স্টাফ রিপোর্টার: বিংশ শতাব্দীতে বাংলা সাহিত্য তথা সমগ্র বিশ্ব সাহিত্যের বিস্ময়করসাহিত্য ও সঙ্গীত প্রতিভা কাজী নজরুল ইসলাম। বিশ্ব রাজনৈতিক-অর্থনৈতিকপ্রতিযোগিতার অঙ্গনে প্রাচ্যের তথা এশিয়া মহাদেশের ভূমিকা, অবদান ও মহিমামহিমান্বিত ভঙ্গিতে তুলে ধরার মহান পুরুষ কাজী নজরুল। তার বিখ্যাত কবিতা ‘সব্যসাচী’তে তিনি প্রাচ্যের মহিমা, বিশ্ব সভ্যতার পথ পরিক্রমা ও বিকাশমানধারায় প্রাচ্যের বিশেষত মধ্য এশিয়া, মধ্য প্রাচ্য ও দক্ষিণ এশিয়ার অনন্যসাধারণ ভূমিকা ও অবদানের কথা তুলে ধরেছেন। প্রাচ্য পৃথিবীর এই অঞ্চলের অমিতসম্ভাবনা ও অত্যাশ্চর্য শক্তি-সামর্থের কথা প্রবলভাবে তুলে ধরেছেন। তিনিবলছেন: ‘ওরে! ভয় নাই আর, দুলিয়া উঠিছে হিমালয়-চাপা প্রাচী/গৌরী শিখরেতুহিন ভেদিয়া জাগিছে সব্যসাচী।’কিন্তু এই দুটি পংক্তির মধ্যে নিজেরঅজান্তেই তিনি যেন তার নিজের অসাধারণ শক্তিমত্তা ও মহিমাদীপ্ত পৌরুষকেওউপস্থাপন করার প্রয়াস পেয়েছেন। পাশ্চাত্যের মহাসভায় অবহেলিত প্রাচ্যের একমহান প্রতিনিধি হিসেবে নিজের শক্তি ও সাহসিকতার সেইসাথে অপার সম্ভাবনারকথাও যেন তিনি তুলে ধরেছেন এই মহত্ কবিতায়। তিনি নিজেও যেন তার কবিতায়রূপায়িত বরফাচ্ছাদিত গৌরী পর্বতমালার শিখর ভেদ করে বিংশ শতাব্দীতেপাশ্চাত্য-শক্তি নিয়ন্ত্রিত বিশ্বসভায় প্রাচ্যের মহান পুরুষ, মহানপ্রতিনিধি রূপে নিজেকে ‘হাজির’ ঘোষণা করছেন।
আজ সেই মহান পুরুষবাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ৩৮তম মৃত্যুবার্ষিকী। ৩৮ বছর আগে১৯৭৬ সালের এই দিনে (১৩৮৩ বঙ্গাব্দের ১২ ভাদ্র) ঢাকায় তত্কালীন পিজিহাসপাতালে এই মহত্প্রাণ মহান কবির জীবনাবসান ঘটে। কাজী নজরুল ইসলাম প্রেমেরকবি, বিরহ-বেদনা ও সাম্যের কবি। বাংলা সাহিত্য-সঙ্গীত তথা সংস্কৃতিরপ্রধান পুরুষ। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে তার লেখনী ধুমকেতুর মত আঘাত হেনেজাগিয়ে দিয়েছিল ভারতবাসীকে। তিনি পরিণত হন বিদ্রোহের কবিতে। আজও তার নানাধরনের লেখার মাঝ থেকে বিদ্রোহের পংক্তিমালা বাঙালির হূদয়ে অনাচারেরবিরুদ্ধে বিদ্রোহের দুন্দুভি বাজিয়ে চলে। তার কবিতা ‘চল চল চল’ বাংলাদেশেরজাতীয় রণসঙ্গীত।
বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে ‘বিদ্রোহী কবি’ কাজীনজরুল ইসলাম বিশ শতকের বিশ ও ত্রিশের দশকে উপমহাদেশের অবিভক্ত বাংলারসাংস্কৃতিক জগতে সবচেয়ে বর্ণাঢ্য ব্যক্তিত্ব ছিলেন। রবীন্দ্রনাথের ব্যর্থঅনুকরণ ও অনুসরণের কৃত্রিমতা থেকে আধুনিক বাংলা কবিতাকে মুক্ত করারক্ষেত্রে কাজী নজরুল ইসলামের ভূমিকা ছিলো সবচেয়ে প্রবল ও ফলপ্রসূ। তাই তিনিইরবীন্দ্রোত্তর সাহিত্যে আধুনিকতার পথিকৃত্। নজরুল তার কবিতা, সঙ্গীত, উপন্যাসসহ অন্যান্য লেখনী ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের মধ্যদিয়ে পরাধীন ভারতেওএকইসাথে অবিভক্ত বাংলাদেশে সামপ্রদায়িকতা, সামন্তবাদ, সাম্রাজ্য ওউপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বলিষ্ঠ ও প্রবল কণ্ঠ ছিলেন। ইংরেজ সরকার তারগ্রন্থ ও রচনা বাজেয়াপ্ত করেছে বারবার এবং কারাদণ্ড দিয়েছে। কারাগারেওবিদ্রোহী নজরুল টানা চল্লিশ দিন অনশন করে বিদেশি সরকারের জেল-জুলুমেরপ্রতিবাদ করেছেন।
কাজী নজরুল ইসলামের জন্ম বাংলা ১১ই জ্যৈষ্ঠ১৩০৬/১৮৯৯ইং, পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার চুরুলিয়া গ্রামে। তার পিতার নামকাজী ফকির আহমেদ, মা জাহেদা খাতুন। দরিদ্র পরিবারে জন্মগ্রহণ করায়দুঃখ-দারিদ্র্য ছিলো তার নিত্যসঙ্গী। তার ডাকনাম ছিলো‘দুখু মিয়া’। পিতারঅকাল মৃত্যুতে পরিবারের ভরণপোষণের জন্য তিনি শিশু বয়সেই মক্তবে শিক্ষকতা, হাজি পালোয়ানের মাজারে খাদেম এবং মসজিদের মুয়াজ্জিনের কাজ করেছেন।পরবর্তীকালে বাংলা সাহিত্যে ইসলামী ঐতিহ্যের সার্থক ব্যবহারে এ সম্পৃক্ততাখুব ফলপ্রসূ হয়েছে।
কাজী নজরুলের গান বাংলা সঙ্গীতের ওসঙ্গীত-সাহিত্যের ইতিহাসে সবচেয়ে সৃজনশীল, মৌলিক, বাণী ও সুর সঙ্গীতেরপ্রধান সৃষ্টি। তাই শুধু কবিতায় নন, আধুনিক বাংলা সঙ্গীতের নজরুল পথিকৃত্ ওসর্বপ্রধান প্রতিভা।১৯৭২ সালের ২৪ মে তত্কালীন প্রধানমন্ত্রীবঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের উদ্যোগে কবি সপরিবারে বাংলাদেশে আসেন।বাংলাদেশ সরকার কাজী নজরুল ইসলামকে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব প্রদান করে এবং ‘জাতীয় কবি’ হিসাবে ঘোষণা দেয়। মৃত্যু পর্যন্ত তিনি বাংলাদেশেই ছিলেন।তার জৈবিক আয়স্কাল ৭৮ বছর হলেও ১৯৪২ সালের জুলাই মাসে গুরুতর অসুস্থ হয়েপড়েন। এরপর দীর্ঘ ৩৪ বছর ১৯৭৬ সালের ২৯ আগস্ট মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনিনির্বাক জীবন কাটিয়েছেন।
