শুস্ক মরসুমে হাজার হাজার নলকূপ হয়ে পড়ছে অকেজো

 

ফারাক্কার আগ্রাসনে হারিয়ে যাচ্ছে এতদাঞ্চলের নদী-খালবিলজীববৈচিত্র :ব্যাহত চাষাবাদ

 

রহমান মুকুল: নদী ও মানবীয় সভ্যতা এক ও অভিন্ন। প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে বড় নিবিড় হয়ে আছে এ দুয়ের কল্লোল ও কলোরব। সভ্যতা বিকাশের পরতে পরতে নদী যুগিয়েছে প্রেরণা। এভাবেই সংখ্যা গণণার অতীত প্রত্যুষে সিন্ধু নদীর তীরে মাথা তুলেছিলো হরপ্পার মহেঞ্জোদারো অর্থা আর্য সভ্যতা, নীল নদের তীরে মিশরীয় সভ্যতা, হোয়াংহো নদীর তীরে চৈনিক সভ্যতা, ফোরাতের কূলে সরব হয়ে উঠেছিলো আরবীয় সভ্যতা আর খেমারুজদের অহঙ্কার যে অ্যাঙ্কর সভ্যতা সেটা গড়ে উঠেছিলো মেকং নদীর তীরে। বর্ষায় নদীর ভয়ঙ্কর রূপ দুকূলবাসীকে কাদায়, আবার বর্ষা শেষে ফসলের প্লাবন বইয়ে দেয়। এমনিভাবে হাজার বছর ধরে নদ-নদী শিখিয়েছে স্বাধীনভাবে মাথা উঁচু করে বাঁচার মন্ত্র। যেখানে নদী বয়ে আনেনি তার অমিয় স্রোতধারা, সেখানে মানুষ দাঁড়ানি ক্ষণদণ্ড। সেকারণে একটি নদীর মৃত্যু কেবল নিছক একটি নদীর মৃত্যু নয়, এর সাথে মৃত্যু ঘটে একটি সভ্যতারও।

এ সভ্যতাবাসী স্বাধীন-সার্বভৌমত্ব লাভের পর পরই চানক্য কৌটিল্যের ধারক-বাহক ভারত আমাদের এ সুজলা সুফলা সভ্যতাকে ধ্বংশের চক্রান্তে মত্ত হয়ে ওঠে। মানবীয় সভ্যতার বিরুদ্ধে দানবীয় চক্রান্তে লিপ্ত হয়। মরণফাঁদ ফারাক্কার মাধ্যমে পানি ডাকাতি করে এ জনপদকে মরুভূমি করতে চায়। বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে সৃষ্টি করতে চায় কারবালার মাতম। ফারাক্কার মাধ্যমে এক তরফা পানি আগ্রাসনের ফলে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে ইতোমধ্যে মরুকরণ প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গেছে।১৭টি জেলার বহু নদনদী-খালবিল মরে গেছে। বিলুপ্ত হয়েছে বহু সংখ্যক। ফলে এ বৃহত্তম অঞ্চলের জলবায়ু চরম ভাবাপন্ন হয়ে উঠেছে। ধ্বংস হচ্ছে জীববৈচিত্র। চুয়াডাঙ্গা-কুষ্টিয়া-মেহেরপুর ও ঝিনাইদহ জেলার বিলুপ্ত এবং লুপ্ত নদনদী সবিশেষ অবস্থা সম্পর্কে আলোচনা করা হলো:

