ঝিনাইদহে দেড় কোটি টাকা হাতিয়ে এহসান সোসাইটি লাপাত্তা

 

শাহনেওয়াজ খান সুমন: এহসান সোসাইটি বাংলাদেশ নামের একটি প্রতিষ্ঠান ঝিনাইদহ থেকে নীরবে হাতিয়ে নিয়েছে কোটি কোটি টাকা।এ প্রতিষ্ঠানটির সাথে ঝিনাইদহ শহরের বিত্তশালীদের পাশাপাশি মাদরাসা শিক্ষক, মসজিদের ইমাম ও মুয়াজ্জিন জড়িত বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।

সূত্র জানায়, এহসান সোসাইটি বাংলাদেশের ঝিনাইদহ অঞ্চলের কথিত সমন্বয়কারী মাওলানা আবদুল হালিম দু হাজার গ্রাহকের দেড় কোটি টাকা হাতিয়ে সহযোগীদের নিয়ে গোপনে মালোয়েশিয়া পাড়ি দিয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। ঝিনাইদহ সদর উপজেলার মধুপুর দাখিল মাদরাসার শিক্ষক ও শহরের পুরোনো হাসপাতাল মসজিদের ইমাম ছিলেন তিনি। তিনি একই উপজেলার মাওলানাবাদ কালা গ্রামের মাওলানা আবদুল আলীর ছেলে। তার সহযোগী হিসেবে ঝিনাইদহ জামে মসজিদের মোয়াজ্জিন শরিফুল ইসলাম, ভেন্নাতলা গ্রামের রফিকুল ইসলাম, পাগলাকানাই মসজিদের ইমাম ইসমাইল হোসেন, ও মাগুরার রাউতড়া গ্রামের শরিফুল ইসলাম, জাকিরহোসেনসহ অন্তত ৫০ জন ইমাম ও মোয়াজ্জিন মাঠ পর্যায়ে কাজ করতেন। মাওলানা আব্দুল হালিম বর্তমানে দু স্ত্রী ও সন্তানদের নিয়ে আত্মগোপন করে আছেন।

আমানতকারীরা জানান, এক বছর মেয়াদী সঞ্চয়ে প্রতি লাখে মাসে চৌদ্দশ টাকা, দুই বছর মেয়াদী সঞ্চয়ে প্রতি লাখে মাসে ১৫শ টাকা এবং তিন বছর মেয়াদী সঞ্চয়ে এক লাখ টাকায় ১৬শ টাকা সুদ দিত।এ লোভনীয় সুদে কারবারে আকৃষ্ট হয়ে ঝিনাইদহের প্রায় দু হাজার মানুষ সহায় সম্বল বিক্রি করে মাওলানা আব্দুল হালিমের কাছে টাকা জমা দিতেন। এছাড়া জেলা, উপজেলা, ইউনিয়ন ও গ্রাম পার্যায়ের মসজিদের ইমাম ও মোয়াজ্জিনদের মাধ্যমেও বহু মানুষ এহসান সোসাইটি সততা নামের ভূয়া প্রতিষ্ঠানে লগ্নি করে। তবে ধর্মের কথা বলে নিজেরাই চড়াসুদে কারবারে জড়িয়ে পড়া ইমাম মোয়াজ্জিনরা লগ্নিকৃত টাকা হাতছাড়া হলেও লোকলজ্জার ভয়ে মানুষের কাছে এখন বিষয়টি গোপন করছেন।

ঝিনাইদহ শহরের ব্যাপারীপাড়া আহাদুর রহমান খোকন ১৫ লাখ টাকা , পবহাটির জাহিদুল ইসলাম ১৪ লাখ টাকা, ইমরান ১৩ লাখ টাকা, বাচ্চু মিয়া ১৪ লাখ ৫০ হাজার টাকা, আরিফ হোসেন ১১ লাখ টাকা, নাসির ৮ লাখ টাকা, টিটু ১২ লাখ টাকা, মারুফ ১৫ লাখ টাকা,মুরারীদহের আবুল কালাম আজাদ ১১ লাখ টাকাসহ কমপক্ষে দু হাজার বিনিয়োগকারীর টাকা নিয়ে চক্রটি উধাও হয়েছে কর্মকর্তারা।

তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, সমন্বয়কারীসহ মাঠকর্মীরা মসজিদের ইমাম এবং মাদরাসাশিক্ষক হওয়ায় বিনিয়োগে আগ্রহীর সংখ্যা দিনের পর দিন বাড়তে থাকে। ঝিনাইদহ অফিসের অধীনে কমপক্ষে দু হাজার বিনিয়োগকারী রয়েছেন। নামি-দামি মাদরাসা ও মসজিদের ইমাম যোগ দেন তাদের সাথে। এমনকি কতিপয় অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংক কর্মকর্তা লোভ সামলাতে পারেননি। তারাও ওই দলে ভিড়ে যান।

