জিএসপি সুবিধা ফিরে পাচ্ছে বাংলাদেশ

 

স্টাফ রিপোর্টার: পোশাক শিল্পের সোস্যাল কমপ্লায়েন্স উন্নয়নে বাংলাদেশ দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে। তৈরি পোশাকের প্রধান ক্রেতা ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এ খাতের অগ্রগতিতে এখন সন্তুষ্ট। যুক্তরাষ্ট্রের দেয়া বাংলাদেশ অ্যাকশন প্লানের ১৬টি শর্ত প্রায় পুরোপুরি পূরণ করতে সক্ষম হয়েছে বাংলাদেশ। এছাড়া নিরাপদ কর্মপরিবেশ তৈরি এবং শ্রম অধিকার রক্ষায় সরকারি পদক্ষেপে ইইউ’র আস্থা অনেকাংশে ফিরে আসায় সরকার আশা করছে, পোশাক রফতানিতে জিএসপি বা শুল্কমুক্ত বাজার সুবিধা ফিরে পাবে বাংলাদেশ। একই সাথে জিএসপি নিয়ে যে সঙ্কট তৈরি হয়েছে তা দূর হবে। এছাড়া জিএসপি নিয়ে বাংলাদেশের ওপর যে চাপ রয়েছে তাও কেটে যাবে।

জানা গেছে, আগামী ২০ অক্টোবর ব্রাসেলসে অনুষ্ঠিতব্য বাংলাদেশ গ্লোবাল সাসটেনাবিলিটি কমপ্যাক্ট শীর্ষক বৈঠকে ইইউ, আইএলও, উন্নয়ন সহযোগী এবং ইউএসএ’র ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা পোশাক খাতের অগ্রগতি এবং জিএসপি নিয়ে আলোচনা করবেন। ওই বৈঠকের পর বাংলাদেশের পোশাক শিল্প নিয়ে কয়েকটি ইতিবাচক সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ, বাণিজ্য সচিব হেদায়েতুল্লাহ আল মামুন এবং পররাষ্ট্র সচিব শহীদুল হকের ওই বৈঠকে যোগ দেয়ার কথা রয়েছে। এছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে ওই বৈঠকে প্রতিনিধিত্ব করবেন বাংলাদেশে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান ডব্লিউ মজেনা। এ প্রসঙ্গে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব হেদায়েতুল্লাহ আল মামুন সাংবাদিকদের বলেন, বাংলাদেশ গ্লোবাল সাসটেনাবিলিটি কমপ্যাক্ট শীর্ষক যে বৈঠকটি ব্রাসেলসে অনুষ্ঠিত হবে তার অর্থনৈতিক গুরুত্ব অনেক বেশি। ইতোমধ্যে সোস্যাল কমপ্লায়েন্স উন্নয়নে বাংলাদেশর অগ্রগতিতে ইইউ এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছে। যদিও এখন সকল দেশের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের জিএসপি সুবিধা স্থগিত রয়েছে। তবে ওই সুবিধা চালু হলে জিএসপি সুবিধা ফিরে পাবে বাংলাদেশ। তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের দেয়া বাংলাদেশ অ্যাকশন প্লানের ১৬টি শর্ত প্রায় পূরণ করা হয়েছে। এছাড়া নিরাপদ কর্মপরিবেশ তৈরি এবং শ্রম অধিকার রক্ষায় সরকারিভাবে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। ইতোমধ্যে এ শিল্পের উদ্যোক্তারা সরকারি পদক্ষেপ বাস্তবায়নে বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন। সবকিছু মিলে বাংলাদেশর অগ্রগতিতে ইইউ এবং যুক্তরাষ্ট্র এখন সন্তুষ্ট। তাই আশা করা হচ্ছে, যথাসময়ে জিএসপি সুবিধা ফিরে পাবে বাংলাদেশ।

জানা গেছে, সাভারে রানা প্লাজা ভবন ধসের পর ১ হাজারের বেশি পোশাক শ্রমিকের প্রাণহানির প্রেক্ষাপটে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে স্যোসাল কমপ্লায়েন্স ফোরাম অন আরএমজি গঠন করেছিলো। দেশের রফতানি আয়ের প্রধান খাত পোশাক শিল্পের মালিক, শ্রমিক, বিশেষজ্ঞ ও সরকারি প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে এ ফোরাম গঠিত হয়েছে। রানা প্লাজা ধসের পর ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স এবং শ্রম মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে প্রায় সাড়ে ৩ হাজার কারখানা পরিদর্শন করা হয়েছে। এর মধ্যে ৯৪৩টি ত্রুটি ও ঝুঁকিপূর্ণ কারখানা চিহ্নিত করা হয়। যদিও পোশাক শিল্প মালিকদের শীর্ষ সংগঠন বিজিএমইএ ও বিকেএমইএ’র হিসাবে, সারাদেশে প্রায় ৭ হাজার পোশাক কারখানা রয়েছে। বেশি ত্রুটিপূর্ণ হওয়ায় ঢাকা ও চট্টগ্রামে এরই মধ্যে ২০টি কারখানা বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। ওই সময় কারখানায় অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থায় ত্রুটি কিংবা ভবনে কোন সমস্যা আছে কি-না তা খতিয়ে দেখা হয়।

