আলমডাঙ্গার হাড়োকান্দি কবরস্থানে মানবাধিকারকর্মী সাংবাদিক ও উৎসুক জনতার ভিড়
স্টাফ রিপোর্টার: দাফনের ১০ দিন পর অবশেষে আলমডাঙ্গা হাড়োকান্দির স্কুলছাত্রী ভুন্দির লাশ কবর থেকে তুলে ময়নাতদন্ত করা হয়েছে। গতকাল বুধবার দুপুরে ম্যাজিস্ট্রেটের উপস্থিতিতে আলমডাঙ্গা থানা পুলিশ ভুন্দির লাশ কবর থেকে উত্তোলন করে। গতরাতে পুনরায় লাশ দাফন করা হয়। লাশ উত্তোলনের সময় দৈনিক মাথাভাঙ্গার সাংবাদিকের সাথে আলমডাঙ্গা থানা পুলিশ অসৌজন্যমূলক আচরণ করেন। মামলার আসামি জাকির হোসেনকে গতরাতে শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত গ্রেফতার করতে পারেনি পুলিশ। অভিযোগ, সে আশেপাশেই রয়েছে।
গত ৮ আগস্ট সোমবার চুয়াডাঙ্গা নেহালপুরের সায়েদ আলীর স্ত্রী ভুন্দির বড় বোন আমেনা খাতুন বাদী হয়ে চুয়াডাঙ্গা আমলি আদালত খ অঞ্চল (আলমডাঙ্গা) মামলা দায়ের করেন। আদালতের বিজ্ঞ বিচারক সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আব্দুল হালিম এ মামলায় থানায় এজাহার হিসেবে গ্রহণ করে ৩ দিনের মধ্যে ভুন্দির লাশ কবর থেকে উত্তোলন করে ময়নাতদন্তের নির্দেশ দেন আলমডাঙ্গা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে। সে মোতাবেক গতকাল জেলা প্রশাসনের অনুমতি সাপেক্ষে ভুন্দির লাশ উত্তোলন করা হয়। আলমডাঙ্গার সহকারী কমিশানার (ভূমি) মো. শাহীনুজ্জামানের উপস্থিতিতে বেলা সোয়া ২টার দিকে কবর থেকে লাশ তোলা হয়। এ সময় আলমডাঙ্গা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ওসি মনির উদ্দিন মোল্লার নেতৃত্বে পুলিশের একটি দল উপস্থিত ছিলো। দৈনিক মাথাভাঙ্গার সাংবাদিক এ সময় লাশ তোলার দৃশ্য ধারণ করতে গেলে ওসি মনির উদ্দিন মোল্লা বাধা দেন এবং ছবি তুলতে নিষেধ করেন বলে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান। বিরুপ মন্তব্যও করেন উপস্থিত মানবাধিকার কর্মীসহ সাধারণ মানুষ। সেখানে অনেক সাংবাদিক ছবি তুললেও মাথাভাঙ্গার সাংবাদিক ও তার ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে যেন অজানা ক্ষোভেরই বহির্প্রকাশ ঘটায় পুলিশ। এছাড়া ওসি মনির উদ্দিন মোল্লা মানবাধিকার নেতৃবৃন্দের সাথেও অসৌজন্যমূলক আচরণ করেন বলেও অভিযোগ করেন কয়েকজন। লাশ উত্তোলনের সময় জেলা লোকমোর্চার সাধারণ সম্পাদক শাহ আলম সনি, অ্যাকশন এইডের প্রজেক্টের এলআরপি ম্যানেজর নুঝাত পারভীন, নির্বাহী সদস্য অ্যাড. আকবর আলী, লিটু বিশ্বাস, জুলিয়াস আহমেদ মিল্টু, জীবননগর উপজেলা লোকমোর্চার সভাপতি আবুল কালাম আজাদ, আলমডাঙ্গা উপজেলা লোকমোর্চার সভাপতি এম সবেদ আলী, সাধারণ সম্পাদক মনিরুজ্জামান, জেহালা ইউনিয়ন লোকমোর্চার সাধারণ সম্পাদক দেবেন্দ্রনাথ দোবে বাবুলাল ও লোকমোর্চার সচিব শাহানাজ পারভীন শান্তি, মানবতা সংস্থার নির্বাহী পরিচালক অ্যাড. মানি খন্দকার, নির্বাহী সদস্য অ্যাড. জিল্লুর রহমান জালাল, গণসংযোগ কর্মকর্তা হাফিজ উদ্দিন হাবলু ও মোটিভিশন কর্মকর্তা জাকিয়া সুলতানা ঝুমুর। লাশ কবর থেকে তুলে ময়নাতদন্তের জন্য চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতাল মর্গে নেয়া হয়। কবর থেকে লাশ উদ্ধারের পর মানবাধিকার কর্মীরা ভুন্দির শোকার্ত মায়ের সাথে দেখা করতে যান। এ সময় ভুন্দির মা সাবিনা বেগম কান্নায় ভেঙে পড়েন। তিনি তার কন্যা হত্যার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানান। অপরদিকে ভুন্দির লাশের সুরতহাল রিপোর্ট প্রণয়নকারী কর্মকর্তা থানার এসআই জিয়াউল হক জিয়া গতকাল লাশ উত্তোলনের সময় উপস্থিত ছিলেন না। বিষয়টি থানার ওসি মনির উদ্দিন মোল্লার কাছে জানতে চাইলে তিনি কোনো মন্তব্য করেননি।
