আসন্ন কোরবানির বাজার ধরতে গরু মোটাতাজাকরণে ব্যস্ত ঝিনাইদহের খামারীরা

 

 

জেলায় ১ হাজার ৩৯টি ছোটবড় খামার: ভারত থেকে চোরাইপথে গরু আনা বন্ধের দাবি

শাহনেওয়াজ খান সুমন: কোরবানির ঈদের বাজার ধরতে ঝিনাইদহের সহস্রাধিক ক্ষুদ্র খামারীরা গরু মোটাতাজাকরণ প্রকল্পে অর্থ বিনিয়োগ করেছেন। পর পর তিন বছর লোকসান দিয়ে এবার ভালো দাম পাওয়ার আশা করছেন তারা। রাজনৈতিক অস্থিরতা না থাকার কারণে এ বছর গরুতে লাভ হবে এমনটি আশা করছেন গরু খামারীরা।

হরিণাকুণ্ডু উপজেলার তৈলটুপি গ্রামের ক্ষুদ্র খামারী আব্দুর রহিম বলেন, তাদের গ্রামে ৮০টি পরিবার ব্যক্তিগত উদ্যোগে ক্রসবিড জাতের গরু পালন করছেন। তিনি নিজেও পালন করছেন ২/৩টি গরু। একই গ্রামের বজলুর রহমান জোয়ার্দার ও তার ছেলে আদিল উদ্দীন জোয়ার্দার মিলে সবচেয়ে বড় গরু মোটাতাজাকরণ খামার গড়ে তুলেছেন। তাদের খামারে হরিয়ানা, নেপালি ও ক্রসবিড জাতের ১৩টি গরু রয়েছে। দাম ভালো থাকলে এ বছর ১৩টি গরু ৭০ লাখ টাকায় বিক্রি করা যাবে বলে পিতা-পুত্র আশা প্রকাশ করেন। বজলুর রহমান জোয়ার্দ্দার জানান, গরু পালন তার নেশা। গত বছর রাজনৈতিক অস্থিরতা ও চোরাই পথে ভারত থেকে গরু আসায় ভালো দামে গরু বিক্রি করতে পারিনি। লোকসানের পরও এ বছর তিনি ১৩টি গরু মোটাতাজা করেছেন। ছেলে আদিল উদ্দীন জোয়ার্দার জানান, ভূষি, চিটেগুড়, খুদকুড়া ও খৈলের দাম বৃদ্ধির পরও তাদের পরিবার পনেরো বছর ধরে গরু মোটাতাজাকরণ করছেন। পরিবারে তার মা, ভাই ও স্ত্রী গরু পালনে সহায়তা করেন।তবে গরু মোটাতাজায় তারা কোনো ইনজেকশন ব্যবহার করেন না বলে দাবি করেন। তাদের ভাষ্য, কৃষিকাজে তারা যে গম, খৈল ও ভুষি পান তা থেকেই গরুর খাবার জোগান দেন। তাছাড়া যারা ঈদের ১/২ মাস আগে গরু কিনে পালন করেন তারাই ইনজেকশনে গরু মোটাতাজা করেন। ঝিনাইদহে সরকারিভাবে বড় ধরনের কোনো খামার বা গরু মোটাতাজাকরণ প্রকল্প না থাকলেও গ্রামের স্বল্প আয়ের মানুষগুলো বাড়তি লাভের আশায় কোরবানি ঈদের ৬ মাস আগ থেকেই গরু মোটাতাজায় লগ্নি করেন। আর এভাবেই ৬টি উপজেলায় ১ হাজার ৩৯টি ছোটবড় খামার গড়ে উঠেছে।

