মোদির বার্তা- বিএনপির আশার কফিনে শেষ পেরেক

 

স্টাফ রিপোর্টার: আওয়ামী লীগের রাজনীতির সাথে কোনো মত ও পথেই কুলিয়ে উঠতে পারছে না ক্যান্টনমেন্টে জন্ম নেয়া বিএনপি। গত ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে বিএনপি অংশগ্রহণ করেনি। এ নির্বাচনের আগে ও পরে এবং হালনাগাদ পর্যন্ত বিএনপির সব হুঙ্কার, হুঁশিয়ারি সবই ধুলায় মিশে গেছে আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক কৌশলের কাছে। এ দেশের রাজনীতিতে বিদেশীদের নাক গলানো ও প্রভাবের একটি বিষয় বহুল আলোচিত। ভারতের নির্বাচনে কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন ইউপি সরকারের ভরাডুবির পর মোদি সরকার ক্ষমতায় আসায় বিএনপি শিবিরে রীতিমতো উল্লাস সৃষ্টি হয়েছিল এই মনে করে যে, এবার আওয়ামী লীগ সরকারের বারোটা বেজে যাবে। অর্থাৎ, মোদি সরকারের প্রত্যক্ষ সহযোগিতা পাবে বিএনপি ও তার নেতৃত্বাধীন জোট। কিন্তু সে আশা এখন গুড়েবালি। গত ১৯ সেপ্টেম্বর পররাষ্ট্রমন্ত্রী এএইচএম মাহমুদ আলী ভারত সফরকালে মোদির সাথে সাক্ষাত করেন। মোদি বাংলাদেশকে সব ধরনের সহযোগিতার আশ্বাস দেয়ার পাশাপাশি সুনির্দিষ্টভাবে বলেছেন, বাংলাদেশ ও ভারতের অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যত এক সুতোয় গাঁথা। মোদি বলেছেন, ‘বঙ্গবন্ধু দেশ বানায়া, উসকি লাড়কি দেশ বাঁচায়া।’ অর্থাৎ, বঙ্গবন্ধু দেশ গড়েছেন আর তার কন্যা বাংলাদেশকে রক্ষা করেছেন। বর্তমানে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে যোগ দিতে গিয়ে গত শনিবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির প্রথম সরাসরি বৈঠক হয় নিউইয়র্কে। শেখ হাসিনা বৈঠককালে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীকে স্থল সীমানা চুক্তি কার্যকর এবং তিস্তা চুক্তিসহ দু দেশের অমীমাংসিত ইস্যুগুলো সমাধানের উদ্যোগ নেয়ার আন্তরিক আহ্বান জানান। মোদির জবাব ছিলো ‘ম্যায় রাস্তা নিকাল রাহাহু’ (আমি সমাধানের পথ খুঁজছি)। শুধু তাই নয়, শেখ হাসিনা নেপাল ও ভুটানের সাথে বাংলাদেশের সরাসরি স্থল যোগাযোগের ক্ষেত্রে প্রধান অন্তরায়গুলো তুলে নিতে মোদি সরকারের সহযোগিতা চাইলে তাতেও তিনি ইতিবাচক সাড়া দেন।

রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহল ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর পর পর প্রদত্ত এ সব বক্তব্য ইতিবাচক তাৎপর্য বহন করে বলে মনে করছে। তাদের মতে, বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট দেশীয় রাজনৈতিক অঙ্গন সরকারবিরোধী আন্দোলন নিয়ে উত্তপ্ত করতে ব্যর্থ হয়ে বিদেশিদের বিশেষ করে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের কাছ থেকে যে আশায় অপেক্ষা করছিলো প্রধানমন্ত্রী মোদির এ ধরনের বক্তব্যের পর তাদের বহুল প্রতীক্ষার সেই আশার কফিনে শেষ পেরেকটিই মেরে দেয়া হয়েছে বলে মত ব্যক্ত করা হচ্ছে। বিএনপির ধারণা ছিলো কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন ইউপি সরকারের সাথে আওয়ামী লীগের যে সম্পর্ক বিরাজিত ছিলো সে সম্পর্কের উল্টো ফলাফল ঘটবে নরেন্দ্র মোদি সরকারের পক্ষ থেকে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সে সব আশা-আকাক্সক্ষা মোদির বক্তব্যের পর রীতিমতো ধূলিসাৎ হয়ে গেছে। শুধু তাই নয়, বিএনপির সাথে যে ২০ দলীয় জোটের ব্যানার রয়েছে তাতেও চলছে টানাপোড়েন। জামায়াত নেতা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর ফাঁসির দণ্ড রহিত হয়ে আমৃত্যু কারাদণ্ডে পরিণত হওয়ায় আদালতের রায়ের পর দলীয় নেতাকর্মীদের মাঝেও সন্দেহের দানা বেঁধেছে ব্যাপক আস্থার সাথে। এর আগে ভারতের পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূল কংগ্রেস থেকে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীকে অর্থ যোগান দেয়ার ঘটনার খবর নিয়ে দু দেশের রাজনৈতিক অঙ্গন কালো মেঘে ঢেকে যায়। ভারতের ক্ষমতাসীন বিজিপি এবং বিরোধী কংগ্রেস এ ঘটনার তদন্ত দাবির পাশাপাশি পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জীর কড়া সমালোচনায় লিপ্ত হয়।

