গাঁজা বিক্রির প্রতিবাদ করায় চাচা ও চাচাতো ভাইয়ের ভুজালিতে প্রতিবাদী যুবক খুন

ঘাতক ধরে পুলিশে সোপর্দ : নামাজে জানাজায় দাঁড়িয়ে দামুড়হুদার রঘুনাথপুর মাদকমুক্ত করার ঘোষণা দিলো সুধীমহল 

 

দামুড়হুদা অফিস/প্রতিনিধি: গাঁজা বিক্রির প্রতিবাদ করাই চাচা ও চাচাতো ভাইয়ের উপর্যুপরি ভোজালির আঘাতে খুন হয়েছে শাহিন হোসেন (২৫)। গতকাল শুক্রবার বেলা ১১টার দিকে দামুড়হুদার রঘুনাথপুর ঘাটপাড়াস্থ নিজেদের বাড়ির সামনে বাগবিতণ্ডার এক পর্যায়ে তুমুল সংঘর্ষে খুন হয় সে। আহত হয় উভয়পক্ষের নারীসহ ৫ জন।

ঘটনার আড়াই ঘণ্টার মাথায় দেড়টার দিকে দামুড়হুদার চিৎলা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের সামনে থেকে চাচা আলম হোসেন ওরফে আলম হুজুরকে স্থানীয় জনগণ ধরে পুলিশে দিয়েছে। শাহিনের লাশ দাফনের পর গতরাতেই তার পিতা আব্দুর রাজ্জাক বাদী হয়ে তিনজনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেছেন। মামলার আসামির তালিকায় রয়েছে আলম হুজুর, তার ছেলে ডালিম ও তাদের পার্শ্ববর্তী এক দোকানি। ডালিম ও প্রতিবেশী দোকানি আত্মগোপন করেছে। সন্ধ্যায় শাহিনের নামাজে জানাজায় গ্রামের সুধীমহল গ্রাম থেকে মাদক উচ্ছেদের ঘোষণা দিয়েছে।

ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে স্থানীয়রা বলেছেন, চুয়াডাঙ্গার দামুড়হুদা উপজেলার হাউলী ইউনিয়নের রঘুনাথপুর ঘাটপাড়ার মৃত আজিজ বিশ্বাসের ৪ ছেলে। আলম হোসনে বড়। তিনি বাড়ির অদূরেই চা দোকানি। আব্দুর রহমান পৈত্রিক ভিটে ছেড়ে সরোজগঞ্জ এলাকায় বসবাস করেন। তৃতীয় আব্দুর রাজ্জাক এক সময় গাঁজা বিক্রি করলেও সম্প্রতি তা ছেড়ে দিয়েছে। আব্দুর কাদের দিনমজুর। আব্দুর রাজ্জাকের তিন ছেলের মধ্যে বড় ছেলে রাসেল গতকালই সকালে তার চাচাতো ভাই ডালিমের নিকট থেকে এক পুরিয়া গাঁজা কেনে। ডালিম বড় চাচা আলম হুজুরের ছেলে। বড় ভাই রাসেলের গাঁজা কেনার বিষয়টি তার মেজ ভাই শাহীন জানার পর চাচা আলম হুজুরকে দোষারোপ করে। দোকানের সামনে গিয়ে চাচাকে বলে, তোমার ছেলে গাঁজা বিক্রি করে তুমি দেখো না? এ নিয়েই শুরু হয় বাগবিতণ্ডা। এক পর্যায়ে বড় চাচা আলম হুজুর ভোজালি নিয়ে ছুটে যান। আলমের ছেলে ডালিমও রুখে যায় শাহিনের দিকে। ভুজালি দিয়ে একের পর এক আঘাত করতে থাকে তারা। ঘাড়ে কোপ লাগে। বুকের বাম পাজরের ভুজালির আঘাতটি হৃৎপিণ্ডে লাগে। পেটেও কয়েকটি ভুজালির আঘাত করা হয়। ঘটনাস্থলেই লুটিয়ে পড়ে শাহিন। তার বড় ভাই রাসেল, তাদের মা রহিতন, শাহিনের পাঁচ মাসের অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী রুমি রুখে গেলে তুমুল সংঘর্ষে রূপ নেয়। এরাসহ অপরপক্ষের আলম হুজুর, তার স্ত্রী সুফিয়া খাতুন, ছেলে ডালিম ও ডালিমের স্ত্রী বিউটি আহত হয়। সংঘর্ষের এক পর্যায়ে মুমূর্ষু অবস্থায় শাহিনকে উদ্ধার করে চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালে নেয়া হয়। হাসপাতালের জরুরি বিভাগেই প্রাথমিক চিকিৎসা দেয়ার সময় মারা যায় শাহীন। তার লাশ নিকটজনেরা নিয়ে রঘুনাথপুরের দিকে রওনা হয়। খবর পেয়ে পথিমধ্যে বাধ সাধে দামুড়হুদা থানার এসআই আবু জাহের ভুঁইয়া। তিনি সঙ্গীয় ফোর্স নিয়ে লাশ পুলিশ হেফাজতে নেন। লাশ নেয়া হয় চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালমর্গে। বিকেলে ময়নাতদন্ত শেষে স্বজনদের হাতে তুলে দেয়া হয়। বাদ মাগরিব গ্রামের ঈদগা ময়দানে নামাজে জানাজা সম্পন্ন হয়।

