দুজনের সর্পদংশন : দু রকম চিত্র

 

ওঁঝা ছুটলো হাসপাতালে : নারীকে নিয়ে ঝাঁড়ফুঁক নাটক

মাহমুদ কামরান: সাপ খেলা দেখানোর সময় সাপে কেটে দ্রুত হাসপাতালে এসে সাপুড়ে ওঁঝা সুস্থ হলেও অপর এক ওঁঝার অপচিকিৎসায় প্রাণ গেছে দু সন্তানের জননীর। গতকাল মঙ্গলবার পৃথক স্থানে দুজন সর্পদংশনের শিকার হন। সাপুড়ে ওঁঝা সাপখেলা দেখিয়ে সাপের তাবিজ বিক্রির সময় দংশিত হন। তাকে দ্রুত হাসপাতালে নেয়া হলেও রান্না ঘরে দংশিত দু সন্তানের জননীকে তার মামাশ্বশুর ওঁঝার অপচিকিৎসায় মৃত্যু অনিবার্য করে তোলা হয়। অপচিকিৎসার নাটকের পর হাসপাতালে নেয়া হলে কর্তব্যরত চিকিৎসক বলেন, বড্ড দেরি হয়ে গেছে। হাসপাতালে নেয়ার মিনিট দশেকের মাথায় মারা যান শাহার বানু। শিশুসন্তানের আহাজারিতে ভারী হয়ে ওঠে হাসপাতালের পরিবেশ।

সাপে কেটে মারা যাওয়া শাহার বানু (৩২) চুয়াডাঙ্গা দামুড়হুদার চরহোগলডাঙ্গা গোরস্তানপাড়ার নজরুল ইসলাম নজুর স্ত্রী। সাপ খেলা দেখিয়ে সাপের তাবিজ বিক্রির সময় দংশিত সাপুড়ে ওঁঝা রবিউল ইসলাম ঢাকা সাভারের পোড়াবাড়ির তাইজুদ্দিনের ছেলে। তিনিসহ তার ৮ সহযোগী চুয়াডাঙ্গার জীবননগরে কয়েকদিন ধরে অবস্থান নিয়ে এলাকায় সাপ খেলা দেখিয়ে তাবিজ বিক্রি করছিলেন। গতকাল মঙ্গলবার সকাল ১১টার দিকে জীবননগরের একটি গ্রামে সাপ খেলা দেখানোর সময় দংশিত হন। তার সাথে থাকা হামিদুল দ্রুত বাঁধন দিয়ে চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালে নিয়ে ভর্তি করিয়ে সুস্থ করে তোলেন। সুস্থ হয়ে ওঠার পর ওঁঝা সাপুড়ে রবিউল ইসলাম (২৮) তওবা কেটে বলেন, আর কোনোদিন সাপ খেলা দেখাবো না। সাপে কাটবে না বলে ভুয়া তাবিজ বিক্রি করে মানুষও ঠকাবো না। খেটে খাবো।

জানা গেছে, চুয়াডাঙ্গা দামুড়হুদার চরহোগলডাঙ্গা গোরস্তানপাড়ার নজরুল ইসলামের স্ত্রী শাহার বানু নিজ বাড়ির রান্নাঘরে বসে রান্না করছিলেন। বেলা ৩টার দিকে রান্নার সময় রান্নাঘরের গর্তে পা পড়ে। সাপে দংশন করে। জালা যন্ত্রণা শুরু হয়। পরিবারের লোকজন বাঁধন দেয়। শাহার বানুর এক মামাশ্বশুর ঝন্টু সাপুড়ে ওঁঝা। তিনি সাপ খেলা দেখাচ্ছিলেন আটকবর এলাকায়। মোবাইলফোনে খবর পেয়ে তিনি রোগীকে বাড়িতে রাখতে বলে মোটরসাইকেলে চরহোগলডাঙ্গায় পৌঁছান। রোগী সুস্থ করার নাটক শুরু করেন। চলতে থাকে ঝাঁড়ফুঁকের পাশাপাশি সনাতন পদ্ধতিতে কাটাছেঁড়া। দীর্ঘ সময় ধরে কাটাছেঁড়ার নাটক করেও রোগীর অবস্থা ক্রমশ আশঙ্কাজনক হয়ে ওঠে। তখন রোগীর লোকজনের আক্কেল ওঠে। রোগীকে নেয়া হয় চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালে। তখন সন্ধ্যা ৭টা বেজে দশ। চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালের জরুরি বিভাগে কর্তব্যরত চিকিৎসক রোগী দেখেই বলেন, বড্ড দেরি হয়ে গেছে। চিকিৎসা শুরু করেন। দশ মিনিটের মাথায় রোগী শাহার বানু মারা যান। মায়ের মৃত্যু দেখে শিশু ছেলের কান্নায় ভারী হয়ে ওঠে হাসপতালের পরিবেশ। এ সময় কর্তব্যরত চিকিৎসকসহ সচেতনমহল মন্তব্য করতে গিয়ে বলেন, যখন সাপুড়ে সাপের তাবিজ বিক্রি করতে গিয়ে সাপে কেটে হাসপাতালে ছুটে সুস্থ হচ্ছেন, তখন আরেক সাপুড়ের অপচিকিৎসায় মানুষ মারা যাচ্ছে। ওইসব ভণ্ড সাপুড়ের বিরুদ্ধে শক্ত ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না বলেই একের পর এক মানুষের প্রাণ ঝরছে। সমাজে বাড়ছে সাপ আতঙ্ক।