চুয়াডাঙ্গা জেলা:চুয়াডাঙ্গা জেলার বহু নদী এখন বিলুপ্তপ্রায়। এক সময়ের প্রমত্ত নদীগুলোর মধ্যে ইতোমধো ভাটুই নদীসহ বেশ কিছু নদীর অস্তিত্ব বিলীন হয়ে গেছে। ধুকে ধুকে চলছে মাথাভাঙ্গা, ভৈরব, কুমার,নবগঙ্গআ ও চিত্রা। এ সকল নদীগুলোকে কেন্দ্র করে জেলায় একসময় অনেক খাল-বিলের অস্তিত্ব থাকলেও বর্তমানে সেগুলোর বেশিরভাগ বিলীন হয়ে গেছে। অনেকগুলোর অস্তিত্বের সঙ্কট। স্রোত হারিয়ে নদ-নদীগুলো শীর্ণ খালে পরিণত হয়েছে। নদ-নদীগুলোর অধিকাংশ জায়গা প্রভাবশালীরা দখল নিয়ে গড়ে তুলেছে বিভিন্ন স্থাপনা। বর্ষা মরসুমে দু-একটি নদের অস্তিত্ব দেখা মিললেও শীত মরসুমে নদীগুলো চেনা মুশকিল হয়ে পড়েছে। ফলে দেখা দিচ্ছে মানবিক বিপর্যয়। ধুকে-পুকে এখনো যেগুলো বয়ে চলেছে চলছে তারাও কয়েক বছরের মধ্যে মানচিত্র থেকে হারিয়ে যাবে। ইতোমধ্যে শুকিয়ে যাওয়া নদ নদীগুলোর বেশির ভাগ অংশ দখল করে আছে প্রভাবশালীরা।

মাথাভাঙ্গা: জেলার প্রধানতম নদী মাথাভাঙ্গা। পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া জেলার উত্তরে জলাঙ্গী নদীর উৎসমুখের প্রায় ১৬ কিলোমিটার পূর্বে পদ্মা থেকে উৎসরিত হয়ে দর্শনার পাশ দিয়ে চুয়াডাঙ্গা হয়ে আলমডাঙ্গা স্টেশনের আট কিলোমিটার পশ্চিমে হাটবোয়ালিয়া এলাকায় এসে কুমার ও মাথাভাঙ্গা নামে দুভাগে বিভক্ত হয়েছে। রেললাইন চালু হওয়ার পূর্বে (১৮৬২) মাথাভাঙ্গা নদীপথেই কোলকাতার সাথে কুষ্টিয়া অঞ্চরের যোগাযোগ হতো। কুষ্টিয়া, যশোর, ফরিদপুর, পাবনা প্রভৃতি অঞ্চলের যাবতীয় নীলকর এ নদীপথেই তাদের নীল কোলকাতায় পাঠাতো। ব্রিটিশ আমলেই মাথাভাঙ্গা নদী নাব্যতা হারাতে থাকে। ফলে নীলকর পড়ে সঙ্কটে। সরকারের কাছে দেনদরবার করে তারা ১৮২০ সালে মাথাভাঙ্গা সংস্কারেরও উদ্যোগ নেয়।

উইলিয়াম হান্টারের এক প্রতিবেদনে জানা যায়, রবিনসন এবং মে নামক দুজন নদী সংস্কারকের ছয় বছরের প্রচেষ্টাতেও বিশেষ কোনো ফল হয়নি। দিনে দিনে পলি জমার কারণে মাথাভাঙ্গার বুক অনেকাংশে ভরাট হয়ে এলেও এ নদীর মূল প্রবাহ এখনো সামান্য গতিশীল রয়েছে।

ভৈরব: জেলার প্রাচীন আরেকটি নদী ভৈরব। ফানডেন ব্রোকের নকশা থেকে জানাযায়,জলাঙ্গী ও চন্দরা নামে যে দু সহোদরা প্রমত্তা পদ্মা থেকে বেরিয়ে ভাগিরথিতে মিশেছে, তারই একটি শাখা নদী জলাঙ্গী (পশ্চিমবঙ্গে প্রবাহিত) থেকে বেরিয়ে ভৈরব মেহেরপুরের শোলমারিতে সীমান্ত পেরিয়ে চুয়াডাঙ্গায় পৌঁছেছে। ভৈরব নদীতে পলি জমতে শুরু করে বহু আগে থেকে। এ নদীটি এখন মৃতপ্রায়।

