নির্বিচারে হত্যায় প্রকৃতি থেকে হারিয়ে যাচ্ছে বাগডাশাসহ বিরল প্রজাতির প্রাণী

 

মহাসিন আলী:পৃথিবীতে জানা-অজানা অনেক প্রাণী রয়েছে। ভিন্ন ভিন্ন প্রাণীর রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন কাজ ও গুরুত্ব। এরা সবাই প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষা করে থাকে। প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষার্থে বন্যপ্রাণি সংরক্ষণ খুবই জরুরি। এদের মধ্যে অনেকে হিংস্র আবার অনেকে শান্ত। তবে শান্ত বা হিংস্র যাই হোক না কেনোপ্রাণী মাত্রই ভীতু। তারা আত্মরক্ষার্থে মানুষকে আক্রমণ করে। অবিচার-নির্বিচারে এদের ধ্বংস করা উচিত নয়। এমনি অবিচার-নির্বিচারে হত্যা করা হচ্ছে বাগডাশা নামের প্রাণী। বাগডাশা দেশের দক্ষিণ-পশ্চিশ অঞ্চলের অধিকাংশ মানুষের কাছে বিশেষভাবে পরিচিত।অঞ্চল ভেদে এদের বাঘুইলা, মেচি বাঘ আর ছোট বাঘ বলেও ডাকা হয়। প্রকৃতি থেকে হারিয়ে যাচ্ছে এ প্রাণী।বাগডাশা একটি নিশাচর প্রাণী। মানুষের থেকে এরা সব সময় দূরে থাকার চেষ্টা করে। তাই লোকালয়ের বাইরে দিনের বেলা গাছের খোঁড়ল, মাটির গর্তে কিংবা ঝোপ-ঝাড়ের মধ্যে এরা লুকিয়ে থাকে। এদের শরীরের গড়ন লম্বাটে। সামান্য হলুদে মেশানো ধূসর রঙের চামড়ায় ছোপ ছোপ কালো কালো দাগ রয়েছে। এদের কান ছোট এবং গোলাকার। এদের চোখের পেছন থেকে গলার শেষ পর্যন্ত ৬ থেকে ৮টি কাল বর্ণের ডোরাকাটা দাগ থাকে। মুখমণ্ডল বাঘ বা বাঘের মাসি বিড়ালের ন্যায়। কপাল থেকে ঘাড় পর্যন্ত লম্বা কালো দাগ রয়েছে। পূর্ণ বয়স্ক বাগডাশা ২ ফুট পর্যন্ত লম্বা হয়ে থাকে এবং এর এক ফুট লম্বা লেজ হয়। এদের ওজন ৫ কেজি থেকে ১৬ কেজি পর্যন্ত হয়ে থাকে।এরা ১৫ মাস বয়স হলে প্রজনন উপযোগী হয়। সাধারণত মার্চ মাস থেকে জুন মাস এদের প্রজননের সময়। একসাথে এরা ২-৩টি বাচ্চা প্রসব করে। সাধারণত প্রতিটি বাচ্চার ওজন হয় গড়ে ১৭০ গ্রাম। এরা ১০ বছর পর্যন্ত বেঁচে থাকে।বাগডাশা রাতের বেলা খাদ্যের সন্ধানে বের হয়। এরা মাংস ও মাছ জাতীয় খাদ্য খেয়ে জীবনধারণ করে। বাগডাশা মূলত মাছ ও কাঁকড়াভুক প্রাণী। এছাড়াও এদের খাদ্য তালিকায় রয়েছে শামুক, হাঁস-মুরগি, ছাগল, ভেড়া ও গরুর বাছুর। খাদ্য অভাব দেখা দিলে মাঝে মধ্যে এরা মানুষের ঘরে ঢুকে বাচ্চা শিশু তুলে নিয়ে যায়। সন্ধ্যা বা রাতের বেলায় এ কাজটি করার অভ্যাস তাদের আছে। বাগডাশা মাছ ধরার জন্য ঠিক পানিতে নামে না। পানির ওপরে থাকা গাছের ডালে কিংবা পানির ওপর জেগে থাকা কোনো পাথরের ওপরে বসে থাবা দিয়ে এরা মাছ শিকার করে খায়।

