বিদ্যুতে বিনিয়োগ হবে ৬০ হাজার কোটি টাকা, পাওয়া যাবে চার হাজার ৯৬০ মেগাওয়াট

স্টাফ রিপোর্টার: বড় বিনিয়োগকারীরা ঝুঁকছে বাংলাদেশের দিকে। দ্রুত বিকাশমান অর্থনীতির জন্য সরকার বিদ্যুত খাতকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিচ্ছে। দেশের চার বড় বিদ্যুত প্রকল্পের জন্য প্রায় ৬০ হাজার কোটি টাকা বা আট বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ হবে। পদ্মা সেতুর মোট ব্যয়ের প্রায় তিনগুণ বিনিয়োগ করা হবে এ চার প্রকল্পে।

বিদ্যুত বিভাগ সূত্র জানায়, প্রায় কাছাকাছি সময়ে এই বিদ্যুত কেন্দ্রগুলো বাস্তবায়ন হবে। এর মধ্যে রামপাল প্রকল্প বাস্তবায়ন পর্যায়ে রয়েছে। আর পটুয়াখালীতে নর্থওয়েস্ট পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি এবং চায়না ন্যাশনাল মেশিনারি ইমপোর্ট এ্যান্ড এক্সপোর্ট কর্পোরেশনের (সিএমসি) মধ্যে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর হয়েছে। আগামী ২৯ এপ্রিল আরও একটি বড় বিদ্যুত কেন্দ্রের জন্য বাংলাদেশ বিদ্যুত উন্নয়ন বোর্ড এবং চীনের রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান চায়না হুদিয়ান হংকংয়ের মধ্যে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর হওয়ার কথা রয়েছে। এই তিনটি বিদ্যুত কেন্দ্রই একই ক্ষমতার এক হাজার ৩২০ মেগাওয়াট করে বিদ্যুত উৎপাদন করবে। এছাড়া সরকারী কোল পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি আরও একটি বড় বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণ করবে। হাজার মেগাওয়াট ক্ষমতার কেন্দ্রটির সম্ভাব্যতা জরিপের কাজ চলছে। জাইকা বিদ্যুত কেন্দ্রটিতে বিনিয়োগে প্রাথমিক সম্মতি দিয়েছে। তারাই কেন্দ্রটির প্রাথমিক সম্ভাব্যতা জরিপ পরিচালনা করছে। সব মিলিয়ে প্রকল্পগুলো থেকে চার হাজার ৯৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুত পাওয়া যাবে।
প্রধানমন্ত্রীর বিদ্যুত এবং জ্বালানি উপদেষ্টা ড. তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী সম্প্রতি বলেন, অতীতে সময় আধা বিলিয়ন ডলারের কোন প্রকল্পের কথাই শোনা যায়নি। এখন বাংলাদেশের একটি কোম্পানিই বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের প্রকল্পের কথা বলছে। সরকার প্রমাণ করেছে বাংলাদেশ শুধু সম্ভাবনার দেশ নয়, বাংলাদেশ বাস্তবতারও দেশ।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিদ্যুত খাতে গত সরকারের অর্জনে এখন বিভিন্ন দেশ আস্থা অর্জন করেছে। ভারত, চীন এবং জাপান বাংলাদেশের কয়লাভিত্তিক বিদ্যুত কেন্দ্রে ব্যাপক বিনিয়োগের আগ্রহ প্রকাশ করেছে। ভারতের সঙ্গে এর মধ্যে চুক্তি এবং চীনের সঙ্গে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর হয়েছে। এসব বিনিয়োগের সব থেকে ভাল দিক হচ্ছে বাংলাদেশ প্রকল্পগুলোর অর্ধেক মালিকানা পাবে। যৌথ উদ্যোগে প্রকল্প বাস্তবায়নে দেশীয় প্রতিষ্ঠানের দক্ষতার উন্নয়ন হবে। কর্মী ব্যবস্থাপনায় দক্ষতার উন্নয়ন হলে বাংলাদেশ নিজেই বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে পারবে।

বিদ্যুত বিভাগ সূত্র জানায়, বর্তমান সরকারের মেয়াদের মধ্যে বিদ্যুত কেন্দ্রগুলোর প্রত্যেকটির একটি করে ইউনিট উৎপাদনে আনার চেষ্টা করা হচ্ছে। রামপাল এবং পটুয়াখালীর কাজ বেশ কিছু দূর এগিয়েছে। আগামী ২৯ তারিখ সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরের পর অপর একটি বিদ্যুত প্রকল্পের বাস্তবায়ন প্রক্রিয়াও দ্রুত শুরু করা যাবে।

বিদ্যুত বিভাগের এক কর্মকর্তা জানান, বড় বিদ্যুত প্রকল্পের কাজ শুরু করতে বিপুল পরিমাণ জমির প্রয়োজন হয়। বিগত সরকারের সময় বিদ্যুত কেন্দ্রগুলোর জন্য স্থান নির্ধারণ করে জমি অধিগ্রহণ শুরু করা হয়। প্রায় বিদ্যুত কেন্দ্রই বাস্তবায়নে জমি অধিগ্রহণ শেষ পর্যায়ে রয়েছে। বেশিরভাগ সরকারী খাস জমি হওয়ায় এখান থেকে খুব কম মানুষকে অন্যত্র পুনর্বাসনের প্রয়োজন পড়বে।

