মন্ত্রী লতিফ সিদ্দিকীকে বাদের সিদ্ধান্ত : হারাচ্ছেন আ.লীগের প্রেসিডিয়ামের পদও

 

অনুতাপ করার কিছু নেই : বক্তব্য প্রত্যাহারের প্রশ্নই আসে না : লতিফ সিদ্দিকী

স্টাফ রিপোর্টার: পবিত্র হজ, তাবলিগ জামাত নিয়ে কটুক্তির জেরে ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তিমন্ত্রী আবদুল লতিফ সিদ্দিকীকে মন্ত্রিসভা থেকে অপসারণের সিদ্ধান্ত হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা লন্ডন থেকে তার এমন অভিপ্রায়ের কথা জ্যেষ্ঠ মন্ত্রী ও নেতাদের জানিয়েছেন। আগামীকাল তিনি লন্ডন থেকে দেশে ফিরলে এ সংক্রান্ত কার্যক্রম চূড়ান্ত করা হবে। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ও মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের দায়িত্বশীল সূত্র বিষয়টি নিশ্চিত করেছে। একই সাথে লতিফ সিদ্দিকী আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্যের পদও হারাচ্ছেন। এ ব্যাপারেও সিদ্ধান্ত নিয়ে রাখা হয়েছে বলে দলটির শীর্ষস্থানীয় এক নেতা জানিয়েছেন।

অপরদিকে হজ নিয়ে মন্তব্য করে তোপের মুখে থাকা বাংলাদেশের মন্ত্রী আবদুল লতিফ সিদ্দিকী বলেছেন, তিনি তার মন্তব্যে অনড়। তবে শুধুমাত্র তার দলের নেতা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নির্দেশ দিলেই তিনি তার সম্মানে মন্তব্য প্রত্যাহার করে নিতে পারেন। মেক্সিকো থেকে বিবিসি বাংলাকে দেয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, একজন স্বাধীন ও আধুনিক মানুষ হিসেবেই তিনি হজ সম্পর্কে এই মন্তব্য করেছেন। তিনি বলেন, চাপের মুখে তার পদত্যাগ করার কোনো প্রশ্নই আসে না। ‘আমি কিছুই করবো না। প্রধানমন্ত্রী যে নির্দেশ দেবেন আমি সেটা প্রতিপালন করবো।’ বলেন তিনি। তিনি বলেন, তার এই মন্তব্যকে ঘিরে বিভিন্ন দলের নেতারা যেসব কথাবার্তা বলছেন, তার অপসারণের যে দাবি উঠেছে, সেসব বিষয়ে তিনি জানেন। এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের কোনো নেতা বা প্রধানমন্ত্রীর সাথেও তার কথা হয়নি।

মি. সিদ্দিকী বলেন, ‘আমি শুধু আমার বিশ্বাসের কথা বলেছি। এতে কারো কারো আঘাত লাগতে পারে এবং তারাও আমাকে আঘাত করে মতামত প্রকাশ করছে। যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশিদের একটি অনুষ্ঠানে তিনি কি বলেছেন, তার একটি অডিও বাজিয়ে শোনাতে চাইলে তিনি বলেন, এটা তাকে শোনানোর প্রয়োজন নেই। কারণ তিনি কি বলেছেন সেটা তিনি জানেন। এবং তার দায়িত্ব তিনি নিচ্ছেন।

সংবিধানের ৫৮(১)-এর (ক) উপধারায় মন্ত্রীদের পদের মেয়াদ সম্পর্কে বলা হয়েছে, ‘তিনি রাষ্ট্রপতির নিকট পেশ করিবার জন্য প্রধানমন্ত্রীর নিকট পদত্যাগপত্র প্রদান করিবেন।’ আবার ৫৮-এর (২) উপধারায় বলা হয়েছে, ‘প্রধানমন্ত্রী যে কোনো সময়ে কোনো মন্ত্রীকে পদত্যাগ করিতে অনুরোধ করিতে পারিবেন এবং ওই মন্ত্রী অনুরূপ অনুরোধ পালনে অসমর্থ হইলে তিনি রাষ্ট্রপতিকে উক্ত মন্ত্রীর নিয়োগের অবসান ঘটাইবার পরামর্শদান করিতে পারিবেন।’ আজ আবদুল লতিফ সিদ্দিকী নিউইয়র্ক থেকে দেশের উদ্দেশে রওনা দেবেন। এরই মধ্যে তাকে প্রধানমন্ত্রীর অভিপ্রায়ের কথা জানিয়ে দেয়া হয়েছে। দেশে ফিরেই তিনি পদত্যাগ করবেন বলে তার ঘনিষ্ঠ নেতারা জানিয়েছেন।
তবে যদি পদত্যাগ না করেন তাহলে সংবিধান অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে জানা গেছে। সেক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর অভিপ্রায় ও নির্দেশনা অনুযায়ী মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ সারসংক্ষেপ প্রস্তুত করবে। পরে তা প্রধানমন্ত্রীর কাছে পাঠানো হলে তিনি (প্রধানমন্ত্রী) সারসংক্ষেপে স্বাক্ষর করবেন। এরপর তা অনুমোদনের জন্য বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠানোর বিধান রয়েছে। রাষ্ট্রপতির অনুমোদনের পর ওই ফাইল মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে ফেরত আসবে। এরপর মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ প্রজ্ঞাপন জারি করে তা বিজি প্রেসে পাঠাবে। এটি বিজি প্রেস গেজেট আকারে প্রকাশ করলে মন্ত্রীর অব্যাহতি কার্যকর হবে।

ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী ছাড়াও আবদুল লতিফ সিদ্দিকী ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য। সর্বশেষ আওয়ামী লীগ বিরোধী দলে থাকার সময় শেখ হাসিনা-আবদুল জলিল কমিটিতে কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের সদস্য ছিলেন তিনি। এক-এগারোর সময় তার অবস্থান ছিলো দলের সংস্কারপন্থিদের বিরুদ্ধে। বিভিন্ন সময় অনুষ্ঠিত দলের কার্যনির্বাহী সংসদের বৈঠকে তিনি আক্রমণাত্মক বক্তৃতা করে শীর্ষ মহলের নজরে আসেন। ২০০৮ সালের নির্বাচনে জয়ী হয়ে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে টাঙ্গাইল-৪ আসনের এমপি লতিফ সিদ্দিকী সবাইকে চমকে দিয়ে মন্ত্রিসভায় জায়গা করে নেন। এরপর ২০০৯ সালে দলের কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হলে তিনি আবার চমক দেখিয়ে কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের সদস্য থেকে পদোন্নতি পেয়ে প্রেসিডিয়াম সদস্য হন। আওয়ামী লীগের অনেকে বাদ পড়লেও ৫ জানুয়ারির নির্বাচনকে কেন্দ্র করে গঠিত সর্বদলীয় সরকারের মন্ত্রিসভাতে ঠাঁই হয় তার।

মন্ত্রী হওয়ার পর থেকেই লাগামহীন বক্তব্য ও আপত্তিকর কর্মকাণ্ডের জন্য লতিফ সিদ্দিকী আলোচনায় আসেন। ২০১০ সালে ঢাকায় রিপোর্টার্স ইউনিটিতে এক অনুষ্ঠানে তিনি সাংবাদিকদের গালাগালি করেন। এরপর লতিফ সিদ্দিকী ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে বলেন, যারা হরতাল দেবে তাদের হত্যা করা হবে। ২৬ জুন জাতীয় সংসদের অধিবেশনে তিনি নারী-পুরুষের পরকীয়া নিয়ে আপত্তিকর মন্তব্য করেন। আবদুল লতিফ সিদ্দিকী দলের জ্যেষ্ঠ নেতাদের সমালোচনা ও কটাক্ষ করে বক্তৃতা করেন ২০ সেপ্টেম্বর সর্বশেষ অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদ এবং উপদেষ্টা পরিষদের যৌথ বৈঠকে।

এর আগে ২৮ মার্চ লতিফ সিদ্দিকী টাঙ্গাইলে নিজ বাড়িতে পিডিবির এক উপ-সহকারী প্রকৌশলীকে লাথি মেরে পানিতে ফেলে দেন। এতে পুনয় চন্দ্র নামের ওই প্রকৌশলীর মাথা ফেটে যায়। ওই প্রকৌশলীর ‘অপরাধ’ ছিলো তিনি মন্ত্রীর সামনে পকেটে হাত দিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারের প্রথম মেয়াদে মন্ত্রী আবদুল লতিফ সিদ্দিকী নিজের স্ত্রী লায়লা সিদ্দিকীর নামে সরকারি জমি বরাদ্দ দিয়ে ব্যাপক সমালোচিত হন।

সর্বশেষ রোববার যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের জ্যাকসন হাইটসে টাঙ্গাইল সমিতির দেয়া সংবর্ধনা সভায় পবিত্র হজ, তাবলিগ জামাত, প্রধানমন্ত্রীর ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় সম্পর্কে কটূক্তি করেন। তিনি সাংবাদিকদের সাথেও অশোভন আচরণ করেন। এ ঘটনায় দেশে-বিদেশে প্রতিবাদের নিন্দা ও ঝড় ওঠে। ইসলামিক পার্টি ও হেফাজতে ইসলাম তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় ২৪ ঘণ্টার মধ্যে লতিফ সিদ্দিকীর অপসারণ দাবি করে। অন্য ইসলামি দলগুলোও তার এ বক্তব্যের প্রতিবাদ ও নিন্দা জানায়। বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় তার বক্তব্যের নিন্দা জানান।

মঙ্গলবার জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান ও সাবেক রাষ্ট্রপতি এইচএম এরশাদ কটূক্তির জন্য আবদুল লতিফ সিদ্দিকীকে গ্রেফতারের দাবি করেন। সেই সঙ্গে তিনি মুসলমানদের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করে সংবিধান লংঘনের দায়ে অভিযুক্ত করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি করেন।

জাতীয় পার্টির মহাসচিব জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলু কটূক্তির জন্য ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্য যোগাযোগ প্রযুক্তিমন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য আবদুল লতিফ সিদ্দিকীর অপসারণ দাবি করেন। বিএনপি নেতারাও আবদুল লতিফ সিদ্দিকীর পদত্যাগের দাবি তুলেছেন। দলটির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এক বিবৃতিতে বলেছেন, এ বক্তব্য বাংলাদেশসহ গোটা মুসলিম বিশ্বের ধর্মীয় আবেগে চরম আঘাত ও অসম্মানজনক। এটা আওয়ামী লীগের সত্যিকার চরিত্রের বহিঃপ্রকাশ। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান টেলিযোগাযোগমন্ত্রীর বক্তব্যের নিন্দা এবং তার অপসারণ দাবি করেন।