কুমার নদ: পদ্মার প্রধান শাখা মাথাভাঙ্গা থেকে চুয়াডাঙ্গা জেলার আলমডাঙ্গা উপজেলা ও হাটবোয়ালিয়া থেকে কুমারের উৎপত্তি। কুমার চুয়াডাঙ্গা-ঝিনাইদহ জেলার ওপর দিয়ে ভাটিতে মধুমতী নদীতে মিশেছে। অনেক বছর আগেই মাথাভাঙ্গা থেকে কুমারের পানি প্রাপ্তি বন্ধ হয়ে গেছে। এরপর ডাকুয়া ও কালী নদী দিয়ে গড়াই থেকে কুমার পানির প্রবাহ পেতো। কিন্তু ৬০এর দশকে জিকে সেচ প্রকল্প বাস্তবায়নের ফলে বর্তমানে একটি মৃত নদীতে পরিণত হয়েছে কুমার। বর্তমানে এটি গভীরতাহীন ইরিগেশনের খাল। মাদারীপুর সদর ও রাজৈর উপজেলার মধ্যদিয়ে প্রবাহিত এককালের খরস্রোতা কুমার নদের ১৮ কিলোমিটার অংশ শুকিয়ে গেছে। অন্যদিকে ভরাট হয়ে যাওয়া নদীর অংশ প্রভাবশালীরা বিভিন্ন কূটকৌশলে দখল করে নিচ্ছে। নদের প্রবেশমুখ টেকেরহাট বন্দরসহ দীর্ঘ নদের দু পাশ দিয়ে অবৈধভাবে স’মিল, দোকানপাট, বাড়িঘর নির্মাণ করায় নদটি সংকুচিত হয়ে সরু নালায় পরিণত হয়েছে। কোথাও কোথাও সম্পূর্ণ ভরাট হয়ে জমিতে রূপান্তরিত হয়েছে। এক সময় এ বিশাল খরস্রোতা কুমার নদ দিয়ে বড় বড় তিনটি চাকাওয়ালা জাহাজ একসাথে পাশাপাশি চলাচল করতে পারতো। বরিশাল থেকে মাদারীপুর-চরমুগুরিয়া-সিন্দিয়াঘাট (টেকেরহাট)-খুলনা হয়ে ভুটিয়া, ছ্যান্দ্রা ও শিউলী নামের তিনটি জাহাজ ছাড়াও অন্যান্য জাহাজ সরাসরি কলকাতা পর্যন্ত যাতায়াত করতো। বরিশাল থেকে কলকাতা পর্যন্ত এক টিকেটে সরাসরি ভাড়া ছিলো মাত্র ১২ আনা। আজ সেই উত্তাল কুমার নদ শুধুমাত্র বলিরেখার মতো শেষ চিহ্ন বহন করছে। আলমডাঙ্গা হয়ে বয়ে যাওয়া কুমারের ছিলো বিশাল ব্যপ্তি। হাটবোয়ালিয়া ও আলমডাঙ্গা থেকে এ নদী পথে বড় বড় জাহাজভর্তি করে কোলকাতা এমনকি ইংল্যান্ডে পাট পাঠানো হতো। আলমডাঙ্গার স্বর্গীয় গঙ্গাধর জালান আলমডাঙ্গা থেকে কুমার নদীপথে ইংল্যান্ডের ড্যান্ডির সাথে ব্যবসা করতেন। এমনকি অযোধ্যার সম্রাট ২য় আলমগীরের শাসনামলেও এ নদীপথের গৌরবময় বাণিজ্যের পরিচয় পাওয়া যায়। ৬০’র দশকে কুমার নদ শাসন করে জিকে প্রজেক্টের ক্যানেল নির্মাণ করার সময় নদীর তলদেশ থেকে সম্রাট ২য় আলমগীরের শাসনামলের বহু মুদ্রা উদ্ধার হয়েছিলো বলে জানা যায়।

