মেহেরপুরের একজন সংগ্রামী বৃদ্ধ প্রতিবন্ধীর পথচলা

 

মহাসিন আলী: সারাজীবন সংগ্রাম করেছি। ছেলেমেয়েদের মাথা গোঁজার ঠাঁই করে দিয়েছি। মেয়েদের পাত্রস্থ করেছি। ৮০ বছর বয়স পার করেও কারো গলগ্রহ হতে চাই না। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত সংগ্রাম করে যাবো। নিজের ভাড়ায় চালিত অটোরিকশায় বসে কথাগুলো বললেন মেহেরপুর শহরের অতি পরিচিত মুখ মো. সুস্তর আলী ওরফে সুস্তর খোঁড়া (৮১)।

মেহেরপুর শহরের নতুন পোস্টঅফিসপাড়ার বাসিন্দা প্রতিবন্ধী সুস্তর আলী ওরফে সুস্তর খোঁড়া। তিনি প্রতিবন্ধী হয়েও কখনো কারো কাছে হাত পাতেননি। সারা জীবনই পরিশ্রম করেছেন। নিজের ৯ ছেলেমেয়ে বড় করেছেন। ৩ মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন। ৬ ছেলেসহ মেয়েদের প্রত্যেকের বাসবাসের জন্য ৩ কাঠা করে বাড়ি করার জমি কিনে দিয়েছেন। শেষ বয়সে স্ত্রী বিয়োগের পর নতুন বিয়ে করায় ছেলেরা তাকে বাড়ি ছাড়া করেছে। তিনি এখন ভাড়ায় চালিত অটোরিকশা চালাচ্ছেন। যাত্রী খোঁজে শহরের কোর্ট মোড়ে বসে থাকা অবস্থায় তার সাথে কথা হয়। তিনি গর্ব করে বলেন, প্রতিবন্ধী হয়েও তিনি স্বাবলম্বী।

সুস্তর আলী জানান, তিনি মেহেরপুরের মুজিবনগর উপজেলার পুরন্দরপুর গ্রামের মৃত এলেবাস শেখের ছেলে। ৪ বছর বয়সে তার তিনি পোলিও রোগে আক্রান্ত হন। চিকিৎসায় সুস্থ হলেও হারান বাম পা। পা হারালেও তার চলার পথ থেমে থাকেনি। তিনি অসম্ভবকে সম্ভব করেছেন। প্রতিবন্ধী এ মানুষটি তার কাজের ফিরিস্তি তুলে ধরে বলেন, প্রথম জীবনে ২০ বছর বয়সে চুয়াডাঙ্গার দামুড়হুদা উপজেলার পারকেষ্টপুর, গলায়দঁড়ি ও সুবলপুরে মাথাভাঙ্গা নদীর ঘাট ইজারা নিয়ে চালিয়েছেন। ১০ বছর ঘাট চালানোর পর তিনি নিজ গ্রামে ফিরে নরসুন্দরের (নাপিত) কাজ করেছেন। ১২ বছর এ কাজ করার পরে গ্রামে ৭-৮ বছর মুদিদোকান চালান। এরপরও নিজের দুটি ঘোড়ার গাড়ি ছিলো। তিনি ঘোড়ার গাড়ি চালাতেন। দেশ স্বাধীনের পরে তিনি মেহেরপুর শহরে আসেন এবং নতুন পোস্টঅফিসপাড়ায় জমি কিনে বাড়ি করেন। ১৯৭২ সালে তিনি মেহেরপুর শহরে বসে রায়-সরিসা কিনে ঘানি ভাঙিয়ে তেল বিক্রি করতেন। শহরের গুড়পট্টি এলাকায় ৩টি খাবার হোটেল করেন। পরে ছেলেমেয়েদের বড় করে তাদের মাথা গোঁজার ঠাঁই করে দিতে ওই হোটেলগুলো বিক্রি করে দিতে হয়। এরপর তিনি মেহেরপুর শহরের পাবলিক লাইব্রেরির সামনে চপ-সিঙ্গাড়া, পিঁয়াজু ভাজতেন। তখন তিনি তার হাতে চালিত রিকশা করে ওই স্থানে এসে চপ-সিঙ্গাড়া, পিঁয়াজু ভাজার কাজ করতেন। তার ওই ব্যবসার কদর ছিলো। তার পিঁয়াজু খেতে দূর-দূরান্ত থেকে লোক আসতেন। ১২ বছর এ ব্যবসা শেষে তিনি মেহেরপুর জেনারেল হাসপাতাল এলাকায় বরফ কল বসান। এ ব্যবসায় সফল হতে না পেরে তিনি বরফ কল বিক্রি করে দিয়েছেন।

