দামুড়হুদার গোন্দিহুদায় হাতি, ঘোড়া, বাঘ, হরিণ আর চ্যঙব্যঙ

রঙে রঙে বোশেখ রুক্ষ পৃথিবীকে সবুজ করে : হঠাঝড়ে বাংলার সব কিছু গুঁড়িয়ে গেলেও প্রাণ ফিরে পায় বৃক্ষগুল্মলতা

তাছির আহমেদ: মাটি দিয়ে নিখুত কারুকার্যে বানানো হাতি, ঘোড়া, বাঘ হরিণ আর রাঙা তুলতুলে গালের পুতুলগুলো সব থেকে বেশী সুন্দর। আর চ্যঙব্যঙ হলো অসম্ভব সুন্দরের মায়াবী যাদু। বোশেখের মেলায় যারা এ চ্যঙব্যঙ দেখেন নাই তারা যে শুধু পছতেছেন তা নয় অনেকেই করেছেন খুব আফসোস। কারণ পহেলা বোশেখ বাঙালিদের মহোৎসব। স্বাদ আর গুণমানও অন্য উৎসবের চেয়ে ভিন্ন। সারা বছর ভাল থাকার আশা নিয়ে যে যেভাবে পারেন দিনটিকে স্মরণ করেন। উদযাপন করেন। এটাই হলো বাঙালির হাজার বছরের কৃষ্টি ও ঐতিহ্য। পান্তা-ইলিশ আধুনিক বোশেখে জায়গা করে নিলেও ভালো-মন্দ খাবারের তালিকায় মোয়া, বাতাসা, চিঁড়া-গুড় টকদই এ উৎসব খাবার এখন গ্রাম ছেড়ে বাসা বেঁধেছে শহরের এক কোনায়। গ্রাম্য আহলাদের হাডুডু আর লাঠিখেলা ছিটিয়ে দেয়া হয়েছে শহরের মধ্য দিয়ে। গ্রামের আকাশে যত না ঘুড়ি দেখা যায় তার চেয়ে বেশি উড়তে দেখা যায় অট্টালিকার ওপরে। ঝুনঝুনি বাজতে দেখেছি মেঠোপথের ধারে। সেই ঝুনঝুনি এখন গেছে উবে। তবে অবশ্য বেলুনের দেখা মেলে। বাঁশের তৈরি নকশি হাতপাখা এখনও আছে। তালপাতার বাঁশি শত বছরের স্মৃতি আজও বহন করে। দেখা যায় না, গুড়ের জিলাপি। হাতে ভাজা মুড়ি। যান্ত্রিক সভ্যতা বোশেখ উদযাপন করে যান্ত্রিকভাবেই।