বিজিএমই’র হিসেবে সারাদেশে ৪ হাজারেরও বেশি পোশাক কারখানা চালু রয়েছে। সাভারের রানা প্লাজা ধস, তাজরিন ফ্যাশন্সে অগ্নিকাণ্ডে বহু মানুষ হতাহতের পর ফায়ার সার্ভিস ও শ্রম মন্ত্রণালয়ের গঠিত তদন্ত কমিটি এবং টাস্কফোর্স কারখানা পরিদর্শনের পদক্ষেপ নেয়। কারখানাগুলো সরেজমিন পরিদর্শন শেষে যে সব কারখানা ত্রুটিপূর্ণ, তাদের ব্যাপারে বিজিএমইএ এবং বিকেএমইএকে অবহিত করা হয়েছে। পাশাপাশি কারখানাগুলোর ত্রুটি দূর করার জন্যও সময় দেয়া হয়েছে।

এ প্রসঙ্গে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, ত্রুটিপূর্ণ কারখানাগুলোর মধ্যে ইতোমধ্যে ঢাকায় ১৬টি এবং চট্টগ্রামে ৪টি কারখানা বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। এছাড়া ত্রুটিপূর্ণ হওয়ায় নারায়ণগঞ্জে মালিকরা নিজেই দুটি কারখানা বন্ধ করে দিয়েছেন। তিনি বলেন, অর্থনীতি এবং মানবিক বিষয়ের কথা মাথায় রেখে আমাদের চিন্তা করতে হবে, যেন ভবিষ্যতে রানা প্লাজা ও তাজরিনের মতো দুর্ঘটনা আর না ঘটে। তাজরিনের শ্রমিকদের দুঃখজনক মৃত্যু মালিকদের চোখ-কান খুলে দিয়েছে বলে স্বীকার করছেন এ শিল্পের উদ্যোক্তারা। এ ঘটনায় উদ্যোক্তারা এখন অনেক সতর্ক। তারা বলছেন, কোনো বিষয়ে মানের সাথে আপস করে ব্যবসা করার সুযোগ আর নেই। শতভাগ কমপ্লায়েন্ট হয়েই ব্যবসা করতে হবে।

ওই দুর্ঘটনার পর ইউরোপের ক্রেতা জোট অ্যাকর্ড ও উত্তর আমেরিকার ক্রেতা জোট অ্যালায়েন্স মিলে বাংলাদেশের পোশাক কারখানা নিরীক্ষা করে উন্নয়নের জন্য সহায়তা দেয়ার ঘোষণা দেয়। ইতোমধ্যে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থাও (আইএলও) তাদের নিরীক্ষা কার্যক্রম শুরু করেছে। পোশাক কারখানা পরিদর্শনের জন্য একটি অভিন্ন মানদ- চূড়ান্ত করা হয়েছে। অ্যাকর্ড, অ্যালায়েন্স ও আইএলওর নিরীক্ষা কার্যক্রমের পর পোশাক খাতে একটি পরিবর্তন আসবে বলে আশা করা হচ্ছে। বাংলাদেশ পাবে কাঙ্ক্ষিত নিরাপদ কর্মপরিবেশযুক্ত পোশাক কারখানা।

জানা গেছে, বিশ্বায়নের যুগে শিল্পায়ন এবং আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে কারখানার কমপ্লায়েন্স নিশ্চিত করতে ইতোমধ্যে জাতীয় পেশাগত স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা নীতিমালা ২০১৩’র খসড়ার চূড়ান্ত অনুমোদন দিয়েছে মন্ত্রিসভা। নীতিমালায় সরকার, মালিক পক্ষ, নিয়োগকর্তার ভূমিকা, ট্রেড ইউনিয়ন ও শ্রমিকদের ভূমিকা উল্লেখ রয়েছে। এতে শ্রমিকদের ঝুঁকিপূর্ণ কাজ চিহ্নিত করে নিরাপদ করতে সচেতনতা, মৌলিক প্রশিক্ষণ, নিরাপত্তার যন্ত্রপাতি সরবরাহ এবং স্বাস্থ্যগত নিরাপত্তা সম্পর্কে তথ্য জানানোর বিধান রয়েছে।

এ প্রসঙ্গে বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ বলেন, এ পর্যন্ত প্রায় ১ হাজার ৯০০ কারখানা পরিদর্শন কাজ সম্পন্ন হয়েছে। এর মধ্যে ১৯টি কারখানায় ত্রুটি পাওয়া গেছে। এতে ঝুঁকির পরিমাণ শতকরা ২ ভাগের কম। আন্তর্জাতিক নিয়ম অনুযায়ী এ ধরনের ঝুঁকি শতকরা ২ ভাগের বেশি গ্রহণযোগ্য। ত্রুটিগুলো সমাধানের কাজ চলছে। সে মোতাবেক বাংলাদেশের তৈরি পোশাক কারখানাগুলোর অবস্থা ভাল।

