সরকারি ওষুধ চুরি মামলা : সিভিল সার্জন ডা. মিজানুর রহমান ও সাবিনা ইয়াসমিন জেলহাজতে

 

নারীসহ খুলনায় গ্রেফতারের খবর চুয়াডাঙ্গায় প্রধান আলোচ্য বিষয় : উঠে এসেছে স্বাস্থ্য বিভাগে তার বহু অনিয়মের চিত্র

স্টাফ রিপোর্টার:চুয়াডাঙ্গার সিভিল সার্জন নারী ও সরকারি ওষুধসহ খুলনায় গ্রেফতারের ঘটনাটি গতকাল শুক্রবার চুয়াডাঙ্গা জেলায় প্রধান আলোচ্য বিষয়ে পরিণত হয়েছে। সিভিল সার্জন ডা. খন্দকার মিজানুর রহমানের চুয়াডাঙ্গার বাসায় বাসায় মাঝে মাঝে কোন মহিলা আসা যাওয়া করতো তাও আলোচনায় উঠে এসেছে। একই সাথে সিভিল সার্জন চুয়াডাঙ্গা স্বাস্থ্য বিভাগে কোন কোন ক্ষেত্রে অনিয়ম করেছেন তা নিয়েও সরব আলোচনা শুরু হয়েছে সংশ্লিষ্টদের মধ্যে। উঠে এসেছে নানা অনিয়মের চিত্র।

সিভিল সার্জন ডা. খন্দকার মিজানুর রহমান ও সাবিনা ইয়াসমিনকে খুলনা জেলহাজতে প্রেরণ করা হয়েছে।গতকাল শুক্রবার বিকেলে খুলনা চিফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের বিচারক এদেরকে জেলহাজতে প্রেরণের আদেশ দেন। গোয়েন্দা পুলিশের দায়েরকৃত মামলায় আদালতে সোপর্দ করা হলে আদালত জেলহাজতে প্রেরণের অদেশ দেন।

সিভিল সার্জন খুলনায় নারীসহ আটকের পর গোয়েন্দা পুলিশ চুয়াডাঙ্গার সহযোগীদের প্রতি নজরদারি শুরু করেছে। অনেকের বাড়ি ও আড্ডাস্থলের আশপাশে গোয়েন্দা পুলিশকে দেখা গেছে। এদিকে কেয়ার টেকার হিসেবে কর্মরত একাধিক কর্মচারী জানান, প্রায় দিনই আত্মীয় পরিচয়ে নারীদের আনাগোনা ছিলো চুয়াডাঙ্গার সরকারি বাসায়। সরকারি হাসপাতালে একজন কর্মকর্তা দাবি করেন, সাবিনা ইয়াসমিন একাধিকবার চুয়াডাঙ্গায় সিভিল সার্জনের বাসা, অফিস ও হাসপাতালে এসেছেন। তাকে নিকটাত্মীয় বলে পরিচয় দেয়া হতো। সিভিল সার্জন খোন্দকার মিজানুর রহমানের দু মেয়ে ও এক ছেলে। এরমধ্যে এক মেয়ে বিবাহিত,জামাতা খুলনার সাব রেজিস্ট্রার, ছোট মেয়ে মেডিকেলে পড়েন এবং একমাত্র ছেলে নবম শ্রেণির ছাত্র। পরিবারের সদস্যরা খুলনা টুটপাড়ায় বসবাস করেন।

