উপজেলা পরিষদ নির্বাচন এবং ক্ষমতার প্রভাব

পঞ্চম ও শেষ দফায় চুয়াডাঙ্গাসহ ৩৫ জেলার ৭৪ উপজেলায় আজ সোমবার ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হবে। এবারও ভোট গ্রহণের সময় সহিংসতা, কেন্দ্র দখলের আশঙ্কা করছেন বিরোধীদলীয় প্রার্থীরা।  উদ্বেগে রয়েছে সংশ্লিষ্ট এলাকার সাধারণ ভোটাররাও। তবে কমিশন বলছে, সুষ্ঠু নির্বাচনের বিষয়ে আশাবাদী। ইসি নির্বাচন সংশ্লিষ্ট এলাকায় যানবাহন চলাচল বন্ধ ঘোষণা করে সোমবার ছুটি ঘোষণা করেছে।

পঞ্চম দফায় চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যান ও মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন ১ হাজার ৬৩ প্রার্থী। উপজেলা পরিষদের জনপ্রতিনিধি নির্বাচনের সুযোগ পাচ্ছেন ১ কোটি ৪২ লাখ ৬০ হাজার ৬৬৩ জন ভোটার। এ নির্বাচনের আগে গত শনিবার শেষ মুহূর্তের প্রচার-প্রচারণা চালিয়েছেন প্রার্থীরা। আগের নির্বাচনগুলোর মতো এ নির্বাচনেও একই ধরনের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। মাঠে নেমেছেন সশস্ত্র সেনা-নৌবাহিনী, বিজিবি, ৱ্যাব, পুলিশ ও আনসার বাহিনীর সদস্যরা। একই ধরনের নিরাপত্তা ব্যবস্থায় একই ধরনের ভোট ডাকাতি, কেন্দ্র দখলের অভিযোগও একই ধরনের। প্রতিপক্ষের হামলার শিকার হয়েছেন কোনো কোনো প্রার্থী। অভিযোগকারীরা সুষ্ঠু নির্বাচনে বাড়তি নিরাপত্তা চেয়েছেন। কমিশন কর্মকর্তারা জানান, আগের নির্বাচনগুলোর মতোই এ নির্বাচনেও একই নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের ফৌজদারি কার্যবিধির ১৩১ ধারা প্রয়োগের ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। এ ক্ষমতাবলে ম্যাজিস্ট্রেটের অনুপস্থিতিতেও সশস্ত্র বাহিনীর কর্মকর্তারা অ্যাকশনে যেতে পারবেন।

চুয়াডাঙ্গা সদর ও আলমডাঙ্গা উপজেলাসহ দেশের যেসব উপজেলায় ভোট গ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়, সেগুলোর অভিজ্ঞতা সুখকর নয়। গত ২৩ মার্চ চুয়াডাঙ্গার জীবননগর উপজেলা পরিষদ নির্বাচন সম্পন্ন হয়। ভোটকেন্দ্র দখলসহ নানা অভিযোগ উত্থাপিত হয়। প্রথম দফার নির্বাচন মোটামুটি শান্তিপূর্ণভাবে অনুষ্ঠিত হলেও বাকিগুলোয় ব্যাপক সহিংসতা ও কারচুপির ঘটনা ঘটেছে। তৃতীয় দফার নির্বাচনে ৩ জন ও চতুর্থ দফায় ৪ জন সহিংসতার কারণে নিহত হয়। এসব নির্বাচনে অনেক কেন্দ্রের ভোট গ্রহণ স্থগিতও করা হয়েছে। অনেক প্রার্থী নির্বাচন বর্জনও করেছেন। আগের নির্বাচনগুলোর অভিজ্ঞতার প্রেক্ষাপটে আজকের নির্বাচনের সুষ্ঠুতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠাই স্বাভাবিক। ইতোমধ্যেই যেসব খবর পাওয়া গেছে, তাতে আশঙ্কার যথেষ্ট কারণ রয়েছে যে, এ নির্বাচনেও সহিংসতা ঘটবে। ৭৪টি উপজেলায় অনুষ্ঠেয় এ নির্বাচনের অনেক প্রার্থী, বিশেষত সরকারদলীয় প্রার্থী প্রকাশ্যেই প্রতিপক্ষের ভোটারদের ভয়ভীতি দেখাচ্ছেন বলে খবর রয়েছে। সঙ্গত কারণেই ভোটাররা, এমনকি অনেক ক্ষেত্রে প্রার্থীরাও নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। অভিযোগ রয়েছে, বিশেষত সরকারদলীয় প্রার্থী কেন্দ্র দখলসহ নানা ধরনের কারচুপির পরিকল্পনা করেছেন।

সঙ্গতকারণেই প্রশ্ন উঠছে, নির্বাচন কমিশনে ইতোমধ্যে যেসব অভিযোগ জমা হয়েছে, তার ভিত্তিতে কমিশন সঙ্কটের কতোটা সমাধান করতে পারবে? সংবাদমাধ্যম থেকে জানা গেছে, আগের নির্বাচনগুলোয় অনেক উপজেলায় কমিশন স্থানীয় প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও আওয়ামী লীগ নেতাদের কাছ থেকে সহযোগিতা পায়নি। স্থানীয় প্রশাসন ও পুলিশ নাকি কমিশনের নির্দেশ অনুযায়ী কাজ করেনি, তারা স্থানীয় সংসদ সদস্য ও আওয়ামী লীগ নেতাদের নির্দেশ পালন করেছেন। কথা হচ্ছে, প্রশাসন-নির্বাচনী কর্মকর্তা-আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যদি নির্বাচন কমিশনের নির্দেশ পালন না করে থাকে, সেক্ষেত্রে কমিশন চুপ থেকেছে কেন? দ্বিতীয়ত, এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচনের সময় প্রধান নির্বাচন কমিশনার দেশের বাইরে অবস্থান করছেন কোন মহৎ উদ্দেশ্যে? আমরা বলতে বাধ্য হচ্ছি, নির্বাচন কমিশন গত চার দফার উপজেলা নির্বাচনে যে পারফরম্যান্স দেখিয়েছে, তাতে কমিশনের ভাবমূর্তির যথেষ্ট ক্ষতি হয়েছে। হৃত ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধার করতে হলে কমিশনকে আজকের পঞ্চম দফার নির্বাচনে কঠোর অবস্থান নিতে হবে। তবে এটাও ঠিক যে, কোনো নির্বাচনের সুষ্ঠুতা শুধুই নির্বাচন কমিশনের ওপর নির্ভর করে না। সরকার, রাজনৈতিক দল, প্রশাসন, সর্বোপরি নির্বাচকমণ্ডলীর সহযোগিতা ছাড়া নির্বাচন সুষ্ঠু হতে পারে না। আমরা লক্ষ্য করেছি, নির্বাচনে রাজনৈতিক দলের কর্মীরা গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি প্রদর্শনে ব্যর্থ হচ্ছেন। তারা গণতন্ত্র চর্চার চেয়ে দলীয় জয়-পরাজয়ের বিষয়টিকেই বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন। দলীয় কর্মী-সমর্থকরা দলের বিজয় কামনা করবেন, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু এ চাওয়া গণতন্ত্রকে ছাপিয়ে যেতে পারে না। আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে চলছে ভয়াবহ সঙ্কট। আর এ সঙ্কটে শুধু নির্বাচনী প্রক্রিয়াই বিপর্যস্ত হচ্ছে না, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রাও নষ্ট হচ্ছে। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পর দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি অনেকটাই স্থিতিশীল হয়ে উঠেছে। আমরা চাই না, এ স্থিতিশীলতা আবারও নষ্ট হয়ে যাক। সরকারকে এ ব্যাপারে বিশেষ দৃষ্টি দিতে হবে।

স্থানীয় সরকার নির্বাচনের ফলাফলে সরকারের পরিবর্তন হয় না। এমন নির্বাচনেও যদি সরকার প্রভাব বিস্তার করতে চায়, তাহলে বিরোধীদলের সাথে সরকারের দূরত্ব বাড়বে বৈকি। সেক্ষেত্রে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বাধাগ্রস্ত হবে, যা ক্ষতি ডেকে আনবে সরকারেরই। সুতরাং উপজেলা নির্বাচনের শেষ ধাপটা সবার কাছে গ্রহণযোগ্য হোক- এটাই কাম্য।