন চাষি পান চাষে ৬০ হাজার টাকা খরচ করে ৭০ হাজার থেকে ৮০ হাজার টাকার পান বিক্রি করেছেন।

এলাকার একাধিক পানচাষি জানালেন, এ এলাকার জন্য কর্মরত উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা পানচাষে তাদের প্রয়োজনীয় পরামর্শ দেন না। এ ব্যাপারে এলাকায় নিয়োজিত উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা খোদাজ্জেল হোসেন জানান, তিনি এলাকায় যান। পানের রোগ ও তার প্রতিকারে কেউ কেউ কথা বললেও অনেকে বলেন না। তিনি আরো বলেন, মেহেরপুর সদর উপজেলা কৃষি অফিসের উদ্যোগে পানের রোগ প্রতিরোধে চাষি ভাইদের জন্য করণীয় শীর্ষক লিফলেট বিতরণ করা হয়েছে। যা আমি নিজের হাতেই চাষিদের মাঝে বিতরণ করেছি।

মেহেরপুর জেলা কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, এ বছর জেলায় ৪৫২ হেক্টর জমিতে পানচাষ হচ্ছে। যেখানে গত বছর জেলায় ৩৫৩ হেক্টর জমিতে পানচাষ হয়েছিলো। এ বছর সদর উপজেলার নূরপুর ও পিরোজপুরসহ গাংনী উপজেলার ধানখোলা, হাড়াভাঙ্গা, কাজিপুর এলাকাতেও বেশি বেশি পানচাষ হয়েছে।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের উপপরিচালক শ্রী চৈতন্য কুমার দাস জানান, জেলায় পানচাষ বৃদ্ধি পেয়েছে কিন্তু উৎপাদন বৃদ্ধি পায়নি। আগে অল্প জমিতে বেশি বেশি পান উৎপন্ন হতো। বর্তমানে সেখানে বেশি জমিতে অল্প অল্প পান উৎপন্ন হচ্ছে। এর জন্য তিনি অনেকখানি পানচাষিদের দায়ী করে বলেন, বর্তমানে চাষিরা বেশি ফলনের আশায় জমিতে বেশি বেশি রাসায়নিক সার ব্যবহার করছেন। পানচাষ রাসায়নিক সার ব্যবহারের জন্য নয়। পানের জমি পরিশোধন দরকার। রাসায়নিক সার ব্যবহারে পানের পিলে রসালো থাকে না। শুকিয়ে যায়। জমিতে গোবর মাটির জৈব সারের পাশাপাশি ব্যবহার করতে হবে ভার্মি কম্পোস্ট (কেঁচো সার)। রোগ অনুযায়ী কৃষি অফিসের পরামর্শ অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে হবে, তবেই ভালো পান পাওয়া যাবে। আমরা তিনটি রোগ নির্ণয় করেছি। তার প্রতিকারে চাষিদের নিকট লিফলেট পৌঁছে দিয়েছি। এলাকাভিত্তিক চাষিদের নিয়ে উঠোন বৈঠকের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় আরও পরামর্শ দেবো।