স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও দায়িত্বশীলতা গণতন্ত্রের পূর্বশর্ত

অর্থবহ গণতন্ত্র, কার্যকর প্রশাসন ও দারিদ্র্য এক সাথে চলতে পারে কি-না তা একটি কঠিন প্রশ্ন। স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও দায়িত্বশীলতা গণতন্ত্রের পূর্বশর্ত। একে কার্যকর করতে হলে প্রশাসনকে সবসময় নিয়ম-নীতির মধ্যে চলতে হয়। কিন্তু প্রশাসনের নিয়ম-কানুনের মধ্যে থেকে কাজ করার ক্ষেত্রে দেশে দারিদ্র্য একটি প্রকাণ্ড বাধা বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। যেকোনো গণতান্ত্রিক দেশে নির্দিষ্ট মেয়াদান্তে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে সরকার গঠিত হয়। নির্বাচনের আগে রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচনী ইশতেহার ঘোষণা করে। এর মাধ্যমে উন্নয়নের নানা প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়। এক্ষেত্রে অধিকাংশ সময় অর্থনৈতিক সামর্থ্য বিবেচনা করা হয় না। ভোটের রাজনীতিতে সফল হওয়ার জন্য অবাস্তব ও কল্পনাতীত প্রতিশ্রুতির ফুলঝুরিও চলে। যেনবা সাতনরীর হার হতে শুরু করে দুধের নহর কিংবা আকাশের চাঁদও পাওয়া যাবে। এসব স্লোগান জনপ্রিয়ও হয়ে থাকে। নির্বাচনের পর অধিকাংশ ক্ষেত্রে এ ইশতেহারের কথা নেতারা যেমন ভুলে যান, তেমনি জনগণেরও তা নিয়ে ভাবার তেমন ফুরসত থাকে না। অন্য ও বড় বড় ইস্যু এসে তা ঢেকে ফেলে। বাংলাদেশসহ তৃতীয় বিশ্বের দেশের এটিই সাধারণ চিত্র। তবে ইশতেহারে ঘোষিত প্রতিশ্রুতির উল্লেখযোগ্য অংশও যদি বাস্তবায়ন করতে হয় এবং দিতে হয় ন্যূনতম সুশাসন, তা হলে একমাত্র পথ প্রশাসনকে নিয়মতান্ত্রিক পথে পরিচালনা করা।

একটি দরিদ্র দেশে আসলে চাওয়ার কোনো শেষ নেই। অনুরূপভাবে তা পাওয়ার জন্য এমন কোনো পথ নেই যা অবলম্বন করা হয় না। সাধারণত যারা ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন, তারা অলিখিতভাবে দলীয় কর্মীদের মূল্যায়ন করতে বাধ্য হন। ন্যায় বা অন্যায় পথে যেভাবেই হোক, তাদের মধ্যে সরকারি নানা সুযোগ-সুবিধা বণ্টন করতে হয়। এতে অনেক সময় জাতীয় স্বার্থ বিঘ্নিত হয়। কিন্তু এ মূল্যায়ন না করলে নিজ দলের কর্মী ও সমর্থক হতে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ার আশঙ্কা তৈরি হয়। এভাবে মাঠ পর্যায়ের কর্মীদের মূল্যায়িত হওয়ার নামে তাদের নানা আবদার মেটাতে হয়। তারা অনেক সময় দলের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে এতোটাই বেপরোয়া হয়ে ওঠে যে নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। তাদের ক্ষমতার অপব্যবহার নিত্য-নৈমিত্তিক ঘটনায় পরিণত হয়। ঢাকার চেয়ে এর বাইরে তাদের দৌরাত্ম্য অধিক আঁচ করা যায়। তারা এমন ক্ষমতাও রাখে যে, স্থানীয় প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তাদেরও বদলি করে দিতে পারে কথায় কথায়। এ ক্ষেত্রে বাঁশের চেয়ে কঞ্চিই বড় হয়ে দেখা দেয়। তারা ক্ষমতাসীন দলের বড় কোনো পদে আসীন না হয়েও হরহামেশা ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে চলে। এ প্রবণতা বা সংস্কৃতি অনেক বেড়ি গেছে এবং এর কারণে প্রশাসনের লোকজনের মধ্যে দেখা দেয় হতাশা। তারা পদে পদে তটস্থ। এভাবে তৃণমূল নেতা-কর্মীদের ম্যানেজ করে চলতে গিয়ে প্রশাসনের নিয়মমাফিক কাজ করা কঠিন হয়ে পড়ে।

বলাবাহুল্য, এ পরিস্থিতি তৈরি হওয়ার অন্যতম প্রধান কারণ দারিদ্র্য। এই কয়েকদিন আগেও বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট জি ইয়ং কিম এক ভাষণে বলেন যে, বিশ্বের দরিদ্র মানুষের ৬ শতাংশ বাস করে বাংলাদেশে। তবে এ কথাও সত্যি যে, প্রশাসনিক নিয়ম-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠিত না হলে আমাদের সার্বিক অবস্থার পরিবর্তন কখনই হবে না। তাই প্রশাসনকে দলীয় রাজনীতির বাড়াবাড়ি থেকে মুক্ত রাখার জন্য রাজনৈতিক নীতিনির্ধারক মহলের মনোযোগী হওয়া উচিত। তৃণমূলের যেসব নেতাকর্মী সীমালঙ্ঘন করছেন তাদের লাগাম টেনে ধরতে হবে। সরকারের ভাবমূর্তি রক্ষার জন্যই দ্রুত এ ব্যাপারে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন।