ভারতে আটক ৫২ সন্ত্রাসীকে দ্রুতই দেশে আনা হচ্ছে!

 

 

স্টাফ রিপোর্টার: ত্রিমতি সুব্রত বাইন। দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসী। ২০০১ সালে তাকে ধরিয়ে দিতে এক লাখ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করে তৎকালীন সরকার। তারপর থেকে বাইন লাপাত্তা। খবর রটে সে ভারত পালিয়ে গেছে। সেখান থেকেই বাংলাদেশে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড চালাচ্ছে। তারপর কোলকাতা পুলিশের হাতে ধরা পড়ে বাইন। তাকে দেশে ফিরিয়ে আনতে তোড়জোড় শুরু হলেও আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে তা সম্ভব হচ্ছিল না। অবশেষে বন্দিবিনিময় চুক্তি হয়ে গেলে সুব্রতসহ আরো অনেক সন্ত্রাসীকে দেশে ফিরিয়ে আনার সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে।

বাইনের মতোই ভারতের বিভিন্ন প্রদেশে বাংলাদেশের অন্তত ৫২ দুর্ধর্ষ অপরাধী ধরা পড়ে কারাবাসে রয়েছে। ইতোমধ্যে তাদের হস্তান্তর করতে ভারতের কাছে একটি তালিকা পাঠিয়েছে বাংলাদেশ। তালিকার মধ্যে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার অন্যতম আসামি ও হরকাতুল জিহাদ নেতা মুক্তাকিন, মোরসালিন ও শিবির ক্যাডার সাজ্জাদ হোসেন রয়েছে। আগামী তিন মাসের মধ্যে পর্যায়ক্রমে তাদের ভারত থেকে দেশে ফিরিয়ে আনা হবে বলে পুলিশ কর্মকর্তারা আশা করছেন।

অন্যদিকে বাংলাদেশের কারাগারে আটক উলফা নেতা অনুপ চেটিয়াকে ফেরত পাঠাতে ফের আলোচনায় বসছে বাংলাদেশ ও ভারত। ভারত থেকে বাংলাদেশের তালিকাভুক্ত অপরাধীদের ফেরত পাওয়ার পরই অনুপ চেটিয়ার ব্যাপারে সিন্ধান্ত হবে বলে গোয়েন্দা সংস্থার একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে। ভারত থেকে অপরাধীদের ফেরত আনার ব্যাপারে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল গতকাল শুক্রবার বলেন, ‘সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে ভারত ও বাংলাদেশ সরকার হার্ডলাইনে। তাদের কিছুতেই রক্ষা করা হবে না। ভারতের বিভিন্ন কারাগারে আটক দুর্ধর্ষ অপরাধীদের বাংলাদেশে ফিরিয়ে আনতে জোর তৎপরতা চালানো হচ্ছে। যেহেতু বন্দিবিনিময় চুক্তি হয়ে গেছে, তাই আর কোনো বাধা নেই আমাদের। আগামী তিন মাসের মধ্যে দুর্ধর্ষ ক্রিমিনালসহ অর্ধশতাধিক অপরাধীকে ফেরত আনা সম্ভব হবে।’ এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘অনুপ চেটিয়াকে ভারতের কাছে ফেরত দেওয়ার ব্যাপারে ফের আলোচনায় বসবে দুই দেশ। আশা করি তাকেও ফেরত পাঠানো যাবে।’

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, দীর্ঘদিন ধরেই আন্ডারওয়ার্ল্ডের শীর্ষ সন্ত্রাসী, জঙ্গি, চোরাকারবারিসহ ভিন্ন ধরনের অপরাধী ভারতের বিভিন্ন প্রদেশে থেকে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড চালিয়ে আসছে। ওই দেশে তারা মাছের ব্যবসা, চোরাকারবার ও আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবসা করছে। মাঝে মধ্যে তারা বাংলাদেশে এসে অপরাধ কর্মকাণ্ড চালিয়ে পুনরায় ভারত চলে যাচ্ছে। প্রায় চার মাস আগে বাংলাদেশ সরকার অপরাধীদের ব্যাপারে একটি তালিকা ও একটি চিঠি পাঠায় ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে। চিঠিতে বলা হয়-  তালিকাভুক্তরা দুই দেশের সম্পদ নষ্ট করছে। কিছুতেই তাদের রোখা যাচ্ছে না। তারা যুবসমাজকে ধ্বংস করে দিচ্ছে। তারা সীমান্ত এলাকা দিয়ে বাংলাদেশে থাকা সহযোগীদের কাছে পাঠাচ্ছে অস্ত্র ও মাদকের চালান। তাদের গ্রেপ্তার করতে না পারলে দুই দেশের নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়বে। বাংলাদেশকে পাল্টা চিঠি দিয়ে ভারত জানিয়ে দেয়, তাদের দেশের কিছু অপরাধী বাংলাদেশে আত্মগোপনে আছে। তার মধ্যে উলফা নেতা অনুপ চেটিয়া, জঙ্গি নেতা দাউদ মার্চেন্ট অন্যতম।

যেসব স্থানে বাংলাদেশি অপরাধী বেশি : গোয়েন্দারা নিশ্চিত হয়েছেন, কোলকাতার মাকুয়া স্ট্রিট, হোটেলপাড়া ফ্রি স্কুল স্ট্রিট, পার্ক স্ট্রিট, রিপন স্ট্রিট, গালিব স্ট্রিট, ক্যাসেট স্ট্রিট, বনগাঁ, চব্বিশ পরগনা,  বশিরগাঁও, নদীয়া, মুর্শিদাবাদ, আগরতলা, আগ্রাবাদ, মুম্বাইসহ আরো কয়েকটি স্থানে বসবাস করছে বাংলাদেশি অপরাধীরা। ওইসব এলাকায় বিয়েশাদি করে মাছের ব্যবসার পাশাপাশি চোরাকারবারি চালাচ্ছে।

