হাতুড়ে লোকের হাতে নষ্ট হয় হাজার কোটি টাকার চামড়া

 

স্টাফ রিপোর্টার: কোরবানি দেয়ার বিষয়টি যতোটা গুরুত্বের সাথে দেখা হয়, জবাই করা পশুর চামড়া সংগ্রহের প্রক্রিয়াটি নিয়ে ততোটা মনোযোগ দেখা যায় না। এদিকটি এক প্রকার অবহেলিতই থাকে। অথচ দেশে-বিদেশে পশুর চামড়ার প্রায় ২২ হাজার কোটি টাকার বাজার রয়েছে। এ চাহিদার প্রায় ৫০ শতাংশ জোগান মেলে কোরবানি থেকে।
উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে, চামড়া ছাড়ানোয় দক্ষতার অভাবে কোরবানিতে পাওয়া পশুর চামড়ার ১৮ থেকে ২০ শতাংশই প্রতিবছর নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। কারণ জবাইয়ের পর পশুর গা থেকে সঠিক পদ্ধতিতে চামড়া ছাড়ানো হয় না। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে অপরিকল্পিতভাবে এবং অনভিজ্ঞ লোকজন দিয়ে এ কাজটি করা হয়। এতে ফুটোফাটা হয়ে বা ছুরির অস্বাভাবিক আঁচড়ে চামড়ার মান নষ্ট হয়ে যায়। শুধু তাই নয়, ছাড়ানো চামড়া সঠিক প্রক্রিয়ায় রক্ষণাবেক্ষণ ও তা দীর্ঘমেয়াদে সংগ্রহে রাখার ক্ষেত্রেও দারুণ উদাসীনতা দেখা যায়। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের অতি মুনাফা প্রবণতার কারণে পরিমাণ মতো লবণ প্রয়োগে কার্পণ্য এবং পরিবহনে দীর্ঘসূত্রতা ও সঠিক আর্দ্রতায় সংরক্ষণ না রাখায় বহু চামড়া ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এসব কারণে প্রতিবছর কোরবানির সময় যে পরিমাণ চামড়া নষ্ট হচ্ছে তার মূল্য প্রায় হাজার কোটি টাকা।

কোরবানির আগে নানাভাবে প্রচার চালিয়ে চামড়া ছাড়ানোর বিষয়ে দিকনির্দেশনা দিয়ে সবাইকে সচেতন করা গেলে এ ক্ষতি কমানো সম্ভব হতো বলে সংশ্লিষ্টদের অভিমত। বর্তমানে রফতানি খাতে চামড়ার অবদান ৯ শতাংশের বেশি। এর আন্তর্জাতিক বাজার ১১ হাজার কোটি টাকার বেশি। অভ্যন্তরীণ বাজারেও রয়েছে প্রায় সমপরিমাণ চাহিদা।

কোরবানির পশু কেনাবেচা ঘিরে এখন সারা দেশেই এক ধরনের ব্যস্ত ও উৎসবমুখর পরিবেশ বিরাজ করছে। প্রশাসন ব্যস্ত পশুর হাটগুলোর নিরাপত্তা নিয়ে। আড়তদার, ফড়িয়া, দালাল, মৌসুমি ব্যবসায়ী, ট্যানারি মালিক এবং রফতানিকারকরা ব্যস্ত কোরবানির সময় যত বেশি সম্ভব পশুর চামড়া কিনে নেয়ার আয়োজনে। কিভাবে কম দামে চামড়া কেনা যায় তা নিয়েও চলছে নানা কারসাজি। কিন্তু কিভাবে পশুর গা থেকে দক্ষতার সঙ্গে চামড়া ছাড়ানোর মাধ্যমে বিপুল ক্ষতির হাত থেকে এই খাতটিকে রক্ষা করা যায় তা নিয়ে কারও মাথাব্যথা নেই। সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগও এ বিষয়ে একেবারে নির্বিকার। চামড়া সংগ্রহে তৃণমূল পর্যায়ে জনসচেতনতা বাড়ানো, যথাযথ প্রশিক্ষণ দেয়ার সরকারি কোনো কার্যক্রম একেবারেই নেই।

লেদার ইঞ্জিনিয়ার্স এন্ড টেকনোলজি সোসাইটি, বাংলাদেশের এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বেপারীরা অতি মুনাফার জন্য লবণের পেছনে ২০/২৫ টাকার খরচ বাঁচাতে গিয়ে দুই থেকে তিন হাজার টাকা মূল্যমানের চামড়া নিজের অজান্তেই খারাপ করে দিচ্ছেন। ছাড়ানোর পর ৪ থেকে ৫ ঘণ্টার মধ্যেই কাঁচা চামড়ায় লবণ দিতে হয়। গরুর চামড়া হলে ৩৫ শতাংশ এবং অন্যান্য পশুর চামড়া হলে ৪০ শতাংশ বিশুদ্ধ লবণ প্রয়োগ করতে হয়। মোটা-পাতলা বুঝে ৪ ডিগ্রি থেকে ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় তা সংরক্ষণ করতে হয়। কিন্তু অতিমুনাফা, পরিবহনে বিলম্ব এবং উদাসীনতার কারণে অনেক ক্ষেত্রেই সুচারুভাবে এ প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন করা হয় না। ফলে প্রতিবছর ১৮ থেকে ২০ শতাংশ চামড়াই নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। সংশ্লিষ্ট খাতের বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রতিবছরই কোরবানির হার বাড়ছে। বাড়ছে চামড়ার আন্তর্জাতিক বাজারও। কিন্তু কোরবানি করা সব পশু থেকে সঠিক পদ্ধতিতে চামড়া ছাড়ানো হচ্ছে না। এর জন্য তারা চামড়া ছাড়ানোর কাজে সংশ্লিষ্টদের সম্পূর্ণ অনভিজ্ঞতা ও অসচেতনতাকেই দায়ী করেন। এ সমস্যা থেকে উত্তরণে তারা মাঠপর্যায়ে বিভিন্ন কর্মশালা আয়োজনের পরামর্শ দেন।