জেলা প্রাণিসম্পদ কার্যালয়ের তথ্যমতে, ঝিনাইদহ সদর উপজেলায় ২০৬, হরিণাকুণ্ডু উপজেলায় ২৭০, শৈলকুপায় ৯০, কোটচাঁদপুরে ১৫৭, মহেশপুরে ১০৯ এবং কালীগঞ্জে ২০৭টি খামার আছে। ঝিনাইদহ সদর উপজেলার বিজয়পুর, শৈলকুপা উপজেলার ভাটই, কালীগঞ্জ উপজেলার বেথুলি মল্লিকপুর, নাটোপাড়া, হরিণাকুণ্ডুর জোড়াপুকুর, মহেশপুরের হামিদপুর গ্রাম ঘুরে বেশকিছু মাঝারি খামার চোখে পড়ে।ঝিনাইদহ সদর উপজেলার বিজয়পুর উত্তরপাড়ায় নারায়ণগঞ্জের শিল্পপতি হাবিবুর রহমান ৩৮টি গরু নিয়ে খামার গড়ে তুলেছেন। কোরবানির সময় তিনি বাজারে নয়, বন্ধুদের কাছে গরু বিক্রি করেন। তারা জানান, ঝিনাইদহ জেলা প্রাণিসম্পদ দপ্তরের নির্দেশনা অনুযায়ী তারা গরুর পরিচর্যা করেন। সম্পূর্ণ দেশি খাবার দিয়ে তাদের খামারের গরু মোটাতাজা করা হয়। খামারের কেয়ারটেকার আফান উদ্দীন ও জুয়েল জানান, ৬ মাস আগে খামারের প্রতিটি গরু ৮০ থেকে এক লাখ টাকায় কেনা হয়। ঈদ মরসুমে প্রতিটি গরু তিন লাখ টাকার ওপরে বিক্রি হবে বলে তারা আশা করেন। কালীগঞ্জ উপজেলার বেথুলি মল্লিকপুর গ্রামের তানজিল হোসেন প্রিন্স দুগ্ধ খামারের পাশাপাশি ১৭টি গরু নিয়ে মাঝারি ধরনের খামার গড়ে তুলেছেন। এ বছর প্রতিটি গরু দুই লাখ টাকা করে বিক্রি করা যাবে বলে তিনি জানান।

ঝিনাইদহ প্রাণিসম্পদ বিভাগের এনএটিভি প্র্রকল্পের পল্লী চিকিৎসক শুভাঙ্কর ঘোষ জানান, একসময় ডেকসামেথাসন বা এসটেরয়েড জাতীয় হরমোন বৃদ্ধির ওষুধ খাওয়ানোর প্রচলন ছিলো। এওষুধ সেবনের ফলে গরুর মাংস দ্রুত বৃদ্ধি হলেও গরুর জীবন বিপন্ন হতো। এখন তো খামারীরা ৬/৭ মাস আগেই গরু কিনে পালন করেন। তাই তারা গরু মোটাতাজাকরণে বেশ সময় পাচ্ছেন। তিনি আরো জানান, প্রাণিসম্পদ বিভাগ থেকে প্রশিক্ষণ দেয়ার সময় খামারীদের বিপজ্জনক পথ থেকে সরে আসার আহবান জানানো হয়েছে। সদর উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. জসিম উদ্দীন জানান, দানাদার খাদ্য যেমন খৈল, ভুষি ও খুদকুড়ার দাম বৃদ্ধির কারণে জেলায় খামারীর সংখ্যা কমে যাচ্ছে। গত বছরের চেয়ে এবার দাম ভালো থাকায় ক্ষুদ্র খামারীরা বেশ উজ্জীবিত।

জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. কানাইলাল স্বর্ণকার জানান, জেলায় প্রচুর ঘাস হয়। তাই গরুর খামার করার এখানে যথেষ্ট সম্ভাবনা গড়ে উঠেছে। সবচে বড় কথা যারাই খামার করছেন, তারা কৃষিকাজের সাথে যুক্ত। তিনি আরো বলেন, এফএমভি ভ্যাকসিনের অভাবে আমরা খামারীদের স্বল্পমূল্যে তা সরবরাহ করতে পারছি না। বাইরে থেকে এফএমভি ভ্যাকসিন ২শ টাকা করে খামারীদের কিনতে হচ্ছে। অথচ সরকারিভাবে এই ভ্যাকসিনের দাম মাত্র পাঁচ টাকা। তিনি বলেন, আগে গরু মোটাতাজাকরণে ক্ষতিকর ইনজকশন ব্যবহার হতো। প্রাণিসম্পদ দপ্তরের নজরদারি ও খামারীরা সচেতন হওয়ায় এখন কেউ আর ইনজেকশন দেয় না। এখন খামারীরা কৃমিনাশক বড়ি ও ক্ষুধাবৃদ্ধির জন্য মিনারেল ট্যাবলেট খাওয়ান।