সূত্র জানায়, চুয়াডাঙ্গার আলমডাঙ্গা উপজেলাধীন আইলহাস ইউনিয়নের হাড়োকান্দি গ্রামের দরিদ্র আবুল কাশেমের মেয়ে স্থানীয় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের তৃতীয় শ্রেণির ছাত্রী জান্নাতুল আরা ওরফে ভুন্দি (১১) গত ৩১ আগস্ট সকালে বাড়ির অদূরবর্তী নুড়িতলা মাঠে তাল কুড়োতে গিয়ে নিখোঁজ হয়। পরদিন সকালে ওই মাঠের আনারুলের পুকুর থেকে তার লাশ উদ্ধার করা হয়। প্রচার করা হয় ভুন্দিকে জিনেরা হত্যা করেছে। পরে গুঞ্জন ওঠে ভুন্দির চাচাতো ভাই গ্রামের ওসমানের ছেলে কলেজছাত্র জাকির হোসেন তাকে ধর্ষণ শেষে হত্যা করে লাশ পুকুরে কলাপাতা দিয়ে ঢেকে রাখে। কিন্তু এ গুঞ্জনে আমল দেয় না পুলিশ। ময়নাতদন্ত ছাড়াই লাশ দাফনের অনুমতি দেয়া হয়। দাবি ওঠে ভুন্দির হত্যারহস্য উন্মোচনের। কয়েকদিনের মধ্যে সোচ্চার হয়ে ওঠে গ্রামবাসী। এলাকার তিনটি বিদ্যালয়ের শ শ ছাত্র-ছাত্রী গত ৪ সেপ্টেম্বর ভুন্দির হত্যারহস্য উন্মোচন ও দোষীদের শাস্তির দাবিতে মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করে। ভুন্দিকে জিনে নিয়ে গেছে এবং পরবর্তীতে ভুন্দিকে জিনে মেরে ফেলেছে বলে প্রচারকারী মাদরাসার দু শিক্ষক হাবিবুর রহমান ও দেলোয়ার হোসেন অবস্থা বেগতিক দেখে মাদরাসা থেকে সটকে পড়েন। এরপর তারা আর মাদরাসায় ফেরেননি বলে গ্রামবাসী জানায়।
এরই মধ্যে গত ৫ সেপ্টেম্বর নিহত ভুন্দির বোন আমেনা খাতুন ও ভগ্নিপতি সায়েদ আলী এ ব্যাপারে আলমডাঙ্গায় থানায় মামলা করতে গেলে পুলিশ মামলা নেয় না। গত ৭ আগস্ট রোববার দু মেয়ে আমেনা খাতুন ও মোমেনা খাতুনকে সাথে নিয়ে ভুন্দির মা সাবিনা বেগম চুয়াডাঙ্গায় আসেন জেলা লোকমোর্চা ও আইনজীবীদের সাথে মামলার পরামর্শ নিতে। একপর্যায়ে আদালতে মামলার প্রস্তুতি গ্রহণ করা হয়। এরই মধ্যে ওইদিন দুপুরে পাইকপাড়া গ্রামের মৃত রজব আলী মণ্ডলের ছেলে ভুন্দির মামা আলমডাঙ্গা থানায় অপহরণ মামলা করেন ভুন্দির মাকে অপহরণ করা হয়েছে মর্মে। আসামি করা হয় হাড়োকান্দির গিয়াস উদ্দিন ডাবলু, মিনাজ উদ্দিন, ইসলাম, গোলজার ও আসলামকে। গ্রেফতার করা হয় মিনাজ উদ্দিন, গিয়াস উদ্দিন ডাবলু ও আব্দুল হামিদকে। এরা ভুন্দি হত্যা মামলার সাক্ষী হতে চাওয়ার কারণেই তাদের বিরুদ্ধে অপহরণের মিথ্যা মামলা করা হয় বলে ভুন্দির মা সাবিনা ওইদিন রাতে চুয়াডাঙ্গা প্রেসক্লাবে সাংবাদিক সম্মেলন করে জানান। রাতে গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে হামিদকে ছেড়ে দেয়া হয়। পরদিন গত সোমবার সকালে বাকি দুজনকেও ছেড়ে দেয়া হয়। হাড়োকান্দির ওসমান আলীর ছেলে ভুন্দির চাচাতো ভাই কলেজছাত্র জাকির হোসেন অভিযোগ অস্বীকার করলেও তার বিরুদ্ধেই শেষমেশ ভুন্দির বোন আমেনা খাতুন আদালতে ধর্ষণ ও হত্যামামলা দায়ের করেন। এরপরই আদালতের আদেশে ভুন্দির লাশ উত্তোলনপূর্বক ময়নাতদন্তের আদেশ দেন আদালত। গতকাল বুধবার বিকেলে চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালমর্গে ভুন্দির লাশের ময়নাতদন্ত করা হয় এবং সন্ধ্যার পর লাশ পুনরায় দাফন সম্পন্ন হয়।