সাভারে গেছো মানবী

 

স্টাফ রিপোর্টার: সাভারের সামরিক খামারের একটি গাছের নিচ দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় হঠাত গাছ থেকে ভেসে আসা নারীকণ্ঠ শুনে চমকে ওঠেন কেরামত আলী। মনে মনে খোদাকে ডাকতে থাকেন, আর জোর কদমে পা চালান। যতোই পায়ের জোর বাড়ে, কণ্ঠস্বরও যেন ততো কাছে আসে। এই বুঝি তাকে ধরে ফেলে। শেষে দৌঁড়ে কোনোমতে রেডিও কলোনির কাছাকাছি পৌঁছে বিষয়টি নিকটজনদের জানান। এ-কান ও-কান করে তা রাষ্ট্র হয়ে যায়। খবর শুনে প্রথমে পুলিশ, পরে ফায়ার ব্রিগেড ও সেনা সদস্যরা যান ঘটনাস্থলে। টর্চের আলোতে দেখা যায়, গাছের মগডালে ভর করেছে জলজ্যান্ত এক নারীর প্রতিচ্ছায়া। কেবল কেরামত আলী নন, এই ভূতের ছায়া মাড়িয়েছেন অনেকেই। তবে কেউ ভ্রম, কেউবা ভূত ভেবে বিষয়টি নিজেদের মধ্যে রেখেছিলেন এতোদিন। তবে বিভিন্ন বাহিনীর যৌথ তৎপরতায় ওই নারীকে গাছ থেকে নামানোর চেষ্টায় বেরিয়ে আসে তার গেছো মানবী পরিচয়।

সাভার মডেল থানার পরিদর্শক (তদন্ত) দীপক কুমার সাহা জানান, গেছো মানবীর খবর পেয়ে রাত ৯টায় ঘটনাস্থলে পুলিশ নিয়ে যাই আমরা। নিজেরা অনেকক্ষণ ডাকাডাকি করে তাকে গাছ থেকে নেমে আসতে বলি। পরে তার নাম জানা যায় আমেনা (৪০)। একপর্যায়ে নিজেকে জিন দাবি করে ওই নারী হুমকি দিয়ে বলেন, তাকে গাছ থেকে নামানোর চেষ্টা করলে তিনি ঘাড় মটকে দেবেন। পরে তাকে উদ্ধারের জন্য খবর দেই ফায়ার ব্রিগেডে। সাইরেন বাজিয়ে তারা আসতে না আসতেই সেখানে চলে আসেন ঊর্ধ্বতন সেনা কর্মকর্তারা। সাভার ফায়ার সার্ভিসের স্টেশন অফিসার শাহাদাৎ হোসেন বলেন, ওই নারীকে গাছ থেকে নেমে আসতে অনুরোধ করি। কিন্তু তিনি গর্জন করে আমাদের শাপ-শাপান্ত করতে থাকেন। নিজেকে জিন দাবি করে তিনি বলতে থাকেন, কেউ জোর করে তাকে নামানোর চেষ্টা করলে তার পরিবারের অমঙ্গল হবে। লাফিয়ে পড়ারও হুমকি দিতে থাকেন তিনি। অসাবধানতায় গাছ থেকে পড়ে যেতে পারেন এ আশঙ্কায় আমরা সব প্রস্তুতি নিয়ে রাত পার করে দিই। এরপর খবর পেয়ে ওই নারীর ছেলে মঞ্জিল হোসেন ঘটনাস্থলে ছুটে গিয়ে জানান, সময় হলে তিনি নিজের ইচ্ছায় গাছ থেকে নেমে আসবেন।

রেডিও কলোনির বাসিন্দা মঞ্জিল হোসেন বলেন, গাছ থেকে ভূত নামানোর খবর শুনেই আমি ছুটে যাই সামরিক খামারে। মাকে নেমে আসতে বলি। কিন্তু কোনো কথাই শোনেন না মা। যদিও আমরা অবাক হইনি। শান্ত হয়েই আমরা পরিস্থিতিকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করি। মঞ্জিল বলেন, প্রায় এক যুগ ধরে প্রায়শই গাছে রাত্রিযাপন করছেন আমার মা। তবে লজ্জায় বিষয়টি আমরা প্রকাশ করিনি এতোদিন। এক বেলায় গাছে উঠলে পরের বেলায় নির্দিষ্ট সময়ে নেমে আসেন তিনি। এটাই মায়ের নিয়ম। আমরা প্রথম প্রথম খোঁজ নিতাম। গাছে গাছে টর্চ লাগিয়ে মাকে খুঁজতাম। এখন বিষয়টি গা সওয়া হয়ে গেছে। তিনি আরও বলেন, অনেক বলেছেন মানসিক ব্যাধি। আধুনিক চিকিৎসা করানোর সামর্থ্য আমাদের নেই। কবিরাজের শরণাপন্ন হয়েছি, তাবিজ-কবজ দিয়েছি। কিন্তু সেরে ওঠেননি।

আমেনা বেগমের মেয়ে রুবিনা বেগম বলেন, মাকে যখন জিনে আসর করে, তখন আর তাকে ঘরে রাখা যায় না। ছুটে যান গাছে গাছে। সেখানেই বিড়বিড় করে কথা বলতে শোনা যায় তাকে। গাছ থেকে জোর করে নামালেই তিনি অজ্ঞান হয়ে পড়েন। কিছুক্ষণের বিশ্রামে তিনি আবার স্বাভাবিক হয়ে ওঠেন। সঙ্গী জিনের টানেই মা রাত-বিরাতে গাছে ছুটে যান। গাছেই রাত কাটে তার। এ সময়টা মায়ের কথার সুর নাকি গলায় শোনা যায়। পরিবর্তিত সুর শুনে আমরা মনে করি মা জিনের সাথে কথা বলছেন। তিনি আরও বলেন, বৃহস্পতিবার দুপুর থেকেই আচরণে হঠাত পরিবর্তন আসে মায়ের। পরিবর্তন হতে থাকে গলার সুরে। তখন যেন মাকে আর চেনাই যায় না। আমরা বুঝতে পারি তার ওপর জিন ভর করেছে। বিকেল ৩টা নাগাদ ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার জন্য ব্যাকুল হয়ে পড়েন তিনি। একপর্যায়ে আমাদের চোখকে ফাঁকি দিয়েই উধাও হয়ে যান মা। পরে রাতে আবিষ্কার করি গাছের মগডালে রয়েছেন তিনি। রাতে টহলে থাকা এক পুলিশ সদস্য জানান, সব চেষ্টা ব্যর্থ হলে আমরা নিজেরা একপর্যায়ে পদক্ষেপ নেই ওই নারীকে গাছ থেকে নামিয়ে আনতে। একজন গাছে ওঠামাত্রই প্রচণ্ড শক্তিতে তিনি গাছে ঝাঁকুনি দিতে থাকেন। শেষে ভোরে শান্ত আর স্বাভাবিকভাবে গাছ থেকে নেমে আসেন গেছো মানবী। এরপর ছেলে আর মেয়ের হাত ধরেই বাড়ির পথে হাঁটা দেন তিনি। এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সাইকোলজি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক আবদুর রহিম জানান, এটা অসুখ, প্রাথমিকভাবে মনে হচ্ছে ওই নারী সিজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্ত। গ্রামে অশিক্ষা আর কুসংস্কারের প্রভাবে এসব রোগীর অনেকেই জিনে ধরেছে বলে মনে করেন। সিজোফ্রেনিক রোগী যথাযথ চিকিৎসায় সুস্থ হয়ে ওঠেন।