৭ খুন: নারায়ণগঞ্জ পুলিশের ৭৯ কর্মকর্তাকে একযোগে বদলি

মন্ত্রণালয়ের গঠিত তদন্তটিমের ঘটনাস্থল পরিদর্শন : নরসিংদ থেকে নারীসহ গ্রেফতার ৩

 

স্টাফ রিপোর্টার: নারায়ণগঞ্জের পুলিশের ৭৯ জন কর্মকর্তাকে একযোগে বদলি করা হয়েছে। অপরদিকে নরসিংদী থেকে এক নারীসহ ৩ জনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। মন্ত্রণালয়ের গঠিত উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত দল গতকাল বৃহস্পতিবারঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছে। নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলাম ও আইনজীবী চন্দন সরকারসহ ৭ জনকে অপহরণের পরহত্যার বিষয়টি দেশ জুড়ে আলোচিত বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। একের পর এক নেপথ্য উন্মোচনের পাশাপাশি মূল আসামি নূর হোসেনের অবর্তমানে তার সাম্রাজ্যকে চালাচ্ছে তা নিয়েও সরব আলোচনা চলছে।

নারায়ণগঞ্জেসেভেন মার্ডার হত্যা মামলায় জড়িত সন্দেহে মহিলাসহ ৩ জনকে নরসিংদী থেকেগ্রেফতার করেছে পুলিশ। এ সময় তাদের বাড়ি থেকে ১৭ ভরি সোনার গয়না, নগদ ১লাখ ৮৫ হাজার টাকাসহ ব্যাংকের চেক বই জব্দ করা হয়েছে। গতবুধবার ভোরে শিবপুরউপজেলার কারাচর গ্রামের হেমায়েত উদ্দিনের বাড়িতে অভিযান চালিয়ে তাদেরগ্রেফতার করা হয়। তদন্তের স্বার্থে এটি গোপন রাখা হলেও গতকাল বৃহস্পতিবারসাংবাদিকরা পুলিশের কাছ থেকে এ তথ্য জানতে পারেন।
গ্রেফতাকৃতরা হলেনসেভেন মার্ডার হত্যা মামলায় প্রধান আসামি নূর হোসেনের ঘনিষ্ঠ সহচরশাজাহানের স্ত্রী মমিনা আক্তার (২৭), তার শ্যালক মিন্টু মিয়া (২৪) ওমাকসুদা টেক্সটাইলের সুপারভাইজার টিপু (৪০)। আলোচিত এ হত্যাকাণ্ডের পরশাজাহান পালিয়ে গেলেও তার স্ত্রী, শ্যালক ও সহযোগী টিপু শিবপুর উপজেলারকারাচর গ্রামের শাজাহানের বোনের বাড়িতে আশ্রয় নেন। চিটাগাং রোড ট্রাকসমিতির সভাপতি শাজাহান নূর হোসেনের দক্ষিণহস্ত হিসেবে পরিচিত। পুলিশ জানায়, সেভেন মার্ডার ঘটনায় সন্দেহভাজন ৩ আসামি নরসিংদীর শিবপুরে অবস্থান করছেএমন তথ্যের ভিত্তিতে পুলিশ কারাচর গ্রামে হেমায়েত উদ্দিনের বাড়িতে অভিযানচালায়। এ সময় পুলিশ শাজাহানের স্ত্রী ও শ্যালকসহ তিনজনকে গ্রেফতার করে। পরেতাদের নারায়গঞ্জে নেয়া হয়। অভিযানে নারায়ণগঞ্জের গোয়েন্দা পুলিশ, নরসিংদীপুলিশের পাশাপাশি শিবপুর থানা পুলিশ অংশ নেয়।শাজাহানের বোন কোহিনুরবেগম বলেন, গতসোমবার বিকেলে শাজাহানের স্ত্রী ও শ্যালকসহ তিনজন আমাদের বাড়িতেআশ্রয় নেন। তবে কী কারণে তাদের গ্রেফতার করা হয়েছে তা তিনি জানাতেপারেননি। তিনি বলেন, অভিযান পরিচালনার সময় পুলিশ বাসায় থাকা ১৭ ভরিসোনার গয়না, নগদ ১ লাখ ৮৫ হাজার টাকা ও ব্যাংকের চেক বইসহ জরুরিকাগজপত্র নিয়ে যায়। গ্রেফতারকৃতদের বিষয়েনারায়ণগঞ্জ পুলিশ সুপার গতকাল বৃহস্পতিবার সংবাদ সম্মেলনে বলেন, সুনির্দিষ্টতথ্যের ভিত্তিতে এ ৩ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। জিজ্ঞাসাবাদ শেষে বলা যাবে, এরা ঘটনার সাথে জড়িত কিনা। এছাড়া ঘটনার রহস্য উন্মোচনের জন্য গঠিতনারায়ণগঞ্জ পুলিশের একটি উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন কমিটি গত বুধবার এক সংবাদের সূত্র ধরে এমবিবি ব্র্যান্ডের ইটসহ বেশ কয়েকটি আলামতেরনমুনা সংগ্রহ করেছে। সরকারের একটি গোয়েন্দা সংস্থা ঘটনাস্থলে গিয়ে নমুনারভিডিও এবং স্থিরচিত্র ধারণ করেছে।