ভারতে বিশেষ অভিযান ও গ্রেপ্তার : সূত্র জানায়, চিঠি চালাচালি হওয়ার পর ভারতে আত্মগোপনে থাকা সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে বিশেষ অভিযান শুরু করে পুলিশ। ওই অভিযানে অন্তত শতাধিক বাংলাদেশি অপরাধীকে আটক করা হয়। তার মধ্যে কয়েকজন জামিন নিয়ে কারাগার থেকে বের হয়ে যায়। এখনো ওই দেশের কারাগারে আটক আছে সুব্রত বাইন, চট্টগ্রাম আন্ডারওয়ার্ল্ডের অন্যতম সন্ত্রাসী শিবির ক্যাডার ও মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি সাজ্জাদুর রহমান, ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার আসামি ও জঙ্গি সংগঠন হরকাতুল জিহাদ হুজি নেতা মুরসালিন ও মুক্তাকিন, চরমপন্থী নেতা মুক্তার, রসুল, আরেফিন, তানভীরুজ্জামান, সাবেক সংসদ সদস্য আহসানউল্লাহ মাস্টার হত্যা মামলার মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি দিপু, নাসির উদ্দিন, খোরশেদ আলম, তৌফিকুল আলম, শাহীন সিকদার, নবউত্তম, মফিজুল ইসলাম, এম টি বাবু, নবীর হোসেন, জিসান ওরফে জিসু, মকবুল হোসেন, মুকুল, পিয়ালসহ ৫২ অপরাধী।

আবার গুঞ্জন উঠেছে- সম্প্রতি কলকাতার চব্বিশ পরগনা পুলিশের হাতে আটক হয়েছে পুরস্কারঘোষিত সন্ত্রাসী মোল্লা মাসুদ, শাহাদৎ হোসেন ও হুজি নেতা মাওলানা তাজউদ্দিন। যদিও পুলিশ বা র‌্যাব তাদের আটক হওয়ার তথ্য নিশ্চিত করতে পারছে না। তবে একটি গোয়েন্দা সংস্থার এক কর্মকর্তা কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘এই তিন ক্রিমিনালের আটক হওয়ার পর কোলকাতা পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছে। তারাও আটক হওয়ার কথা আমাদের অবহিত করেন। তবে কবে বা কোথা থেকে আটক করা হয়েছে তা বলছেন না। আমাদের কাছে তথ্য আছে, জঙ্গি নেতা মাওলানা তাজউদ্দিন দক্ষিণ আফ্রিকায় আছে। কলকাতা পুলিশ মিথ্যা বলছে বলে মনে হচ্ছে।’

ওই কর্মকর্তা আরো বলেন, সাত মাস আগে সুব্রত বাইন নেপাল কারাগার থেকে সুড়ঙ্গ খুঁড়ে পালিয়ে কোলকাতায় আসার পর গ্রেপ্তার হয়। অবৈধভাবে সেখানে বসবাস করায় আদালত বাইনকে ১৩ বছরের কারাদণ্ড দেন। গত বছর কোলকাতায় ধরা পড়ে চট্টগ্রামে আট ছাত্রলীগ নেতা হত্যা মামলার মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি শিবির ক্যাডার সাজ্জাদ হোসেন। এর আগে পুশব্যাকের মাধ্যমে মিরপুরের শীর্ষ সন্ত্রাসী তাজউদ্দিন, লম্বু, সেলিম, ইব্রাহিম ও ইমনকে দেশে ফিরিয়ে আনে পুলিশ।

যারা আত্মগোপনে : গোয়েন্দাদের তথ্যানুযায়ী- ভারতের বিভিন্ন স্থানে এখনো অন্তত সহস্রাধিক ক্রিমিনাল আত্মগোপনে থেকে অপরাধ কর্মকাণ্ড চালাচ্ছে। তাদের মধ্যে শরীফ, টিটু, প্রকাশ, জিয়া, বিজু, রতন, ইমরান, কালা সেন্টু, এবায়দুল, ভাগিনা মামুন, কিলার ইকবাল, আইজি গেইটের কচি, আগা শামীম, কামরুল হাসান ওরফে হান্নান, প্রকাশ কুমার বিশ্বাস, ইমাম হোসেন, তানভীরুল ইসলাম জয়, জিসান, মকবুল হোসেন, মুকুল, জব্বার মুন্না, কিলার মুন্না, রানা, সবুজ, বিকাশ, মিন্টু, জাকির, রেজা, বুলবুল, হারেস, মানিক ও নবী অন্যতম।

অনুপ চেটিয়াকে নিয়ে ফের বৈঠক হচ্ছে : বাংলাদেশের কারাগারে আটক উলফা নেতা অনুপ চেটিয়াকে ফেরত দেওয়ার ব্যাপারে শিগগির বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে আলোচনা হবে। ইতোমধ্যে ভারত থেকে বলা হয়েছে, দ্রুত অনুপ চেটিয়াকে ফেরত দেওয়ার জন্য। এ ব্যাপারে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, বাংলাদেশের অপরাধীদের ফেরত দেয়া হলেই অনুপ চেটিয়াকে ফেরত দেয়া হবে। আগামী মাসে অনুপ চেটিয়া-সংক্রান্ত্র একটি বৈঠক হওয়ার কথা রয়েছে।