প্রায় দুবছর আগে খোন্দকার মিজানুর রহমান চুয়াডাঙ্গার সিভিল সার্জন হিসেবে যোগদান করেন। যোগদানের পর থেকেই জেলার স্বাস্থ্যবিভাগে অচলাবস্থা দেখা দেয়। যা গত গত ১০ বছরের রেকর্ড ভেঙে যায়। যোগদানের পর থেকেই প্রায় প্রতি বৃহস্পতিবারই তিনি খুলনার উদ্দেশে রওনা হতেন। যা তার চাকরিবিধির স্পষ্ট লঙ্ঘন। আর এ সময়ে তিনি ভারপ্রাপ্ত সিভিল সার্জন হিসেবে ডা. শাহাদাত হোসেন, ডা. রতন কুমার সিংহ রায়, পরিতোষ কুমার ঘোষ, ওয়ালিউর রহমান নয়নকে দায়িত্ব দিয়ে যান। আর এ সুযোগে সদর হাসপাতাল ও সিভিলসার্জন অফিসসহ সারাজেলায় স্বাস্থ্যবিভাগের চেইন অব কমান্ড ভেঙে যায়। গতকাল এসব বিষয়ে জোর আলোচনার পাশাপাশি অনিয়মের ফিরিস্তি উঠে আসে। সংশ্লিষ্টদের অনেকেই নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, যে যার যোগ্য নয়, তাদেরকে সেই পদে দায়িত্ব দিয়ে বাড়তি সুবিধা নেন। বিশেষ করে জুনিয়র স্বাস্থ্য শিক্ষা কর্মকর্তা রবজেল হক জুনিয়র স্বাস্থ্য শিক্ষা কর্মকর্তার তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী হলেও প্রথম শ্রেণির পদের সিনিয়র স্বাস্থ্য শিক্ষা কর্মকর্তা পরিচয় দিয়ে বেড়ান সিভিল সার্জনের সহায়তায়। রবজেল হকের স্ত্রী সিনিয়র স্টাফ নার্স গিনির জীবননগর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে পোস্টিং থাকলেও তাকে পেষণে চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালে নিয়ে রাখা হয়েছে। অফিস সহকারী রোকেয়া খাতুনকে সিভিল সার্জন কার্যালয়ের প্রধান সহকারী করে রাখা হয়েছে। সিভিল সার্জনের সবচেয়ে বড় সহযোগী ওই অফিসের স্টোরকিপার হাফিজ বিন ফয়সাল ও সদর হাসপাতালের স্টোরকিপার হাদিউজ্জামান। এ দুজন ভুয়া খরচ দেখিয়ে প্রতি বৃহস্পতিবার সিভিল সার্জনকে কার্টনভর্তি ওষুধ দেন। যা তিনি নিয়ে খুলনায় বিক্রি করেন। অনেক সময় ক্রেতারাও সরকারি চুয়াডাঙ্গায় এসে সরকারি ওষুধ কিনে নিয়ে যান। এসব ওষুধের একটি বড় অংশ চুয়াডাঙ্গা জেলার বিভিন্ন ক্লিনিক মালিকদের কাছেও বিক্রি করা হয় বলে ক্লিনিকগুলোতে কোনো অভিযান চালানো হয়না। গত বছর হাসপাতালের বিপরীতে একটি ক্লিনিকে সরকারি ওষুধ পাওয়া গেলেও তার বিরুদ্ধে তদন্ত করেই দায়িত্ব শেষ করা হয়। অথচ, কোনো শাস্তির ব্যবস্থা করা হয়নি।

সদর হাসপাতালের অ্যাম্বুলেন্স চালক আব্দুল মান্নানকে কোনো কারণ ছাড়ায় খুলনায় প্রেষণে পাঠানো হয়েছে। যা স্থানীয়দের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। বর্তমানে সদর হাসপাতালে দুটি অ্যাম্বুলেন্স থাকলেও চালক রয়েছে একজন। এমতাবস্থায় স্বাস্থ্যবিভাগের অনেকেই দাবি তুলেছে খুলনা থেকে ওই চালককে ফিরিয়ে না আনলে সিভিল সার্জনের চালককে দিয়ে হাসপাতালের অ্যাম্বুলেন্স চালানো হবে।