অথচ নানির মুখে শুনেছি পহেলা বোশেখের কত গল্প। চৈত্র সংক্রান্তিতে প্রতিটি বাড়িতে চাল অহর ডাল ভাজা, পান্তা খাওয়া হতো। মরিচ, পিঁয়াজ, সরিষার তেল মেখে শুঁটকির ভর্তা থাকতো। পুকুরের মাছ, শজনে ডালঘণ্ট থাকতো দুপুর নয়তো রাতের খাবারে। ব্যবসায়ীরা লাল মলাটের নতুন খাতা খুলে, হালখাতা করতো ঋণ পরিশোধের জন্যে। এদিনই নতুন হিসাব নিয়ে যাত্রা শুরু করতেন ব্যবসায়ীরা। এ নিয়ম আজও আছে। আমার নানি আরো বলেছিলেন, পহেলা বোশেখে শামুকের জল চোখে দিলে সারা বছর থাকতো চোখ ঠান্ডা। অহর ডালভাজা খেলে শক্ত থাকবে দাঁত। এদিন কিশোর-যুবকরা দলবেঁধে খরগোশ, পাখি কিংবা যে কোনো প্রাণী শিকার ছিলো সাহসের প্রতীক। সবাই বলতো ছেলেটা সাহসী হবে। প্রতিবাদী হবে। বিকেলে গ্রামে গ্রামে লড়াই প্রতিযোগিতা হাডুডু থাকতো, সেই সাথে ফুটবল। লাঠিখেলা, ঘোড়া দৌঁড়, বুড়িচি, মেয়েদের চোখ বাঁধানো কিংবা লুকোচুরি। এ প্রতিযোগিতার জন্য প্রস্তুতি নেয়া হতো কয়েক মাস আগ থেকেই। কয়েক গ্রাম মিলে হতো বোশেখি এ মেলায় সেখানে পাওয়া যেত বিভিন্ন ধরনের খৈ, গুড়ের জিলাপি, মুড়ি-মুড়কি। চরকি, বাইস্কোপ, দোলনা ইত্যাদি দেখা যেতো। বাঁশের বাঁশি বিক্রি, সাপখেলা, ভাগ্য গণনা ছিলো মেলার বাড়তি আনন্দ। ৫ পয়সা থেকে চার আনা পকেটে থাকলেই তাকে পায় কে? লেইসফিতা আর কাঁচের চুড়ি আর লিপষ্টিক পাওয়া যেত। পালাগান কিংবা যাত্রাগান হতো এ মেলার প্রধান আকর্ষণ। বোশেখি মেলার আরেকটি দুর্দান্ত খেলা হলো চরকি। ৩০শে চৈত্র চরক পূজা হতো। মৃত্যুকে সাথে নিয়ে পিঠে বড়শী গেঁথে উঁচু বাঁশের মাথার রশিতে পিঠে লোহার বড়শি গেঁথে ঘুরানো হতো। এমনটি এখনও কোথাও কোথাও হয় বলে শুনেছি। কিন্তু কালের গর্ভে সব কিছু আজ হারিয়ে যেতে বসেছে। যেমনিভাবে হারিয়ে গেছে মাটির পিদিম। তবুও বোশেখ আসে-আসবে উজ্জীবিত হয়ে নানা আয়োজনে। কিন্তু নানির মুখের কথার সেই বোশেখ আর খুঁজে পাওয়া যাবে না। তবে এটুকু জানি, আগের সেই সন্ন্যাসী নেই। গোলাভরা ধান নেই। গোয়ালে নেই গাভি। নেই পুকুর ভরা মাছ। গ্রামকে গিলে খেয়েছে শহর। কাজেই হাজার বছরের ঐতিহ্য সেই বোশেখকে এখন টেনে আনা কষ্টের। প্রতিটি মুহূর্ত বিষাক্ত হাওয়ায় সাঁতার কাটছি আমরা। কাজেই বোশেখ আসবে। আর সেই বোশেখকে আমাদের মতো করেই বরণ করতে হবে। যেভাবে এখন ধারণ করছি—