নারায়ণগঞ্জেচাঞ্চল্যকর ৭ অপহরণ ও খুনের ঘটনায় এলিট ফোর্স র‌্যাপিড অ্যাকশনব্যাটালিয়নের সম্পৃক্ততার অভিযোগ ওঠার পর থেকে র‌্যাব-১১ এর কার্যক্রমদৃশ্যত স্থবির হয়ে পড়েছে। শীতলক্ষ্যা থেকে লাশ উদ্ধারের পর শহরের কোথাওর‌্যাব সদস্যদের দেখা যাচ্ছে না। স্থানীয়রা জানিয়েছেন, স্বাভাবিক সময়ে শহরেসার্বক্ষণিক র‌্যাব সদস্যদের একাধিক টহল গাড়ি দেখা যেতো। কিন্তু এখন তাদেখা যাচ্ছে না।৭ অপহরণ ও খুনের ঘটনায় র‌্যাব-১১’র৩ জন সদস্যের সম্পৃক্ততার অভিযোগ ওঠার পর সিনিয়র আইনজীবীসহ দেশের বিশিষ্টনাগরিকদের পক্ষ থেকে এ ইউনিটের সব সদস্যকে প্রত্যাহারের দাবি জানানো হয়।সূত্র জানিয়েছে, র‌্যাব-১১ এর অধিনায়কসহ উচ্চপদস্থ তিন কর্মকর্তাকে নিজস্ববাহিনীতে প্রত্যাহার করে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের পর এ ব্যাটালিয়নেরবেশির ভাগ কর্মকর্তা এখন ঢাকায় অবস্থান করছেন। তবে র‌্যাব-১১ এর ভারপ্রাপ্তঅধিনায়ক দাবি করেছেন তাদের কার্যক্রম স্বাভাবিক রয়েছে। কার্যক্রম স্থগিতকরা বা তাদের স্থবির হয়ে পড়ার কোনো সুযোগ নেই।