এদিকেবৃহস্পতিবার আটকের ঘটনায় ডিবি পুলিশের এসআই আব্দুল লতিফ বাদী হয়ে ডা. মিজানুর রহমান ও সাবিনা ইয়াসমিনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেছেন। সরকারি ওষুধ চুরির ঘটনায় দায়ের করা খুলনা থানার মামলা নং ৩১, ধারা ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইনের ২৫(১) ধারা। এ মামলার তদন্তকারী কর্মকতা হিসেবে দায়িত্ব পেয়েছেন গোয়েন্দা পুলিশের পরিদর্শক তৈমুর ইসলাম।

উল্লেখ্য,খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশের (কেএমপি) সহকারী পুলিশ কমিশনারসূত্রে জানা যায়, খুলনানগরীর ইকবালনগরের করিমাবাদ কলোনির বাংলাদেশ ব্যাংক কোয়ার্টারেরবিপরীতের একটি বাড়িতে গত পরশু বৃহস্পতিবার ওঠেন চুয়াডাঙ্গা সিভিল সার্জন ডা. খন্দকার মিজানুর রহমান। চুয়াডাঙ্গা থেকে ট্রেনযোগে গিয়ে ওই বাড়িতে ওঠেন তিনি। এক পর্যায়ে অনৈতিক কাজে লিপ্ত হলে পুলিশ ওই বাড়িতে হানা দেয় রাত ৮টার দিকে। অনেক ডাকাডাকির পর দরজা খুলে দেয়া হয়। কিন্তু সিভিল সার্জনকে তখনো পায়নি পুলিশ। বাথরুমে লুকিয়ে থাকেন সিভিল সার্জন। এক পর্যায়ে পুলিশ ওই বাথরুমের দরজা ভেঙে লুঙ্গি পরিহিত অবস্থায় আটক করে সিভিল সার্জন ডা. খন্দকার মিজানুর রহমানকে। এ সময় ডা. মিজানুর রহমান ও সাবিনা ইয়াসমিন নিজেদের নানা-নাতনি পরিচয় দেয়। তবে এ পরিচয় শেষমেশ তারা ভজাতে ব্যর্থ হন। ফলে তাদেরকে আটক করে রাতেইডিবি পুলিশ কার্যালয়ে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। সাবিনা ইয়াসমিনের বাসা থেকে ও সিভিল সার্জনের কাছ থেকে বেশ কিছু সরকারি ওষুধ উদ্ধার করে পুলিশ। আটক নারী সাবিনা ইয়াসমিন বৃহস্পতিবার রাতে নিজেকে আইনজীবী পরিচয় দেন। তবে খুলনা আইনজীবী সমিতির সভাপতিঅ্যাড. মাসুদ হোসেন রনি পুলিশকে জানিয়েছেন, ওই নারী তাদের সমিতির সদস্যবা আইনজীবী নন।সহকারী পুলিশ কমিশনার আরওজানান, আটক ওই নারী অবিবাহিত। ডা. মিজানুর রহমান ও ওই সাবিনা ইয়াসমিনের মোবাইলে পরস্পরেরমধ্যে আপত্তিকর ম্যাসেজ আদান-প্রদানের প্রমাণও পাওয়া গেছে।আটক সিভিল সার্জন ডা. খন্দকার মিজানুর রহমান পুলিশকে বলেন, সাবিনা ইয়াসমিন তাররোগী ছিলেন। আর চিকিৎসাসূত্রেই তাদের মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক হয়।অভিযানের সময় বিক্রি নিষিদ্ধ যেসব সরকারি ওষুধ উদ্ধার করে পুলিশ। এর কিছুওষুধ ডা. মিজান নিজের ব্যবহারের জন্য এনেছিলেন। কিছু ওষুধ ওই নারীর বাসাথেকে উদ্ধার করা হয়। সরকারি ওষুধ বাইরে বিক্রির অভিযোগে গতকাল শুক্রবার সিভিল সার্জন ডা. খন্দকার মিজানুর রহমানের বিরুদ্ধে একটিমামলা, আর অসামাজিক কার্যকলাপের অভিযোগে উভয়ের বিরুদ্ধে আরও একটি মামলাদায়ের করা হয়েছে বলে একটি অনলাইন সংবাদমাধ্যম জানিয়েছে।