তিনি বলেন, দেশি-বিদেশি প্রচার মাধ্যমে এ তথ্যগুলো প্রচার হওয়া প্রয়োজন। দেশের সুনাম ক্ষুণ্ণ না করে, দেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করতে প্রচার মাধ্যমকে দায়িত্বশীল ভূমিকা রাখতে হবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে ডিউটি ফ্রি, কোটা ফ্রি সুবিধা দেয় না। তৈরি পোশাক রফতানির ওপর জিএসপি সুবিধা দেয় না। যদিও বর্তমানে কোনো দেশকেই জিএসপি সুবিধা দেয়া হচ্ছে না। মার্কিন কংগ্রেসে জিএসপি সুবিধা প্রদানের সিদ্ধান্ত হলে বাংলাদেশ সে সুবিধা পাবে বলে আমরা আশাবাদী। বর্তমান চীন ৫ হাজার আইটেম পণ্য রফতানিতে শুল্কমুক্ত সুবিধা দিচ্ছে। এছাড়া চিলি ২০১৫ সালের বাংলাদেশি পণ্য ডিউটি ফ্রি প্রবেশের সুবিধা দেবে।

জিএসপি স্কিম কেন: স্বল্পোন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোকে বাণিজ্য সহায়তা দেয়ার লক্ষ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জিএসপি (জেনারাইলজড সিস্টেম অব প্রেফারেন্স) স্কিম চালু করে ১৯৭৬ সালে। উদ্দেশ্য ছিলো- এ সহায়তার মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর রফতানি আয় বৃদ্ধি পাবে, যা তাদের সার্বিক অর্থনৈতিক উন্নয়নে অবদান রাখবে। বর্তমানে উন্নয়নশীল দেশগুলো যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় সাড়ে ৩ হাজার পণ্য রফতানির ক্ষেত্রে এ সুবিধা পেয়ে থাকে এবং স্বল্পোন্নত দেশগুলো অতিরিক্ত আরও ১ হাজার ৫০০টি পণ্যের ক্ষেত্রে শুল্কমুক্ত সুবিধা পাচ্ছে। স্বল্পোন্নত দেশগুলোর জন্য স্কিমটির বিশেষত তারা এর আওতায় শূন্য শুল্ক সুবিধায় পণ্য রফতানি করতে পারে। বাংলাদেশও কিছু পণ্য রফতানির ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রে প্রথম থেকেই জিএসপি স্কিমের আওতায় শুল্কমুক্ত সুবিধা পেয়ে আসছে। তবে যে ৫ হাজার পণ্য জিএসপি সুবিধার আওতায় যুক্তরাষ্ট্রে রফতানি করা হয় তার মধ্যে অধিকাংশ তৈরি পোশাক সামগ্রী নেই। ফলে বাংলাদেশের মতো যেসব দেশের মূল রফতানি পণ্য তৈরি পোশাক, তাদের জন্য এ সুযোগ সদ্ব্যবহারের সুযোগ সীমিত। যুক্তরাষ্ট্রে মোট রফতানির আর্থিক মূল্য প্রায় ৪৯০ কোটি ডলার, যার মধ্যে প্রায় ৯৩ শতাংশই আসে তৈরি পোশাক রফতানি থেকে। বাস্তবে রফতানিকৃত বাংলাদেশি পণ্যগুলোর কোনোটিই যুক্তরাষ্ট্রে জিএসপি সুবিধা পেতো না। তৈরি পোশাকের বাইরে বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে রফতানিকৃত চিংড়ি, সবজি এবং পাট ও পাটজাতসহ কিছু কিছু পণ্যের ক্ষেত্রে শুল্ক নেই। যুক্তরাষ্ট্রে রফতানিকৃত মোট পণ্যের কেবল শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ পণ্যে বাংলাদেশ জিএসপি সুবিধা পায়।

এ প্রসঙ্গে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ডব্লিউটিও সেলের পরিচালক এসএম নূরুল আলম বলেন, পোশাক রফতানিতেও যাতে যুক্তরাষ্ট্র সরকার বাংলাদেশকে জিএসপি সুবিধা দেয় আমরা সেই চেষ্টা করছি। ডব্লিউটিও’র বালি ঘোষণা অনুযায়ী স্বল্পোন্নত বা এলডিসি দেশ হিসেবে বাংলাদেশ জিএসপি সুবিধা পাওয়ার অধিকার রাখে। কিন্তু বাংলাদেশ পোশাক রফতানিতে কখনও জিএসপি সুবিধা পায়নি। এবার সেই চেষ্টা চলছে। এ লক্ষ্যে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় কাজ শুরু করেছে। প্রয়োজনে একটি রোডম্যাপ করে তা সরকারের পক্ষ থেকে ডব্লিউটিও’র কাছে তুলে ধরা হবে। তিনি বলেন, আমরা আশা করছি, সরকারের এ উদ্যোগের ফলে হয়তো পোশাক রফতানিতেও জিএসপি সুবিধা পাওয়া যাবে।