বেলা তখন গড়াচ্ছে ঠিক সাড়ে তিনে। হাজার হাজার লোকে লোকারন্য দামুড়হুদার গোবিন্দহুদা গ্রামের হাজরাভিটায়। তার মধ্যে আমি ফাঁকফোঁকড় দেখে দেখে এদিক সেদিক উকিঝুকি মেরে মেরে চারিদিকটা দেখছি। বাঁশ তলায় ওতো লোক, কি হচ্ছে ওষানে তা দেখার আগ্রহে এগিয়ে যেতেই পরিচিত মুখগুলোর মধ্যে কেউকেউ সরে গেল। আহলাদের শালা-বোনাই, আর মামা-ভাগ্নেরা মুঁচকি হাসি দিয়ে বললেন ওমামা ছবিমমি যেন তুলেন না! কি এটা? কাছে এসে আরো বলেন, এইটা নিয়ে চলে যান। যাবো না, খেলা করবো। এ খেলার নাম কি চ্যঙব্যঙ? চিংড়ি মাছের চ্যঙ আর ব্যঙের ব্যঙ,তাই মিল করে চ্যঙব্যঙ। বাহ! চমৎকার কতকি? চ্যঙব্যঙে যা ধরবেন তার ডবল আর টিকটিকিতে পাবেন আসল। প্রায় ঘন্টা খানেক ধরে এই চ্যঙব্যঙ খেলাটি খুব ভালো করে দেখলাম। এখানের বেশির ভাগ খেলোয়াড় হলো শিশু শ্রেনির বালক। খুব নির্দয় ভাবে এসকল শিশুদের কাছ এ চ্যঙব্যঙে চক্র গাদাগাদা টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। একশ টাকা চ্যঙব্যঙ খেলে হেরে যাওয়া শিশুটির কষ্ট দেখে তার কাছে গিয়ে তার হাতে একশ টাকা দিয়ে বললাম, ওই টাকা ফিরিয়ে আনতে হবে, যাও আবার খেলো গিয়ে। অবাক বিষয় ছেলেটির বিমর্ষ মলিন মুখ তড়াক করে বিলীন হয়ে গেলো। এ সুযোগে ছেলেটিকে বললাম, সোনামনি তোমার নাম কি? আকাশ। তোমাদের বাড়ী কোথায়? নাপিতখালি। বাবার নাম সে জানে না কারণ অনেক আগেই তার মাকে ছেড়ে রাজধানীতে চলে গেছে। অবশ্য তার নানার নাম দাউদ। বোশেখের মেলায় খেলনাপাতি আর মিষিটিষ্টি খাবে বলে ১৫-২০ দিন ধরে সে ভুট্টা কুড়িয়ে ১০ কেজি সংগ্রহ করতে সক্ষম হয়েছে। ভুট্টা কুড়িয়ে বিক্রির উপার্জিত অর্থ তার একশ টাকা হারিয়েছে চ্যঙব্যঙে। এবার আমার দেয়া একশ টাকা হেরে এক নিরিবিলির প্রান্তে যেয়ে বসে পড়লো আবার সেইভাবে। আবার কাছে যেয়ে অসহায় সেই মলিন মুখে ফিরিয়ে দাও আমার টাকার ধাক্কা। এ মুহুর্তে তার বিমর্ষের চেহারা যারা স্বচোক্ষে দেখেছেন তারা অনেকেই বুঝেছেন আসল বিষয়টা কি? এ খেলা আর খেলবা? না। সত্যি? হ্যাঁ। তারপর মানিব্যাগ থেকে আবার কুড়ি টাকা বের করে হাতে দিয়ে বললাম সোনামনি সোজা বাড়ি চলে যাও। দৃষ্টি তার চলে যাওয়া পথকে ফলো শেষে ফিরতেই পিছন থেকে মামা আপনার টাকা আপনি নিয়ে যান।

মনে মনে বললাম বোশেখকে আমাদের মতো বরণ না করে, যদি কবি ফজল শাহাবুদ্দীনের ভাষায় বোশেখকে বরণ বা উদযাপন হতো তাহলে খুব কতো ভালো হতো! এ কবির ভাষায়-তুমি এলে মনে হয় যেতে চাই সেইখানে/সেই প্রিয় উপত্যকা প্রজাপতি আর পর্বতের কাছে যেখানে অচিন্তনীয় উষার শরীর আর স্বর্ণরঙ চন্দ্রিমার ছায়া আজো বেঁচে আছে। মানুষের সব প্রেম যেইখানে গোধূলির কাছে। একটি সূর্যাস্ত হয়ে চিরকালে সমর্পিত হয়- তুমি এলে জন্ম নেয় সেই প্রেম সেই চিরকাল সেই পরম বিস্ময়। রুক্ষ পৃথিবীকে সবুজ করে বোশেখ। হঠাৎ ঝড়ে বাংলার সব কিছু গুঁড়িয়ে গেলেও প্রাণ ফিরে পায় বৃক্ষগুল্মলতা। নতুন বৃষ্টির জলে জেগে ওঠে ঘাস। পৃথিবীর পাল্টায় তার চেহারা। নবসাজে যাত্রা শুরু করে পৃথিবী। বোশেখে ফুটে বনলতা। ফলদবৃক্ষ যৌবনে টলটল করে। ঘর বাঁধে পাখি। বৈশাখ শুধু প্রকৃতিকেই সুন্দর করে না- সুন্দরভাবে সামনে চলার পথ তৈরি করে। শুদ্ধ পৃথিবীর পথে শুরু হয় মানুষের পথচলা। কাজেই বোশেক বাঙালিদের জীবনে আলোকবর্তিকা হয়ে আছে। তাই তো বোশেখ এলে উচ্চারিত হয়, এসো হে বৈশাখ, এসো এসো—-