এ সময় ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান সহিদুল ইসলাম বক্তব্য দিতে গিয়ে বলেন, রঘুনাথপুর গ্রামটি বর্তমান সংসদ সদস্যের গ্রাম। এ গ্রামে বহু মানুষ বাস করেন। গুটি কয়েক মাদকবিক্রেতার জন্য গ্রামটি কলুষিত হচ্ছে। একজনকে খুন হতে হলো। এখন থেকে আমরা গ্রামের সাধারণ মানুষ সম্মিলিতভাবে গ্রাম থেকে মাদক উচ্ছেদ করেই ছাড়বো। এ আহ্বানে নামাজে জানাজায় শরিক মুসল্লিরা সম্মত হন। নামাজে জানাজা শেষে গ্র্রাম্য কবরস্থানে দাফন কাজ সম্পন্ন করা হয়েছে।

গতরাতেই শাহিনের পিতা বাদী হয়ে দামুড়হুদা থানায় হত্যা মামলা রুজু করেছেন। মামলায় মৃত আজিজ বিশ্বাসের ছেলে আলম হোসেন ওরেফে আলম হুজুর, তার ছেলে ডালিমসহ তিনজনকে আসামি করা হয়েছে। ডালিমসহ অপরজন আত্মগোপন করলেও গতকালই বেলা দেড়টার দিকে দামুড়হুদার উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স তথা চিৎলা হাসপাতাল প্রাঙ্গণ থেকে স্থানীয়রা ধরে পুলিশে দেন আলম হোসেনকে। তাকে দামুড়হুদা থানায় নিয়ে পুলিশ প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদ করলেও হত্যার কথা স্বীকার করেছে কি-না তা অবশ্য নিশ্চিত করে জানা সম্ভব হয়নি। ঘটনাস্থল থেকে পুলিশ দুটি ধারালো অস্ত্র উদ্ধার করেছে। আলম হোসেনকে আজ শনিবার আদালতে সোপর্দ করা হতে পারে। রিমান্ডেরও প্রক্রিয়া করছে পুলিশ। হাসপাতাল সূত্র বলেছে, সংঘর্ষে আহত হওয়ার পর আলম হোসেন ও তার স্ত্রী সুফিয়া খাতুন চিৎলা হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসে। পরে অপরপক্ষের আহত রাসেল একই হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে এলে আলম হোসেন সটকে পড়ার চেষ্টা করে। তখনই তাকে স্থানীয়দের সহযোগিতায় ধরে পুলিশে দেয়া হয়। পরবর্তীতে জানা গেছে, আলম হোসেনের স্ত্রী সুফিয়া খাতুন পরে হাসপাতাল থেকে সরে পড়েন। তিনি অজ্ঞাত স্থানে চিকিৎসা নিচ্ছেন। তাদের ছেলে ডালিম ইতোমধ্যেই ভারতে পাড়ি দিয়েছে বলে এলাকায় জোর গুঞ্জন রয়েছে। পুলিশ অবশ্য এ গুঞ্জনে কান না দিয়ে গ্রেফতারের জন্য সঠিক তথ্য সংগ্রহের কাজ শুরু করেছে। ঘটনার পরপরই দামুড়হুদা মডেল থানার ওসি আহসান হাবিব, ওসি (তদন্ত) ফকির আজিজুর রহমানসহ অনেকেই ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন।

শাহিনের স্ত্রী রুমি ৫ মাসের অন্তঃসত্ত্বা। সে চুয়াডাঙ্গা ফার্মপাড়ার আব্দুল হান্নানের দ্বিতীয় মেয়ে। রুমির বড় বোন স্বামী পরিত্যক্ত হিসেবে তিন সন্তান নিয়ে দরিদ্র পিতার বাড়িতেই থাকে। রুমি হলো বিধবা। এদের ছোট বোন প্রতিবন্ধী। গতকাল রুমির স্বামী মারা গেলে রুমির মা কাঁদতে কাঁদতে বলেন, এই মেয়েকে আমি কোথায় রাখবো? এ প্রশ্নযুক্ত আহাজারি শুনে অনেকেই ধরে রাখতে পারেননি চোখের অশ্রু।

আব্দুর রাজ্জাকের তিন ছেলে ও এক মেয়ের মধ্যে শাহিন ছিলো দ্বিতীয়। শাহিন ও তার বড় ভাই রাসেল করিমনচালক। গ্রামের একাধিকসূত্র বলেছে, শাহিন ও রাসেলের পিতাও গ্রামে দীর্ঘদিন ধরে গাঁজা বিক্রি করতো। ছেলরা বড় হয়ে করিমন চালিয়ে সংসারে সচ্ছলতা ফেরানোর পর মেজ ছেলে শাহিনেরই চাপে গাঁজা বিক্রি ছেড়ে দেয়। রাজ্জাক গাঁজা বিক্রি ছেড়ে দিলে সেই ব্যবসার হাল ধরে আলম হোসেন ওরফে আলম হুজুরের ছেলে ডালিম। তার নিকট থেকে রাসেল কিনলো গাঁজা, আর সে কারণেই শাহিন প্রতিবাদ করতে গিয়ে খুন হলো। স্থানীয় আওয়ামী লীগ নিহত শাহিনকে তাদের সক্রিয় কর্মী বলে দাবি করে বলেছে, খুনি আলম হুজুর জামায়াতে ইসলামী করে। ডালিম তার পিতার দোকানের পাশেই মুরগির মাংস বিক্রি করতো। ঘটনার পর পিতা-পুত্রের দোকান গুঁড়িয়ে দিয়েছে অপরপক্ষের উত্তেজিত লোকজন।