চিত্রা: ঐতিহাসিকভাবে পরিচিত চিত্রা নদীটির উৎপত্তি ও বিস্তারে রয়েছে বৈচিত্র্যময়তা। কোনো কোনো গবেষণা সংস্থা ও গবেষকদের মতে চিত্রা নদী পূর্বে ইছামতী নদীর একটি শাখা নদী ছিলো। আবার কারও কারও তথ্যমতে পাওয়া যায় চিত্রা মাথাভাঙ্গা নদীর একটি শাখা যা পূর্বে মহেশ্বর নদী নামে পরিচিত ছিলো এবং নদীটি দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে নড়াইল জেলার মাইজপাড়া-মাগুরার মধ্যদিয়ে নড়াইল জেলায় প্রবেশ করেছে। ১৭০ কিমি দীর্ঘ এ নদীটি চুয়াডাঙ্গা ও দর্শনার নিম্নস্থল থেকে উৎপন্ন হয়ে দক্ষিণ-পূর্ব দিকে কালীগঞ্জ, শালিখা ও কালিয়া উপজেলার মধ্যদিয়ে অতিবাহিত হয়ে গাজীরহাটে নবগঙ্গা নদীর সাথে মিলেছে এবং এ মিলিত স্রোত খুলনার দৌলতপুরের কাছে ভোইরব নদীতে গিয়ে পড়েছে।এক সময়ের উত্তাল প্রমত্ত চিত্রা নদী আজ হারিয়ে যেতে বসেছে। নবগঙ্গা: জেলার অপর নদী হচ্ছে নবগঙ্গা। এ নদীরও উৎপত্তি স্থল মাথাভাঙ্গা। চুয়াডাঙ্গা-ঝিনাইদহ-মাগুরা জেলার ওপর দিয়ে নবগঙ্গা মধুমতীতে মিশেছে। সংস্কারের অভাবে উৎসমুখ ক্রমশ ভরাট হয়ে নবগঙ্গার পানি প্রবাহ বন্ধ হয়ে গেছে। নদীটি এখন সরু মরা খালে পরিণত হয়েছে। নদীবক্ষ জুড়ে চলছে চাষাবাদ।

মেহেরপুর জেলা: এক সময় শুধুমাত্র নদীপথেই ছিলো সমগ্র ভূ-ভারতের সাথে মেহেরপুরের যোগাযোগ। কথিত আছে ১৫৮৯ সালে মোগল সেনাপতি মানসিংহ যশোরের প্রতাপাদিত্যকে দমন করার জন্য নদীপথেই মেহেরপুরের বাগোয়ানে এসে ভবানন্দ মজুমদারের সহযোগিতা গ্রহণ করেন এবং ভেরব হয়েই যশোর যান। ভারতচন্দ্রের অন্নদামঙ্গলে এ তথ্যের সমর্থন মেলে। জনশ্রুতির বরাত দিয়ে ড. আশরাফ সিদ্দিকী লিখেছেন, ১৭৫০ সালে নবাব আলীবর্ন্দী খাঁ নদীপথে মৃগয়ায় আসেন বাগোয়ান পরগনায়। দুর্যোগ কবলিত হয়ে সপরিষদ আতিথ্য গ্রহণ করেন রাজু গোয়ালিনী নামের এক নামগোত্রহীন বিধবার। আতিথেয়তায় মুগ্ধ হয়ে নবাব সেই বিধবাকে দান করেন বাগোয়ান মৌজা, আর বিধবার পুত্র গোয়ালা চৌধুরীকে (মতান্তরে গোপাল) রাজা উপাধিতে ভূষিত করেন। এ নদীটিও দিনে দিনে কালের স্রোতে হারিয়েছে। কেবল বর্ষাকালের অতিবর্ষণে আর বন্যায় এ শুষ্কপ্রায় নদ নদী, খালবিল জাগ্রত সত্তায় উদ্ভাসিত হয়।