ভারতের বিদ্যুত সচিব প্রদীপ কুমার সিনহা সম্প্রতি ঢাকায় এক সংবাদ সম্মেলনে জানান, রামপাল বিদ্যুত কেন্দ্রের প্রথম ইউনিট উৎপাদনে আসবে ২০১৮-এর ডিসেম্বরের মধ্যে। চলতি মাসের প্রথম দিকে ভারত-বাংলাদেশ যৌথ বৈঠকে রামপাল প্রকল্পের সর্বশেষ অগ্রগতি নিয়ে আলোচনা হয়। রামপাল বিদ্যুত কেন্দ্রটি বাস্তবায়ন করছে ভারত বাংলাদেশ ফ্রেন্ডশিপ কোম্পানি। বিদ্যুত কেন্দ্রটি বাস্তবায়নের জন্য রাজধানীর বিদ্যুত ভবনে অফিস স্থাপন করেছে কোম্পানিটি।

অন্যদিকে নর্থওয়েস্ট পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি এবং চায়না ন্যাশনাল মেশিনারি ইমপোর্ট এ্যান্ড এক্সপোর্ট কর্পোরেশনের (সিএমসি) বিদ্যুত প্রকল্পটি হবে পটুয়াখালীর কলাপাড়ায়। বিদ্যুত কেন্দ্রটির প্রথম ইউনিট উৎপাদনে আসবে বর্তমান সরকারের মেয়াদের মধ্যে।

চীনের সাথে যৌথ উদ্যোগে কয়লাভিত্তিক আরও একটি বড় বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণ করতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। কেন্দ্রটি চট্টগ্রামের আনোয়ারায় নির্মাণ করা হবে। এক হাজার ৩২০ মেগাওয়াট ক্ষমতার কেন্দ্রটি চলবে আমদানি করা কয়লায়। কেন্দ্র নির্মাণে চীনের রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান চায়না হুদিয়ান হংকংয়ের সঙ্গে ২৯ এপ্রিল সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করবে বাংলাদেশ। মূলধনী কোম্পানিতে হুদিয়ান হংকংয়ের মালিকানা থাকবে ৫১ ভাগ। আর পিডিবির মালিকানা বাকি ৪৯ ভাগ। নয় বোর্ড সদস্যের পাঁচজনই হবে চীনা কোম্পানির। তবে বোর্ডের যে কোন সিদ্ধান্ত অনুমোদনের জন্য দুই-তৃতীয়াংশ সদস্যের মতামত প্রয়োজন হবে। এক্ষেত্রে চীনা প্রতিষ্ঠানটি চাইলেই এককভাবে কোন সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিতে পারবে না।
পিডিবি জানায়, চটগ্রামের বিদ্যুত কেন্দ্রটির জন্যও দুই বিলিয়ন ডলারে বিনিয়োগ প্রয়োজন হবে। এর মধ্যে ৩০ ভাগ অর্থ হুদিয়ান ও পিডিবি যৌথভাবে বিনিয়োগ করবে। বাকি ৭০ ভাগ অর্থ সহজ শর্তে ঋণ সহায়তা হিসেবে চীন সরবরাহ করবে। কেন্দ্রটি নির্মাণে (ইপিসি) দরপত্র আহ্বান করবে। সর্বনিম্ন দরদাতাকে কাজ দেয়া হবে। চায়না হুদিয়ান হংকং চীনের একটি রাষ্ট্রীয় কোম্পানি। এই কোম্পানিটির অধীনে ৯০ হাজার মেগাওয়াট ক্ষমতার বিদ্যুত কেন্দ্র রয়েছে। যার মধ্যে ৭০ ভাগই কয়লাচালিত বিদ্যুত কেন্দ্র।

এছাড়া জাইকার সঙ্গে কোল পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি প্রকল্প বাস্তবায়ন করবে। জাইকার সঙ্গে সরকারের আলোচনা কিছু দূর এগিয়েছে। জাইকা প্রাথমিকভাবে বিদ্যুত কেন্দ্রটিতে বিনিয়োগের আগ্রহ প্রকাশ করেছে।

বিদ্যুত বিভাগ সূত্র জানায়, অতীতে প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে শুধু দাতাসংস্থার দিকে অর্থায়নের জন্য তাকিয়ে থাকা হতো। এতে বিদ্যুত কেন্দ্র বাস্তবায়নে দীর্ঘসূত্রতার সৃষ্টি হতো। এখন এই সমস্যা থেকে অনেকটা সরে এসেছে বিদ্যুত খাত। বেশিরভাগ প্রকল্পই বিদেশী বাণিজ্যিক ব্যাংকের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। এতে সুদের হার কিছুটা বেশি হলেও বেসরকারী খাত থেকে বিদ্যুত ক্রয়ের চেয়ে অনেকটা লাভজনক।

ভারতের ন্যাশনাল থার্মাল পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেড (এনটিপিসি) এবং চায়না ন্যাশনাল মেশিনারি ইমপোর্ট এ্যান্ড এক্সপোর্ট কর্পোরেশন (সিএমসি) কয়লা বিদ্যুত উৎপাদনে পথিকৃৎ। ভারতের কয়লা বিদ্যুত কেন্দ্রের বেশিরভাগ উৎপাদন করে এনটিপিসি