একের পর এক বাল্যবিয়ের বলি এবং

 

বাল্যবিয়ে রোধে গড়ে উঠেছে সামাজিক আন্দোলন। সরকারের নির্দেশনায় বিধি প্রয়োগে প্রশাসনও তৎপর। এর মধ্যেও বাল্যবিয়ের বলি হচ্ছে একের পর এক স্কুলছাত্রী। চুয়াডাঙ্গা আলমডাঙ্গার গোয়ালবাড়ি গ্রামের স্কুলছাত্রী শোভার পর ঝিনাইদহ গান্নার স্কুলছাত্রী রোজিনাকে হতে হলো বাল্যবিয়ের বলি। শোভার বিয়ে সম্পাদন করা কাজিকে দণ্ডভোগ করতে হয়েছে। সপ্তম শ্রেণির ছাত্রী রোজিনাকে যে কাজি বিয়ে পড়িয়েছেন এবং তাকে যারা বিয়ের আসনে বসতে বাধ্য করেছেন তাদের উপযুক্ত শাস্তি হবে না?

রোজিনা ঝিনাইদহের গান্না গ্রামের আয়ুব আলীর মেয়ে। বিয়ে হয়েছিলো চুয়াডাঙ্গা জেলা সদরের পাঁচমাইল ভাণ্ডারদহের মিজানুর রহমানের সাথে। পাত্রের পছন্দের প্রেক্ষিতে বিয়েতে অতি উৎসাহী হয়ে আনুমানিক ৬ মাস আগে বিয়ের আয়োজন করেন রোজিনার নানা ভাণ্ডারদহের আব্দুল মান্নান। পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সপ্তম শ্রেণির ছাত্রী তার নানাবাড়ি বেড়াতে এলে পাত্র তার নানাকে বিয়ের প্রস্তাব দেন। পাত্রের প্রস্তাবে সাড়া দিয়ে নানা বিয়ের আয়োজন করলেও রোজিনা তাতে রাজি হয়নি। খানেকটা জোর করেই বিয়ের আসনে বসানো হয়। বিয়ের পর স্বামীর সংসারে যেতে আপত্তি জানায়। পিতার বাড়িতে বেড়াতে যাওয়ার পর সে আর স্বামীর ঘরে ফিরতে চায়নি। এরপরও যখন তাকে বাধ্য করা হয়েছে তখন আত্মহত্যার পথে পা বাড়িয়েছে। স্বামীর বাড়িতে পৌঁছুনোর কিছুক্ষণের মাথায় বিষপান করে, তাকে হাসপাতালে নেয়া হয়। অল্প সময়ের মধ্যেই মারা যায়। আর আলমডাঙ্গা গোয়ালবাড়ির শোভা বিষপান করেছিলো বিয়ের তিন দিনের মাথায়। তাকেও সুস্থ করে তোলা যায়নি। এ ঘটনার মাস খানেকের মাথায় আরো একটি বাল্যবিয়ের বলি সমাজের নারী শিশুদের অসহায়ত্বেরই যে বহির্প্রকাশ তা বলাই বাহুল্য। রোজিনার আত্মহত্যার পর তার স্বামীপক্ষের আচরণ সন্দেহজনক। পিতাপক্ষের কোনো অভিযোগ নেই। এরপরও চুয়াডাঙ্গা পুলিশের আইন প্রয়োগে আন্তরিকতা অবশ্যই সমাজের রোজিনাদের অধিকার রক্ষায় সহায়ক হবে।

রোজিনাকে অপ্রাপ্ত বয়সে বিয়ের আসনে বসানো হয়েছে। ইচ্ছের বিরুদ্ধে তাকে স্বামীর সংসার করতে বাধ্য করা হয়েছে। দুটিই আইনের দৃষ্টিতে অপরাধ। এসব অপারধের উপযুক্ত বিচার না হলে সমাজে অভিন্ন অপরাধ প্রবণতা যে সংক্রমিত হবে তা বোদ্ধারা নিশ্চয় অস্বীকার করবেন না। অবশ্য বাল্যবিয়ে রোধে বিগত দিনগুলোর তুলনায় বর্তমান সমাজ অনেক দায়িত্বশীল। এরপরও কিছু অভিভাবক আছেন যারা অসচেতনতার অন্ধকার মুক্ত হতে না পারার কারণে নিজের হাতেই নিজের প্রাণপ্রিয় সন্তানকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেন। বাল্যবিয়েতে বাধ্য করা কিশোরী তথা স্কুলছাত্রী স্বামীর সংসার করতে অনাগ্রহী হয়ে উঠলে অনেক সময়ই অভিভাবকের তরফে বলা হয়, পাত্র পছন্দ না হওয়ার কারণে অমন করছে। সংসার করতে করতে একদিন ঠিক হয়ে যাবে। এরকম ধারণা বা মন্তব্য পোষণ পুরোনো রেওয়াজই নয়, অসচেতনতায় অমানবিক পদক্ষেপ। এ ধরনের অসচেতন অভিভাবকদের সচেতন করতে দেশে প্রচলিত আইনের যথাযথ প্রয়োগ প্রয়োজন। একই সাথে অপ্রাপ্ত কনের বিয়ে সম্পাদন করা কাজিরও উপযুক্ত শাস্তি অনিবার্য। যদিও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই প্রকৃত বয়স আড়াল করতে অর্থের বিনিময়ে সংগৃহীত জন্মসনদ হাজির করার কারণে কাজিদের অনেকেই সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারছেন না। সে কারণে এ ধরনের জন্মসনদ প্রদানকারীদের বিরুদ্ধেও উপযুক্ত শাস্তির দাবি যুক্তিযুক্ত।

উত্ত্যক্ত? বাল্যবিয়ের মতো আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত না নিয়ে আইনের পথে হাঁটাই শ্রেয়। আত্মহত্যা কোনো সমাধান নয়। আত্মহত্যায় প্ররোচনাকারীদের দায়িত্বশীল করতে তথা তাদের সুধরে সঠিক পথে নিতে অবশ্যই আইন প্রয়োগকারী সংস্থাসমূহের কর্তব্যরতদের দায়িত্বশীলতা কাম্য। বাল্যবিয়ে রোধে চলমান সামাজিক আন্দোলন ত্বরান্বিত করতে প্রশাসনের পাশাপাশি সমাজের সচেতনমহলকে আরো সজাগ হওয়া প্রয়োজন। প্রয়োজন সম্মিলিত প্রচেষ্টা। বলির পর নয়, তার আগেই দরকার আশু পদক্ষেপ।