ভৈরব: মেহেরপুর জেলার সর্বাপেক্ষা প্রাচীন নদী ভৈরব। ফানডেন ব্রোক ১৬৬০ সালে তার নকশায় দেখিয়েছেন-জলাঙ্গী ও চন্দরা নামে যে দু সহোদরা প্রমত্তা পদ্মা থেকে বেরিয়ে ভাগিরথিতে মিশেছে, তারই একটি শাখা নদী জলাঙ্গী (পশ্চিমবঙ্গে প্রবাহিত) একদা ভৈরব নামে চুয়াডাঙ্গার নিচ দিয়ে প্রবেশ করে যশোর খুলনার ভেতর দিয়ে গড়াই প্রবাহের সাথে মিশে বঙ্গোপসাগরে ড. নীহাররঞ্জন রায় ‘বাংলার নদী-নদী’গ্রন্থে ভৈরব সম্পর্কে মন্তব্য করেন, মধ্যযুগের এ নদীগুলোর (চন্দনা, কুমার ও ভৈরব) মধ্যে ভৈরবও ছিলো অন্যতম।কিন্তু সেই ভৈরব ভৈরবের যৌবনদিনে নদীপথের সুবিধা পেয়েই এ অঞ্চলের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মাঝে খ্রিস্টধর্ম প্রচারের উদ্দেশে একদা খ্রিস্ট্রান মিশনারি পাদ্রিরা এসেছেন। আবার ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানির বাণিজ্য কুঠি এবং নিষ্ঠুর নীলকরদের বহু নীলকুঠি ও গড়ে ওঠে ভৈরবতীরের গ্রামগুলোতেই। ভৈরব নদীতে পলি জমতে শুরু করে বহু আগে থেকেই। নদীটি এখন বিশুস্কপ্রায়।

মাথাভাঙ্গা: মেহেরপুরের উল্লেখযোগ্য নদীর আরেকটি হচ্ছে মাথাভাঙ্গা। মাথাভাঙ্গাই পদ্মা নদীর দ্বিতীয় বৃহত্তম শাখা। বিচিত্র এ নদীর গতিপথ, দু-চারটি গ্রাম পেরোলেই এর নাম পাল্টে যায়, স্বভাবও যায় খানিকটা পালটে। ছেউটি: মেহেরপুর জেলার গাংনী থানার মধ্যদিয়ে প্রবাহিত অপর একটি ছোট নদী ছেউটি। স্থানীয় মানুষ তাকে মরা গাঙও বলে। ছেউটি মূলত মাথাভাঙ্গারই একটি ক্ষীণকের শাখা। কিন্তু এ নদীর দু মাথাই এখন মৃত। কাজলা: গাংনী থানার আরো একটি মৃতনদী কাজলা। কাজীপুর ইউনিয়নে মাথাভাঙ্গা তেকে বেরিয়ে নপাড়া, ভাটপাড়া, সাহারবাটি, গাড়াডোব হয়ে আমঝুপিতে বাঁকবদল করে কাজলা এক সময় গিয়ে পড়েছিলো ভৈরবে। মেহেরপুর জেলার প্রধান-অপ্রধান সব নদী আজ মৃতপ্রায়। আগামী প্রজন্ম হয়তো জানবেও না-এসব নদীও একদা কতো বেশি ছিলো প্রাণদায়িনী।

ঝিনাইদহ জেলা: অভিশপ্ত ফারাক্কা বাঁধের মাধ্যমে ভারতের একতরফা পানি প্রত্যাহারের বিরূপ প্রভাব পড়েছে ঝিনাইদহে। এ জেলার ওপর দিয়ে প্রবাহিত ১১টি খরস্রোতা নদী আজ মৃত। নদীগুলোর বুক জুড়ে ধু ধু বালুচর, শুকনো চরে শ্যালো বসিয়ে চলছে চাষাবাদ। তবুও পানি মিলছে না। নদীতে পানি না থাকায় পানি উন্নয়ন বোর্ডের জিকে সেচ প্রকল্পের আওতায় নামমাত্র সেচ সুবিধা কৃষকের কাজে আসছে না। শুস্ক মরসুমে জেলার হাজার হাজার নলকূপ হয়ে পড়েছে অকেজো। গোটা এলাকায় শুরু হয়েছে মরুকরণ। নদী শুকিয়ে যাওয়ার সাথে সাথে ভূমিদস্যুদের নদী দখল প্রতিযোগিতাও চলছে সমান তালে। উচু এলাকা হওয়ায় এ এলাকার মরুকরণ শুরু হয়েছে সবার আগে। ঝিনাইদহ সদর উপাজেলার ওপর দিয়ে প্রবাহিত নবগঙ্গা, বেগবতি, ফটকি, মহেশপুরের ভৈরব, ইছামতী, কুদলা, কালীগঞ্জ-কোটচাঁদপুর উপজেলার চিত্রা, শৈলকূপা উপজেলার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে গড়াই, কুমার, কালী ও ডাকুয়া নদী। নদীগুলো একসময় ছিলো খরস্রোতা, হতো জোয়ার-ভাটা। অথচ ভারতের একতরফা পানি প্রত্যাহারের ফলে সবগুলো নদীই আজ মৃত। কোনো কোনো নদী অস্তিত্বই হারিয়েছে।