আলোচিত ৭ খুনের ঘটনায় নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লা ও সিদ্ধরগঞ্জ থানার ৪০ জন এসআইএবং ৩৯ জন এএসআইকে একযোগে বদলি করা হয়েছে।বৃহস্পতিবার রাতে এ আদেশ পুলিশহেডকোয়ার্টার থেকে জেলা পুলিশ সুপার কার্যালয়ে পৌঁছে।নারায়ণগঞ্জেরপুলিশ সুপার খন্দকার মহিদ উদ্দিন বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। রিপোর্ট লেখাপর্যন্ত বদলিকৃত এসব পদে কোনো কর্মকর্ত‍া যোগদান করেননি। তবে আগামীকালেরমধ্যে কর্মকর্তারা যোগ দিতে পারেন।এর আগে বৃহস্পতিবার দুপুরেনারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জ থানার ওসি আব্দুল মতিনকে টাঙ্গাইলে, গোয়েন্দাপুলিশের ওসি মাহবুব রেজা ও তদন্ত কর্মকর্তা আব্দুল আওয়ালকে বরিশাল রেঞ্জেবদলি করা হয়।
এদিকে গত ​মঙ্গলবার একই ঘটনায় র‌্যাব কর্মকর্তাত্রাণমন্ত্রী মায়ার জামাই লেফটেন্যান্ট কর্নেল তারেক সাঈদ মাহমুদ, মেজরআরিফ হোসেন ও লে. কমান্ডার এম এম রানাকে চাকরিচ্যুত করা হয়। তাদেরকেবর্তমানে ক্যান্টনমেন্ট ‘লগ এরিয়ায়’ অন্তরীণ রাখা হয়েছে।তাদেরবিরুদ্ধে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলর ও গডফাদার নূর হোসেন ওরফেহোসেন চেয়ারম্যানের কাছ থেকে ৬ কোটি টাকা ঘুষ নিয়ে আরেক কাউন্সিলর নজরুলইসলাম ও প্রবীণ আইনজীবী চন্দন সরকারসহ ৭ জনকে অপহরণ করে হত্যায় জড়িতথাকার অভিযোগ রয়েছে।

নারায়ণগঞ্জেরওয়ার্ড কাউন্সিলর নজরুল ইসলাম ও আইনজীবী চন্দন সরকারসহ ৭ জনকে অপহরণের পরহত্যার ঘটনায় হাইকোর্টের নির্দেশে গঠিত তদন্ত কমিটি গতকাল বৃহস্পতিবারপ্রথমবারের মতো ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছে। কমিটির প্রধান জনপ্রশাসনমন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মো. শাহজাহান আলী মোল্লা বলেছেন, তারা ৭দিনের মধ্যে তদন্তের অগ্রগতির প্রতিবেদন আদালতকে দেবেন। পাশাপাশি তদন্তেরপ্রয়োজনে যাদের সাথে কথা বলা দরকার সবাইকেই জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। এদিকেএ হত্যাকাণ্ডের সাথে সম্পৃক্ততার অভিযোগে আরো ৩ জনকে গ্রেফতার করেছেপুলিশ। এর মধ্যে একজন নারীও আছেন। তবে তাদের কি ধরনের সম্পৃক্ততা তা বলেননিপুলিশ সুপার ড. খন্দকার মহিদ উদ্দিন। এছাড়া আসামিদের সাথেসখ্যেরঅভিযোগে মামলার তদন্ত কর্মকর্তাসহ ৪ জন পুলিশ কর্মকর্তাকে বদলি করা হয়েছে।আর ঘটনার ১০ দিন পর নিহত চন্দন সরকারের জামাতা ডা. বিজয় কুমার বুধবার রাতেফতুল্লা থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। তবে মামলায় কাউকে আসামি করাহয়নি।

নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের প্যানেল মেয়র ও কাউন্সিলর নজরুল ইসলাম এবংআইনজীবী চন্দন সরকারসহ ৭ হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যের একের পর এক তথ্য বেরিয়েআসছে। পূর্ব বিরোধের জের ধরে কাউন্সিলর নজরুলকে নূর হোসেন ২০০০ সাল থেকে ৫দফা হত্যার জন্য হামলা চালালেও সফল হননি। এ বিরোধকে কাজে লাগানসিদ্ধিরগঞ্জের দু প্রভাবশালী নেতা। তারা নূর হোসেনকে দিয়ে নজরুলকে সরিয়েদেয়ার ফন্দি করেন। নজরুল মরে গেলে নূর হোসেনও ফেঁসে যাবেন, তারপর এলাকাররাজা বনে যাবেন তারা। এ স্বপ্ন বাস্তবায়নে নজরুলকে হত্যার প্রাথমিকপরিকল্পনা করে তারা এ নিয়ে নূর হোসেনের সাথে বৈঠক করেন। পরে এপ্রক্রিয়ার সাথে যুক্ত হয় নানা পক্ষ।নিহত ৭ জনের পরিবার, মামলার বাদী সেলিনা ইসলাম ও নজরুলের শ্বশুর শহীদ চেয়ারম্যান এসব তথ্যজানান। তারা বলেন, নজরুল নিহত হবার পর ও নূর হোসেন পালিয়ে যাওয়ায় ওই দুনেতাই এখন এলাকা নিয়ন্ত্রণ করছে।      নূর হোসেন সিদ্ধিরগঞ্জসহ আদমজীইপিজেড, সড়ক ও জনপথ বিভাগ, বিদ্যুত উন্নয়ন বোর্ডর ঠিকাদারী, চুন কারখানা, ইটভাটা, পরিবহনের চাঁদা আদায়, মাদকব্যবসা ও অস্ত্র বেচাকেনাসহ অপরাধসাম্রাজ্যে একক আধিপত্য বিস্তার করে আসছিলো। স্থানীয় দলীয় কিছু নেতাকে নূরহোসেনের বাসায় গিয়ে নিয়মিত চাঁদার ভাগের জন্য বসে থাকতে হতো। এদের মধ্যেওই দু প্রভাবশালী নেতা ট্রাক চালকের হেলপার থেকে কোটি কোটি টাকার মালিকবনে যাওয়ায় নূর হোসেনের ওপর ক্ষুব্ধ ছিলো। তাই তারা নজরুল-নূর হোসেনদ্বন্দ্ব কাজে লাগান। নূর হোসেনও মনে করতো নজরুল ব্যতীত সিদ্ধিরগঞ্জ এলাকায়তাকে কেউ কিছু করতে পারবে না।স্থানীয়রা বলেছে, আলোচনায়উঠে এসেছে সিদ্ধিরগঞ্জ ট্রাক স্ট্যান্ডে অবস্থিত মন্ত্রীপুত্র দীপু চৌধুরীর রিনালয়সিএনজি স্টেশন। এখানে বসেই পরিকল্পনা হতো নানা ঘটনা, দুর্ঘটনার।সিদ্ধিরগঞ্জ, শিমরাইলসহ আশপাশের সব অপকর্মের হোতা নূর হোসেন এ সিএনজিস্টেশনে বসাতেন নানা পার্টি। পানীয়ের আসর বসতো নিয়মিত। মন্ত্রীপুত্রের সাথে আরও যোগ দিতেন প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাও।

পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী ২৭ এপ্রিলকোর্টে হাজিরা দিতে গেলে ফেরার পথে নজরুলকে অপহরণ করা হয়। ওইদিন কোর্টথেকে হাজিরা শেষে বিকেলে ফতুল্লা স্টেডিয়ামের কাছে শিবু মার্কেটে গেলে আগেথেকে মাইক্রোবাস নিয়ে থাকা র্যাবের পোশাক পরিহিত সশস্ত্র ব্যক্তিরানজরুলকে অপহরণ করে। তার সাথে থাকা আরো ৪ জনকে গাড়িতে তুলে নেয়। ঘটনারপ্রত্যক্ষদর্শী আইনজীবী চন্দন সরকার ও তার গাড়ি চালককে তুলে নেয়অপহরণকারীরা।অপহরণের৪ দিন পর ৩০ এপ্রিল বিকেল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত শীতলক্ষ্যা নদী থেকেনজরুল ইসলাম ও চন্দন সরকারসহ ৬ জনের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। পর দিন ১ মেনজরুলের গাড়ি চালক জাহাঙ্গীরের লাশও উদ্ধার করা হয় শীতলক্ষ্যা থেকেই।