অভিযোগ ওঠে, মমতার মদদেই বাংলাদেশের এমন ন্যক্কারজনক কাণ্ডে অর্থের যোগান দিয়েছে সে দেশের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান শারদা। এ ঘটনা নিয়ে দু দেশের উচ্চ পর্যায়ে তদন্তও শুরু হয়েছে।
উদ্ভূত পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক বোদ্ধাদের কাছে পরিষ্কার হয়েছে যে, বিএনপি ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে অংশ না নিয়ে সংসদ থেকে যেমন বিদায় পেয়েছেন, তেমনি বিদেশিদের মধ্যে শেষ আশা ভরসার স্থল হিসেবে বর্তমান ভারত সরকারের কাছ থেকেও কোন ধরনের সহযোগিতা পেতে ব্যর্থ হয়েছে। ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর পর পর দুটি বক্তব্য বিএনপি বা ২০ দলীয় জোটের জন্য উল্টো ‘ব্যাক ফ্লো’ হয়েছে বলেও মত ব্যক্ত করা হচ্ছে। এর ওপর বিএনপির জন্য মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা হয়েছে- ২০ দলীয় জোট থেকে ছোট ছোট কয়েকটি দল বেরিয়ে গিয়ে ইতোমধ্যে নতুন জোট গঠন করেছে।

রাজনৈতিক সূত্রগুলো বলছে, মানবতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধের মামলায় ধরা খেয়ে জামায়াত ও এর শীর্ষ নেতাদের কয়েকজন অভিযুক্ত হয়ে এক অনিশ্চিত অবস্থায় নিপতিত হয়েছে। সরকারবিরোধী আন্দোলনে সহিংস তৎপরতায় বিএনপির পক্ষে মাঠে ময়দানে ফাইটার হিসেবে কাজ করেছে জামায়াত-বিএনপির সশস্ত্র ক্যাডার বাহিনী। ৫ জানুয়ারি নির্বাচনের আগে ও পরে পুলিশসহ সাধারণ বহু মানুষের প্রাণ সংহার হয়েছে এদের হাতে। ইতোমধ্যেই বিএনপি ও জামায়াতের সম্পর্কে ফাটল সৃষ্টি হয়ে রাজনীতির চালচিত্র পাল্টে গেছে। জামায়াত চলছে অনেকটা একলা চল নীতিতে। আর বিএনপি নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া বিভিন্ন দুর্নীতির মামলায় আসামি হয়ে এখন গ্রেফতার আতঙ্কে পড়ে বিভিন্ন জনসভায় বলে বেড়াচ্ছেন ‘গ্রেফতারে ভয় পাই না। আমাকে বন্দী করার আগে নিজেদের পালানোর রাস্তা পরিষ্কার করুন।’ সম্প্রতি ব্রাহ্মণবাড়িয়াসহ দুটি জনসভায় বিএনপি নেত্রী জামায়াতের সাথে তাদের ফাটল ধরানো যাবে না বলে বক্তব্য রেখে নতুন করে আন্দোলনের হুঁশিয়ারিও প্রদান করেছেন। এ ধরনের হুঁশিয়ারি এ পর্যন্ত বহু দফায় ব্যক্ত করার পর নিজ সমর্থিত দল ও জোটের নেতাকর্মীরা তাতে আর আশ্বস্ত হতে পারছেন না। এর ওপর আরেক বোমা ফাটিয়ে দিয়েছেন দলের শীর্ষ নেতা ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ।

সম্প্রতি প্রকাশিত তাঁর একটি বইয়ে তিনি পরিষ্কার করে দিয়েছেন- বিএনপি চেয়ারপার্সনের পক্ষে আন্দোলনের নামে তার সন্তানদের মামলা মোকদ্দমা ও কারাবরণ থেকে রক্ষার আকুতি নিয়ে।
বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে বিভিন্ন সূত্রে এও বলা হচ্ছে, ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগ ক্ষমতা গ্রহণ করেছে সত্য। কিন্তু বিএনপির আন্দোলনে এ সরকার আগাম নির্বাচন দিতে বাধ্য হবে। তার জবাবও শেখ হাসিনা শনিবার নিউইয়র্কে সংবাদ সম্মেলনে পরিষ্কারভাবে জানিয়ে দিয়েছেন। বলে দিয়েছেন, আগাম নির্বাচনের কোন সম্ভাবনা নেই, মধ্যবর্তী নির্বাচনও দেবেন না। সে আশাও গুড়েবালি।

বাংলাদেশের রাজনৈতিক বিরোধ নিরসনে মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান মজিনা দীর্ঘ সময় ধরে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে যে সংলাপের আহ্বান জানিয়ে আসছিলেন সে আশায়ও ছেদ পড়েছে ড্যান মজেনার বক্তব্যে। রোববার ঢাকায় ডিপ্লোমেটিক করেসপন্ডেন্টস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ডিক্যাব) আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে বলে দিয়েছেন, ‘আমি মনে করি এটা একটা অভ্যন্তরীণ বিষয়, যা বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলো ও জনগণের মীমাংসা করা প্রয়োজন। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, রাজনৈতিক সূত্রগুলো মনে করছে, যুক্তরাষ্ট্রও তাদের আগেকার অবস্থান এখন পাল্টাতে সচেষ্ট হচ্ছে।
সঙ্গত কারণে বলা হচ্ছে, বিএনপি এখন রাজনৈতিক পরিস্থিতি মোকাবেলায় কোন পথে এগোবে এবং এতে কিছুটা হলেও সফলতা আনার ক্ষেত্রে সচেষ্ট হবে, না ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করার মতো ভুল পথে পা দেবে-তাই এখন দেখার বিষয়।