গড়াই:বর্তমানে ঝিনাইদহের শৈলকূপা উপজেলার ওপর দিয়ে প্রবাহিত একমাত্র জীবিত নদী গড়াই। ফারাক্কার প্রভাবে দীর্ঘ দিনে পলি জমে উৎসমুখ ভরাটের পথে। ফলে শুস্ক মরসুমে গড়াই শুকিয়ে মরা খালে পরিণত হয়। এটি পদ্মা থেকে উৎপত্তি হয়ে ভাটিতে মধুমতি নাম নিয়ে শিবসা হয়ে সাগরে মিশেছে। গড়াইয়ের ৯০ কিলোমিটার বুক জুড়ে শুস্ক মরসুমে সৃষ্টি হয় ধু-ধু বালুচরের।

মাথাভাঙ্গা: ঝিনাইদহের ওপর দিয়ে প্রবাহিত বেশির ভাগ নদ-নদীগুলোর পানির উৎস ছিলো পদ্মার প্রধান শাখা মাথাভাঙ্গা। কিন্তু এ সীমান্ত নদীটি আজ মরুপথে। নদীর উৎস মুখে জেগেছে বিশাল চর। কুমার: কুমার চুয়াডাঙ্গা-ঝিনাইদহ জেলার ওপর দিয়ে ভাটিতে মধুমতী নদীতে মিশেছে। অনেক বছর আগেই মাথাভাঙ্গা থেকে কুমারের পানিপ্রাপ্তি বন্ধ হয়ে গেছে। এরপর ডাকুয়া ও কালী নদী দিয়ে গড়াই থেকে কুমার পানির প্রবাহ পেতো। কিন্তু ৬০’র দশকে জিকে সেচ প্রকল্প বাস্তবায়নকালে কালী ও ডাকুয়া নদীর উৎস মুখে ক্রসড্যাম (আড়িবাধ) দেয়া হয়। ফলে কুমার এখন কোনো উৎস থেকেই পানি পায় না। বর্তমানে একটি মৃত নদীতে পরিণত হয়েছে কুমার। সারা বছর ধরে নদীবক্ষে চাষাবাদ হয়। বিভিন্ন স্থানে নদীবক্ষ দখল করে বাজার ও বাড়ি-ঘর নির্মাণ করা হচ্ছে।