সুস্তর আলী জানান, প্রথম জীবনে তিনি আমিরন নেছাকে স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করেন। তার ঘরে দু ছেলে ও এক মেয়ের রয়েছে। পরবর্তীতে প্রথম স্ত্রী আমিরন নেছার অনুমতি নিয়ে আর্জিয়া খাতুনকে দ্বিতীয় বিয়ে করেন। ওই ঘরে জন্ম নেয় ৪ ছেলে আর ২ মেয়ে। বিয়ের সময় দ্বিতীয় স্ত্রী আর্জিয়া খাতুনের নামে বসতবাড়ির জমি লিখে দেন। কিন্তু দুর্ভাগ্য তার। ৭ বছর আগে মারা গেছেন দ্বিতীয় স্ত্রী আর্জিয়া খাতুন। শেষ বয়সে তিনি শহরের ঘোষপাড়ার নিঃসন্তান স্বামী পরিত্যক্তা শাবানা খাতুনকে (৫০) বিয়ে করেছেন। এতেই বাড়ি থেকে বিতাড়িত হতে হয়েছে তাকে। সুস্তর আলী জানান, মৃত স্ত্রী আর্জিয়ার ছেলেরা তাকে বাড়ি থেকে বিতাড়িত করেছে। তিনি আরো বলেন, যুগ পাল্টিয়েছে, এযুগের মেয়ে-ছেলে বউরা বৃদ্ধ বয়সে বাবাকে দেখে না। তাই বাধ্য হয়ে বৃদ্ধ বয়সে তৃতীয় বিয়ে করতে হয়েছে। বর্তমানে তিনি অন্যের বাড়িতে ভাড়ায় আছেন।

সুস্তর আলী ওরফে সুস্তর খোঁড়া ৬/৭ মাস আগে ৪০ হাজার টাকা খরচ করে ব্যাটারি চালিত অটোরিকশা তৈরি করে নিয়েছেন। প্রতিদিন তিনি তার অটোরিকশা নিয়ে শহরে আসেন। সারাদিনে তিনি ২শ-৩শ টাকা আয় করেন। তিনি বলেন, এতেই তার সংসার চলে যায়। তিনি গর্বভরে বলেন, ছোট থেকে কোনো দিনও নিজেকে প্রতিবন্ধী ভাবেনি। কারো কাছে হাত পাতেনি। অসহায় মানুষদের সাহায্য করেছি। কারো অনুদান সাহায্য হিসেবে নেয়নি।

শিক্ষক সেকেন্দার আলী, সাংবাদিক আতাউর রহমান, ব্যবসায়ী ফারুক হোসেন জানালেন, ছোট থেকে দেখেছি প্রতিবন্ধী সুস্তর আলীকে পরিশ্রম করে যেতে। তিনি এ বয়সেও পরিশ্রম করছেন। অন্যের করুনা গ্রহণ না করেও এ বয়সে অটোরিকশা চালিয়ে আয়-রোজগার করছেন। আমাদের সমাজে তার চেয়ে ভালো উদাহরণ আর কে হতে পারে?