যশোরে তিনটি হায় হায় কোম্পানির আড়াই হাজার কোটি টাকা লোপাট

বিপাকে মাঠকর্মী স্থানীয় মসজিদের ইমাম ও মুয়াজ্জিন

 

স্টাফ রিপোর্টার: যশোরে ৩টি হায় হায় কোম্পানির খপ্পরে পড়ে পথে বসেছে ১০ হাজার মানুষ। ধর্মের দোহাই দিয়ে কোম্পানির কর্তারা হাতিয়ে নিয়েছে কমপক্ষে আড়াই হাজার কোটি টাকা। রাতারাতি অফিসে তালা ঝুলিয়ে লাপাত্তা কোম্পানির স্টাফরাও। তবে স্থানীয় হওয়ায় বিপাকে পড়েছেন বেশ কয়েকজন মাঠকর্মী মসজিদের ইমাম ও মুয়াজ্জিন। ক্ষতিগ্রস্তরা এসব মাঠকর্মীর বিরুদ্ধে থানা-পুলিশ করায় অনেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। আবার অনেকে থানা-পুলিশকে ম্যানেজ করে চলার চেষ্টা করছেন।

এদিকে কমপক্ষে আড়াই হাজার কোটি টাকা লোপাটের এ ঘটনা তদন্তে মাঠে নেমেছে সরকারের দুটি গোয়েন্দা সংস্থার মাঠকর্মী। ইতোমধ্যে তারা কোম্পানির যাবতীয় তথ্য সংগ্রহ করে অনুসন্ধানে কাজ শুরু করেছেন। যশোর এহসান এস সোসাইটি, এহসান রিয়েল এস্টেট ও এহসান মাল্টিপারপাস নামে ৩টি কোম্পানির কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে গ্রাহকদের ২৭০০ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ উঠেছে। জীবনের সর্বস্ব হারিয়ে পথে বসা এসব মানুষ এখন পাগলপ্রায়। হারানো অর্থ ফেরত পেতে তারা এখন মরিয়া হয়ে উঠেছেন। ধরনা দিচ্ছেন বিভিন্ন সরকারি আর বেসরকারি সংস্থার দ্বারে দ্বারে। যাচ্ছেন সংবাদকর্মীদের। করছেন মানববন্ধন আর সংবাদ সম্মেলন। অভিযোগ দিচ্ছেন থানা-পুলিশে। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না।

এদিকে হাজার হাজার সর্বহারা মানুষের এ বেদনাকে পুঁজি করে মাঠে নেমেছেন যশোর কোতোয়ালি থানার একদল পুলিশও। অসহায় মানুষদের পাশে দাঁড়ানোর পরিবর্তে তারা কোম্পানির প্রতারক কর্মীদের পক্ষ নিয়ে মেতে উঠেছেন অর্থ বাণিজ্যে। এসব পুলিশ সদস্য প্রতারকদের পক্ষ হয়ে ক্ষতিগ্রস্ত গ্রাহকদের নানাভাবে হয়রানি করছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, ২০০১ সালে মাগুরার মোহাম্মদপুরের বাসিন্দা ও কৃষি ব্যাংকের সাবেক এজিএম কাজী রবিউল ইসলাম এহসান সোসাইটি নামে একটি সামাজিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। ২০০৩ সালে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন এহসান রিয়েল এস্টেট নামের আরেকটি প্রতিষ্ঠান। যশোরের বারান্দীপাড়ায় তিনি এ প্রতিষ্ঠানের প্রধান কার্যালয় স্থাপন করে ইসলামী শরীয়াভিত্তিক আর্থিক কার্যক্রম পরিচালনার ঘোষণা দেন। সমবায় থেকে রেজিস্ট্রেশন প্রাপ্তির পর তিনি স্থানীয় বিভিন্ন মসজিদের ইমাম, মুয়াজ্জিন ও মাদরাসার শিক্ষকদের কমিশন এজেন্ট হিসেবে নিয়োগ দেন। গঠন করেন ২০ সদস্য বিশিষ্ট শরীয়া বোর্ড। এ বোর্ডের তৈরি করা নিয়ম-কানুনের ওপর ভিত্তি করে পরিচালিত হতে থাকে এহসান সোসাইটি ও এহসান রিয়েল এস্টেট। বনিবনা না হওয়ার কারণে এহসান সোসাইটির পরিচালক মুফতি জুনায়েদ ও মুফতি আতাউল্লাহ ২০০৭ সালে এহসান মাল্টিপারপাস নামের আরেকটি প্রতিষ্ঠান খুলে বসেন। এসব প্রতিষ্ঠানের উদ্যোক্তারা প্রচলিত ব্যাংকিং ব্যবস্থাপনার বিরুদ্ধে কোরান ও হাদিসের নানা আয়াত তুলে ধরে তারা প্রচারণা চালিয়ে টার্গেট গ্রুপকে মোটিভেশন করতে শুরু করেন। ফলে ইহকালে সৎ উপায়ে অর্থ উপার্জন আর পরকালে প্রশান্তির আশায় জীবনের শেষ উপার্জন ‘এহসান সোসাইটি, এহসান রিয়েল এস্টেট’ ও ‘এহসান মাল্টিপারপাস’ নামের ৩টি প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগ করেছিলেন যশোরের কমপক্ষে ২০ হাজার গ্রাহক। বিনিয়োগের তিন থেকে চার মাস নিয়মিত লভ্যাংশ পেলেও গত ৮ মাস ধরে গ্রাহকরা কোনো টাকা পাচ্ছেন না। জীবনের শেষ সম্বল হারানোর আশঙ্কাসহ গত ৮ মাস ধরে লভ্যাংশের টাকা না পাওয়ায় মানবেতর জীবনযাপন করছেন অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মচারী, ব্যবসায়ী, চাকরিজীবী ও বিধবা মানুষগুলো। যশোর সদর উপজেলার বালিয়া ভেকুটিয়া গ্রামের মোহাম্মদ হানিফ ওই ৩টি প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগ করেন ৬ লাখ টাকা, একই এলাকার জয়নাল আবেদীন দেন পাঁচ লাখ টাকা, শহরের বারান্দীপাড়ার ইজিবাইকচালক তরিকুল ইসলাম দেন এক লাখ ১৩ হাজার টাকা, বিধবা কুলসুম বেগম দেন ৮ লাখ টাকা, গৃহপরিচারিকা মনোয়ারা বেগম দেন দেড় লাখ টাকা, রুপদিয়ার শারমিন ও নাসরিন নামের ২ বোন দেন ৮ লাখ টাকা, হামিরুন নেছা দেন ৫ লাখ টাকা, বড় বাজারের ইদ্রিস আলী দেন ২০ লাখ টাকা, মাছ ব্যবসায়ী টগর দেন ৪০ লাখ টাকা, নঙ্গরপুরের খুকু মনি স্বামীর বিদেশ থেকে পাঠানো ১০ লাখ টাকাও লগ্নি করেন এ প্রতিষ্ঠানে। ওই গ্রাহকরা জানান, প্রতি লাখে মাসে ১৪০০ থেকে ১৬০০ টাকা লভ্যাংশ দেয়া হবে মর্মে তাদের কাছ থেকে টাকা গ্রহণ করে এহসান সোসাইটি, এহসান রিয়েল এস্টেট ও এহসান মাল্টিপারপাস কর্তৃপক্ষ। টাকা নেয়ার পর তাদের প্রথম তিন থেকে চার মাস নিয়মিত লভ্যাংশ দেয়া হয়। কিন্তু গত ৮ মাস তাদের কোনো টাকাই দেয়া হচ্ছে না।