নবগঙ্গা: ঝিনাইদহের অপর দীর্ঘ নদী হচ্ছে নবগঙ্গা। এ নদীরও উৎপত্তিস্থল মাথাভাঙ্গা। সংস্কারের অভাবে উৎসমুখ ভরাট হয়ে নবগঙ্গার পানি প্রবাহ বন্ধ হয়ে গেছে। নদীটি এখন সরু মরা খালে পরিণত হয়েছে। নদীবক্ষ জুড়ে চাষাবাদ চলছে। বেগবতি: জেলার আরেক নদী বেগবতীর বেগ অনেক আগেই থেমে গেছে। ৪শ বছর আগে মুগল সেনাপতি মানসিংহ বঙ্গদেশ থেকে এ নদী পথে রাজমহল যাওয়ার বিবরণ ইতিহাসে পাওয়া যায়। বেগবতী আজ একটি মৃত নদীর তালিকায়। ইছামতী: ঝিনাইদহের অপর নদী ইছামতী। নদীটির উৎপত্তি স্থান ভারতে। জেলার মহেশপুর উপজেলার সীমান্ত দিয়ে প্রবাহিত নদীটি। জীবিত থাকলেও শুকনো মরসুমে পানি থাকে না। কোদালা: মহেশপুরের অপর সীমান্ত নদী কোদলারও একই অবস্থা। নদীর অনেক স্থান ভুয়া কাগজ-পত্রের মাধ্যমে বে-দখল করে পুকুর খনন ও বাড়ি-ঘর নির্মাণ পর্যন্ত হয়েছে। ভৈরব: এ জেলার ওপর দিয়ে প্রবাহিত ভৈরবও একটি মৃত নদীতে পরিণত হয়েছে। অনেকদিন আগে ভৈরবের ভৈরবী গর্জন থেমে গেছে। ইতিহাস থেকে জানা যায়, এককালে ভৈরব নদীতে লঞ্চ-ষ্টিমার চলতো। কোলকাতার সাথে ভৈরব নদী পথে দক্ষিণ বঙ্গের যোগাযোগ ছিলো। চিত্রা: চিত্রাও জেলার অন্যতম নদী। এ নদীটিরও উৎপত্তিস্থল মাথাভাঙ্গা। চুয়াডাঙ্গা জেলার চিত্রার ওপর ক্রসড্যাম নির্মাণের পর আর কোনো পানি প্রবাহ পায় না। চুয়াডাঙ্গা ও ঝিনাইদহ জেলার অংশে চিত্রা আজ মৃত। তবে ভাটিতে নড়াইল জেলার অংশে জীবিত আছে ছোট নদী ফটকি নবগঙ্গা থেকে উৎপত্তি হয়ে চিত্রায় মিশেছে। এ নদীটিও আজ মৃতের তালিকাভুক্ত।

কুষ্টিয়া জেলা: কুষ্টিয়াসহ দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানচিত্র থেকে প্রায় ডজন খানেক নদ-নদী নিশ্চিহ্নের পথে। দাতা সংস্থা গুলোর পরামর্শ ও অর্থায়নে অপরিকল্পিত জলকাঠামো নির্মাণের ফলে সবচেয়ে ভয়াবহ প্রভাব পড়েছে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের নদ-নদীর ওপর। এ অঞ্চলের ১২টি নদ-নদীর মধ্যে ২টি কোনো রকমে টিকে আছে। বাকি নদ-নদীগুলো শীর্ণ খালে পরিণত হয়েছে। তলদেশ ভরাট হয়ে যাওয়া নদ-নদীগুলোর অধিকাংশ জায়গা প্রভাবশালীরা দখল নিয়ে গড়ে তুলেছে বিভিন্ন স্থাপনা। বর্ষা মরসুমে দু-একটি নদের অস্তিত্ব দেখা মিললেও শীত মরসুমে নদীগুলো চেনা দায়।

গড়াই: গড়াই কুষ্টিয়ার প্রধান নদী।পানি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্যমতে গড়াইয়ের পানি প্রবাহ কমে যাওয়াতে সুন্দরবন উপকূলে বিপুল পরিমাণ পলিতে উপকূল ভাগ উঁচু হয়ে গেছে। আগে গড়াইয়ের তীব্র স্রোত পলি অপসারণ করতো। পলি পড়ার কারণে গড়াইপানি ধারণ ক্ষমতা হারিয়ে ফেলছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্য মতে গঙ্গাবাঁধ নির্মাণের পর গড়াই খরস্রোতা হলে এ সমস্যা মিটবে। এছাড়া হিসনা নদী ও কালিগঙ্গাও প্রায় মৃত। জানমাল রক্ষাসহ দেশের দক্ষিণাঞ্চল মরুকরণের হাত থেকে রক্ষা করতে হরানো নদ-নদী পুনরুদ্ধার করতে হবে। তা না হলে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানচিত্র থেকে বেশিরভাগ নদ-নদীসহ অন্যান্য জলাশয় নিচিহ্ন হয়ে যাবে।