ঝিনাইদহের শৈলকুপার আশুরহাট গ্রামে বিলুপ্ত শামুক খোলের অভয়ারণ্য

 

শাহনেওয়াজ খান সুমন: ঝিনাইদহের শৈলকুপার আশুরহাট গ্রামের মানুষ পাখির মিষ্টি মধুর ডাক ছাড়া একটি দিনও যেন কল্পনা করতে পারে না। গ্রামবাসীদের সকালের ঘুম ভাঙে পাখির ডাক আর ডানা ঝাপটানোর শব্দে। পাখির প্রতি অদম্য ভালোবাসায় নিজ গ্রামকে পাখির অভয়ারণ্য হিসেবে গড়ে তুলেছে গ্রামবাসী। গত তিন বছর ধরে গ্রামটিতে হাজার হাজার শামুক খোল পাখি বাসা বেঁধেছে। এখানে প্রজননের মাধ্যমে বংশ বৃদ্ধি করে চলেছে তারা।

প্রত্যন্ত একটি গ্রাম আশুরহাট। গ্রামটির মধ্যপাড়ায় পুরোনো আমলের তিনটি বিশালাকার দিঘি রয়েছে। এ দিঘি তিনটির পাড়ে রয়েছে বড় বড় শিমুল, কড়াই, মেহেগনি ও জাম গাছসহ ঘন জঙ্গল। তিন বছর আগে দিঘির পাড়ের গাছে শামুক খোল পাখি বাসা বাঁধতে শুরু করে। প্রথম দিকে আসা যাওয়া করতে থাকলেও এখন তারা স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেছে। নিয়মিত প্রজননের মাধ্যমে বংশ বৃদ্ধিও করছে। খুব ভোরে এরা খাদ্যের সন্ধ্যানে দল বেঁধে উড়ে বেড়ায় এখান থেকে ওখানে। সন্ধ্যার আগেই আবার নীড়ে ফিরতে শুরু করে। বর্তমানে এখানে পাখির সংখ্যা প্রায় সাত থেকে আট হাজার।

গ্রামবাসীরা জানায়, তারা পাখি সংরক্ষণের জন্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। তবে অনেক সময় পাখির বাচ্চা নিচে পড়ে মারা যাচ্ছে। আবার অনেক সময় রাতের আঁধারে দুর্বৃত্তরা আসে পাখি শিকার করতে। এজন্য শিকারিদের সাথে তাদের মারামারির ঘটনাও ঘটে। পাখিগুলো যাতে কোনো রকম নিধন না করা হয় এবং এর সঠিক সংরক্ষণ করতে প্রশাসনের হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন তারা।

এ ব্যাপারে ঝিনাইদহ জেলা প্রশাসক শফিকুল ইসলাম জানান, শৈলকুপার আশুরহাট গ্রামে বেশকিছু পাখি আছে। এগুলো বিলুপ্ত প্রজাতির। পাশে বাওড় থাকায় পাখিগুলো এখানে নিরাপদে আশ্রয়ের জন্য এসেছে। আমরা এ ব্যাপারে লক্ষ্য রাখছি, যাতে করে শিকারিরা পাখিগুলো শিকার করতে না পারে। এ জন্য প্রশাসনের পক্ষ থেকে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে। পাখিগুলো যাতে ভবিষ্যতেও এখানে নিরাপদে থাকতে পারে সে ব্যাপারে তাদের প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে বলেও জানান তিনি।

ঝিনাইদহ সরকারি কেসি কলেজের প্রাণীবিদ্যা বিভাগের সাবেক বিভাগীয় প্রধান মোহাম্মদ আলী জানান, এশিয়ার কয়েকটি দেশে যেমন ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কায় আগে প্রচুর পরিমাণে শামুক খোল পাখি দেখা গেছে। বিগত কয়েক বছর ধরে এদের সংখ্যা কমে এসে আশঙ্কাজনক পর্যায়ে পৌঁছেছে। উপযুক্ত আবহাওয়া, পরিমিত খাবার যোগান আর নিরাপত্তা থাকলে এরা সাধারণত কোনো এক জায়গা থেকে নড়ে না। বাংলাদেশে এরা এক সময় সক্রিয়ভাবে প্রজনন করলেও এখন খুব কম সংখ্যায় প্রজনন করতে দেখা যায়। শ্রীলঙ্কায় এখন আর এরা প্রজনন করে না। ভারতেও প্রচণ্ড গরম থাকলে এরা প্রজনন বন্ধ রাখে।

তিনি জানান, বাংলাদেশের রাজশাহী, নওগাঁ, জয়পুরহাট, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ও সিলেট অঞ্চলের হাওড় এলাকায় এখনও এরা ছোট দলে প্রজনন করে। কিন্তু তার সংখ্যা অনেক কম। এরা হাওড়-বাওড়, বিল, মিঠা পানির জলাধার ও নদীর ধারে এবং ধানের ক্ষেতে হেটে হেটে কাঁদায় ঠোট ডুবিয়ে শামুক-ঝিনুক আর গুগলি খেয়ে থাকে। বর্ষাকালের শেষ দিকে এদের প্রজনন শুরু হয়।

মোহাম্মদ আলী জানান, বর্তমানে শৈলকুপার আশুরহাট গ্রামে যে পাখি দেখা যাচ্ছে, এরা এখানে মূলত অভয়াশ্রম মনে করে নিয়েছে। এই পাখিগুলো সাধারণত নিরাপদ আশ্রয়স্থল ছাড়া বংশ বৃদ্ধি করে না। যার জন্য এই জায়গাকে নিরাপদ মনে করায় তারা বংশ বৃদ্ধি করছে। তিনি আরও জানান, উপযুক্ত পরিবেশ যেখানে থাকবে সেখানেই তারা আশ্রয় গড়ে তুলবে এবং বংশ বৃদ্ধি করবে। সুতরাং এই জায়গাগুলোতে যদি আমরা উপযুক্ত পরিবেশ গড়ে তুলতে পারি তাহলে এই পাখির বংশ বৃদ্ধি হবে, রক্ষা পাবে বিলুপ্ত প্রজাতির এই শামুক খোল পাখি।