এদিকে চুয়াডাঙ্গার জীবননগর এলাকায় এসে সাপ খেলা দেখিয়ে সাপে কাটবে না বলে সাপের তাবিজ বিক্রেতা রবিউল ইসলাম বলেছেন, কবির, মিঠু, ঝিনে, তরিকুল, মেহেদী ও সাইদুলসহ তারা ৮ জন গত কয়েকদিন আগে জীবননগর আসেন। দিনে দুজন করে ৪ ভাগে বিভক্ত হয়ে গ্রামে গ্রামে ঘুরে সাপ খেলা দেখিয়ে তাবিজ বিক্রি করেন। গতকাল মঙ্গলবার সকালে রবিউল ও হামিদুল জীবননগর শহরের পার্শ্ববর্তী গ্রামে সাপ খেলা দেখাচ্ছিলেন। এ সময় সাপে দংশন করে। খেলা দেখানো সাপের বিষদাঁত ভেঙে দেয়া হয়। যে সাপটি রবিউলকে দংশন করেছে তারও বিষদাঁত ভাঙা ছিলো। কয়েকদিনের মধ্যে আবারও বিষদাঁত গজেছে। সঞ্চিত হয়েছে বিষ। বিষধর সাপে দংশনের পর রবিউল কালবিলম্ব না করে তার সাথে থাকা হামিদুলকে দ্রুত চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালে নিতে বলেন। ঘণ্টা খানেকের মাথায় হাসপাতালে পৌঁছায়। এন্টিস্নেক ভেনম প্রয়োগের পর সুস্থ হতে শুরু করেন। এ সময় হাসপাতালেই রবিউলের সহযোগী সাপুড়ে হামিদুল সাপটি বের করে খেলা দেখিয়ে বলেন, এই সাপে দংশন করেছে। সাপ খেলা দেখানোর জন্য কোনো মন্ত্র লাগে না। মন্ত্রে কাজ হয় না। কৌশল। সাপে দংশন করলে কোনো মন্ত্রে কাজ হয় না বলেই আমরা দ্রুত ওকে হাসপাতালে নিয়েছি। হাসপাতালে নিয়েছি বলেই প্রাণে রক্ষা পেলো রবিউল।

রবিউল বলেছেন, জীবনে আর কোনোদিন সাপ খেলা দেখাবো না। সাপ দেখে মানুষ ভয় পায়। সেই সুযোগটা কাজে লাগিয়ে সাপের ভুয়া তাবিজ বিক্রি করে মানুষের সাথে প্রতারণা করে আসছিলাম। সাপ নিয়ে প্রতারণার চেয়ে খেটে খাওয়া অনেক ভালো।

আটকবর প্রতিনিধি জানিয়েছেন,দামুড়হুদার জগন্নাথপুরে দিনব্যাপি সাপের ঝাঁপানপালা অনুষ্ঠিত হয়েছে। গতকাল মঙ্গলবার সকাল ৯টার দিকে গ্রামের মিখাইল মণ্ডলের আমবাগানে গ্রামবাসীর উদ্যোগে মনসা ও চাঁদ সওদাগর এদুটি দলের মধ্যে দিনব্যাপি সাপের ঝাঁপান খেলা অনুষ্ঠিত হয়। দিনব্যাপি এ ঝাঁপান খেলা দেখতে জগন্নাথপুরসহ এর আশপাশের গ্রামের হাজারো মানুষ ছুটে আসে। খেলা শেষে জগন্নাথপুরের বিশিষ্ট সমাজসেবক শ্রী বিভাস চন্দ্র প্রামাণিকের সভাপতিত্বে আলোচনাসভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় উভয়দলকেই সান্ত্বনা পুরস্কার দেয়া হয়। মনসা দলে অংশগ্রহণ করেন ভোলা ও তার দল এবংচাঁদ সওদাগর দলে অংশগ্রহণ করেন মওলা বকস ও তার দল। সার্বিক ব্যবস্থাপনায় ছিলেন সাহাবদ্দিন তরফদার,জাকির হোসেন, সিরাজ তরফদার, আয়ব আলী, রবিউল, সাহাবদ্দিন, ইজারুল প্রমুখ।