দামুড়হুদা অফিস জানিয়েছে,‘বল বীর বল উন্নত মমশির! শির নেহারী,আমারি নত শির ওই শিখর হিমাদ্রির! বল বীর-সুগভীর’ আত্ম প্রত্যয়ে উদ্দীপ্ত এ বিদ্রোহী বাণী নিয়ে বাংলা কবিতার অঙ্গনে কাজী নজরুল ইসলামের আবির্ভাব। আজ ১২ ভাদ্র বুধবার বেলা ১১টায় সেই মহান কবির মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে স্মরণসভা দামুড়হুদা নির্বাহী কর্মকর্তার উদ্যোগে অনুষ্ঠিত হবে। প্রতিবারের ন্যায় এবারও কার্পাসডাঙ্গা ইউপি হলরুমে পালিত হবে অনুষ্ঠানটি। নজরুল গবেষক এম.ইব্রাহীমের তথ্যানুযায়ী, বাবু মহিম সরকারের আমন্ত্রণে কোলকাতার আর্মহ্রাস্ট-স্ট্রিট থেকে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম ১৯২৬ থেকে ১৯২৭ সালে এ কার্পাসডাঙ্গায় সপরিবারে পদার্পণ করেন। পর্যায়ক্রমে দীর্ঘ দু মাস এখানকার হর্ষপ্রিয় বাবুর আজো দণ্ডায়মান আটচালা খড়ের ঘরে বাস করে স্মৃতির নিবাস গড়ে গেছেন।কালজয়ী সৃষ্টির মধ্যে এখানে রচিত লিচুচোর, পদ্মগোখরাসহ অসংখ্যসৃষ্টিতে ইতিহাস গড়ে গেছেন। মিশন ঘাটের সিঁড়িতে বসে রচনা করেন- ‘কোন কূলে আজ ভিড়লো তরী এ কোন সোনার গাঁয়’সহ অসংখ্য গান।বাবু মহিম সরকারের মেয়ে শিউলি রাণী ও আভারাণী কবির কাছ থেকে গানের তালিম নিতেন। যা কোলকাতার রেডিও স্টুডিওতে রেকর্ডিং হয় এবং প্রচারিত হয়। এমন দলিলও সংগৃহীত আছে। কোনো কোনো তথ্য মতে, কবি নজরুল এখানে ব্রিটিশ তাড়াতেই জনগণকে উদ্দীপ্ত করতে এসেছিলেন। এখানে নীলকুঠির প্রাসাদ থেকে ইংরেজরা অন্যায়, অত্যাচার শাসনের নীলচাষে বাধিত করা কৃষককূলকে জাগাতেই চুপিচুপি বিদ্রোহী কবি বেশ কয়েকবার এখানে এসেছিলেন। বিদ্রোহী কবির আত্মজীবনী থেকে যা পাওয়া যায়,কবি নিপীড়িত ও পদানত মানুষকে তার সৃষ্টির মাধ্যমে বিদ্রোহের মন্ত্রে উজ্জীবিত করেছেন। সাম্রাজ্যবাদী শাসকের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছেন। আপস করেননি কখনো। বিদ্রোহী মূল্যবোধকে স্থায়ী প্রতিষ্ঠা দিয়েছেন আমাদের সাহিত্য ও জীবন। এদেশের নিপীড়িত মানুষের গণতান্ত্রিক সংগ্রামে অনুপ্রেরণা দিয়েছে নজরুলের রচনা। নজরুল লিখেছেন প্রেমের কবিতা, ইসলামী কবিতা, বিদ্রোহী কবিতা, সনেট কবিতাসহ গানের মাতম ছড়িয়েছেন মানুষের হৃদয় কুঠিরে।প্রবন্ধ-নিবন্ধকার হিসেবেও নজরুলের প্রতিভা অনস্বীকার্য।নিঃসন্দেহে এ জাতিসহ এলাকাবাসী নজরুলের কাছে চিরঋণী। ‘মসজিদেরই পাশে আমার কবর দিও ভাই’কবির এ শায়িত কথা স্মরণ স্মৃতিতে গেঁথে রবে চিরকাল। আজ কবির মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে কার্পাসডাঙ্গায় আয়োজিত স্মরণসভায় অত্র এলাকার সকল কবি-সাহিত্যিক,সাহিত্যানুরাগী নজরুলপ্রেমী মানুষের উপস্থিত থাকার জন্য আহ্বান করা হয়েছে।