হিংস্র হলেও বাগডাশা ভীতু প্রাণী। অথচ হিংস্র ভেবে এ প্রাণীটি নির্বিচারে হত্যা করছে মানুষ। মেহেরপুর সদর উপজেলার যুগিন্দা, ঝাঁঝা, হরিরামপুর ও কোলা, গাংনী উপজেলার গোপালনগর, বামন্দী, বাগুন্দা ও চিৎলা এবং মুজিবনগর উপজেলার মহাজনপুর ও বাগোয়ান গ্রামসহ মেহেরপুর জেলার বিভিন্ন এলাকায় মাঝে মাঝে হত্যার শিকার হয়ে এখনও এ প্রাণীর অস্তিত্ব আছে বলে জানান দেয়। স্থানীয় ও জাতীয় দৈনিক এবং অন লাইন নিউজ পোর্টালে অনেক সময় মেছো বাঘ তথা বাগডাশার মৃত্যুর খবর দেখা যায়। খবর পড়ে জানা যায় কোনো কারণ ছাড়াই হত্যা করা হয়েছে। হিংস্র ভেবে এদের নির্বিচারে হত্যা করা বন্যপ্রাণি ধ্বংসের নামান্তর। যার প্রভাব আমাদের প্রকৃতিতে পড়ছে। আগেকার মানুষ যখন বন জঙ্গলের ধারে বাস করতো তখন তাদের কেউ কেউ বাঘের সাথে লড়াই করেছেন। চিতা বাঘসহ বিভিন্ন হিংস্র প্রাণীর ভয়ে সন্ধ্যার পরে রাস্তায় একা কেউ বের হতেন না। জরুরি প্রয়োজনে তারা রাস্তায় দল বেঁধে চলতেন। এখন আগের মতো আর জঙ্গল নেই। জনসংখ্যা বৃদ্ধিতে বসবাসের জন্য ঘরবাড়ি তৈরি করা আর চাষাবাদের জন্য বন-জঙ্গল ও উঁচু ঢিবি কেটে সমান করা হচ্ছে। বনজঙ্গল কেটে শহর-গ্রাম গড়ে তোলা হচ্ছে। এতে বন্যপ্রাণি হারিয়ে যেতে বসেছে। নির্বিচারে মেছো বাঘ তথা বাগডাশা হত্যা করা হলেও এরা কারো কোনো ক্ষতি করেছে এমনটি শোনা যায়না।

গাংনী সামাজিক বনায়ন নার্সারি ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মনিরুল ইসলাম বলেন, মেছো বাঘ বা বাগডাশা যে নামেই ডাকা হোকনা কেনো বিড়াল প্রজাতির বহু প্রাণীর মধ্যে এটি একটি। এ প্রাণী পরিবেশের জন্য উপকারী। কোনো মাঠে দু’-চারটি মেছো বাঘ বা বাগডাশা থাকলে ধান-গমসহ বিভিন্ন ফসলের ক্ষতিকারক ইঁদুর জাতীয় প্রাণীর হাত থেকে ফসল অনেক অংশে রক্ষা পায়।

খুলনা সরকারি ব্রজলাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএল কলেজ) প্রাণীবিদ্যা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ড. একেএম নজরুল কবীর বলেন, হিংস্র হলেও মেছো বাঘ বা বাগডাশা একটি ভীতু প্রাণী। আত্মরক্ষার্থে ছাড়া এরা সহজে মানুষকে কামড়ায় না। নির্বিচারে আমরা তাদের মেরে ফেলি। প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষায় এদের ভূমিকা কম নয়। তাই মেছো বাঘ বা বাগডাশা রক্ষা করা আমাদের কর্তব্য।