এহসান সোসাইটি বাংলাদেশের মাঠকর্মী খাজুরা মসজিদের ইমাম মাওলানা মানজুর আহম্মেদ বলেন, ২০০৫ সালের দিকে ঝিনাইদহ অঞ্চলে এহসান এস বাংলাদেশ নামে এবং পরে এহসান সোসাইটি নাম ধারণ করে অর্থ হাতিয়ে নেয়ার ব্যবসা শুরু হয়। সরকারি কোনো অনুমোদন আছে কি-না জানা নেই তাদের। তার ভাষায়, প্রতিষ্ঠানটির নির্বাহী পরিচালক মাগুরা জেলার সাজিয়াড়া গ্রামের কাজী রবিউল ইসলাম। জোনাল ম্যানেজার একই জেলার সালুয়া গ্রামের মসলেম উদ্দিনের ছেলে মো. জামির হোসেন এবং অফিস ব্যবস্থাপক নন্দলালপুর গ্রামের আশরাফুল আবেদিনের ছেলে এএসএম আবদুল্লাহ। তিনি জানান, সর্বশেষ ঝিনাইদহ জেলা শহরের নবাব সিরাজউদ্দৌলা সড়কে নজরুল ইসলাম নামে এক পুলিশ অফিসারের বাড়ি ভাড়া নেন তারা। শুধু তাই নয় স্বল্প সময়ের মধ্যে ঝিনাইদহ সদর, হাটগোপালপুর, কোটচাঁদপুর, মহেশপুর ও সস্তাবাজারে অফিস খোলা হয়। প্রাপ্ত তথ্যমতে, ঝিনাইদহ, চুয়াডাঙ্গা, মেহেরপুর জেলায় অন্তত ৪৫টি শাখা অফিস রয়েছে প্রতিষ্ঠানটির। লাভের টাকায় অনেক স্থানে প্রতিষ্ঠানটির নিজস্ব ভবন তৈরি করা হয়। এসব অফিসের মাধ্যমে মাসিক মুনাফার কথা বলে ধর্মভীরু হাজার হাজার নারী-পুরুষের কাছ থেকে সঞ্চয় জমার নামে কাড়ি কাড়ি টাকা চক্রটি হাতিয়ে নেয়। বেশির ভাগ অফিসে বর্তমান তালা ঝুলছে। টাকার জন্য প্রতিদিন শ শ মানুষ তালাবদ্ধ অফিসের সামনে ভিড় করছেন।

জানা গেছে, স্ত্রী সন্তান নিয়ে মাওলানা আব্দুল হালিমের বিদেশ পাড়ি দেয়ার খবর ছড়িয়ে পড়লে প্রভাবশালীদের কেউ কেউ কৌশলে মুনাফাসহ আসল টাকা উদ্ধার করে নিয়েছেন। রাঘব বোয়ালরা পালিয়ে গেলেও বাড়িঘর বিক্রি করে মাঠ কর্মীদের পরিশোধ করতে হচ্ছে। তবে বেশির ভাগ বিনিয়োগকারী টাকা ফেরত না পেয়ে পথে বসেছেন। বাচ্চু মিয়া নামে একজন আমানতকারী আক্ষেপ করে বলেন, দেশে সমবায় সমিতি, এনজিও হুন্ডি ব্যবসা প্রভৃতির মাধ্যমে টাকা হাতিয়ে নেয়ার নজির থাকলেও ধর্ম প্রাণ মানুষদের ব্যবহার করে কাড়ি কাড়ি টাকা হাতিয়ে নেয়ার খবর এতোদিন অজানা ছিলো।

এ ব্যাপারে এহসান সোসাইটি বাংলাদেশ প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা কাজী রবিউল ইসলাম বলেন, ক্যাশ তছরুপ, ভুয়া ঋণ, ভুয়া পেমেন্ট দেখিয়ে সংস্থার অনেক কর্মকর্তা অর্থ আত্মসাত করেছেন। প্রতিষ্ঠানের আভ্যন্তরীণ অডিট ও নিরীক্ষা রিপোর্টে এ অর্থ আত্মসাতের বিষয়টি উঠে আসে। প্রতিষ্ঠানের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বিষয়টি দুদকে অবহিত করলে কমিশন তা যাচাই-বাছাই করছে।

এ ব্যাপারে ঝিনাইদহ সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা শাহাবুদ্দীন আজাদ জানান, তিনি লোকমুখে এমন কথা শুনেছেন। তবে এ পর্যন্ত টাকা উদ্ধারের জন্য অভিযোগ করেননি।