মালয়েশিয়া যাওয়ার পথে দালালদের নির্যাতনে একজনের মৃত্যু

মেহেরপুরে আদমব্যবসায়ীর খপ্পরে পড়ে সর্বস্বান্ত হচ্ছেন অনেকে

মহসিন আলী/মাজেদুল হক মানিক: মেহেরপুরে আদমব্যবসায়ীর খপ্পরে পড়ে সর্বস্বান্ত হচ্ছেন অনেকে। সোনার হরিণ ধরতে গিয়ে প্রাণও হারাচ্ছে কেউ কেউ। নিঃস্ব হয়ে পরিবারের সদস্যরা ভাসছে অথই সাগরে। এমনভাবে কপাল পুড়েছে কদভানু নামের এক গৃহবধূর। বাড়ি মেহেরপুর সদর উপজেলার ঝাঁঝা গ্রামে। স্বামীর নাম আনারুল ইসলাম। স্বামীর মৃত্যুর খবর পেয়ে অথই সাগরে ভাসছেন তিনি। দালালদের শারীরিক নির্যাতন আর অনাহারের কারণে স্বামীর মৃত্যু হয়েছে বলে জেনেছেন তিনি। চার বছর বয়সের একমাত্র শিশু সন্তান আশিককে নিয়ে তিনি এখন চরম অসহায়। হাল ধরার কেউ নেই সংসারে। নেই কোনো জমি জায়গা। ভেঙে পড়া ঘরে এক টুকরো চাটাইয়ের বেড়া দেয়ার সামর্থও তার নেই। এক বেলা খাবার জোটে তো অন্যবেলা না খেয়ে দিন কাটছে। তার ওপর বিদেশ যাওয়ার জন্য স্বামীর রেখে যাওয়া প্রায় দেড় লাখ টাকা ঋণ কী করে পরিশোধ করবেন তা ভেবে দিশেহারা তিনি। অর্থাভাবে আইনের আশ্রয়েও যেতে পারছেন না ওই গৃহবধূ।

সরেজমিনে ঝাঁঝা গ্রামে গিয়ে দেখা গেছে, জরাজীর্ণ একটি কাঁচা ঘরের বারান্দায় একাই বসে আছেন কদভানু। স্বামীর খবরাখবর জানতে চাইলে তিনি কান্নায় ভেঙে পড়েন। তিনি জানান, দিন মজুরের কাজ করে ভালোই চলছিলো সংসার। পাশের ইছাখালী গ্রামের মৃত সুরমান আলীর ছেলে সাদের আলী আর আব্দুস সাত্তারের ছেলে সিদ্দিক মালয়েশিয়া যাওয়ার লোভনীয় প্রস্তাব দেয়। এরা দুজন অপর দালাল গাংনী উপজেলার কসবা গ্রামের বদর উদ্দীনের ছেলে আব্বাস আলীর সহযোগী। তারা জানায়, মালয়েশিয়া যেতে মোট ২ লাখ ২০ হাজার টাকা খরচ হবে। এক লাখ টাকা নগদ দিতে হবে আর বাকি টাকা মালয়েশিয়া গিয়ে কাজ করে পরিশোধ করতে হবে। এ লোভনীয় প্রস্তাবে রাজি হয়ে গরু-ছাগল বিক্রি করে এক লাখ টাকা তুলে দেয় দালালের হাতে। এরপর তার স্বামীকে গ্রামের আরও কয়েকজনের সাথে ঢাকা নিয়ে যায়। একদিন পর সেখান থেকে কক্সবাজার হয়ে অবৈধভাবে জলপথে থাইল্যান্ডে নিয়ে যায়। সময় লাগে ২২ দিন। সেখানে একটি ঘরে আটকে রেখে বাকি টাকা আদায়ের জন্য প্রচণ্ড মারধর করতো সেখানকার দালাল। খাবার দিতো একবেলা। মারধর আর অনাহারের কারণে তার স্বামী অসুস্থ হয়ে পড়েন। এ খবর শুনে ধার-দেনা করে বাকি টাকা দালালের হাতে তুলে দেন। পরে থাইল্যান্ড থেকে আবারও ২৭ দিন ধরে নদী পথে মালয়েশিয়া নেয়ার পথে তার স্বামী মারা যান। তার লাশ মালয়েশিয়া সীমান্তের একটি জঙ্গলের মধ্যে কাগজে জড়িয়ে ফেলে দেয়া হয়েছে বলে জানতে পেরেছেন তিনি। মোবাইলফোনে ৬ ফেব্রুয়ারি এ খবর জানিয়েছেন তার সাথে থাকা একই গ্রামের হেকমত। তার সাথে আরও একজনের লাশ ফেলা হয়েছে বলে জানান তিনি। কিন্তু তার পরিচয় জানেন না তিনি। এ খবর জানানোর কারণে তাকেও হুমকি দিচ্ছে ওই দালালেরা।

গ্রামের আব্দুস সালাম জানান, শুধু আনারুল নয়, একইভাবে দালালের প্রলোভনে পড়ে একই গ্রামের রজব আলীর ছেলে হেকমত আলী (৫০), মওলা বকসের ছেলে আসলাম (৪৫), বজলুর ছেলে মজনু (৩৫), রুহুল আমিনের ছেলে উজ্জল আলী (৩৫) ও মোসলেমের ছেলে এরশাদ (৩৮)। এরাও এক লাখ টাকা করে দালালদের হাতে তুলে দেয়। এরপর গত ২৮ ডিসেম্বর ২০১৩ তারিখে আনারুলের সাথে তাদের সবাইকে মালয়েশিয়ায় পাঠানোর জন্য ঢাকা নিয়ে যায়। বৈধ পথে তাদের বিদেশ পাঠানোর কথা থাকলেও অবৈধভাবে জলপথে থাইল্যান্ডে নিয়ে একইভাবে নির্যাতন করা হয়। তারা মালয়েশিয়া পৌঁছুলেও বর্তমানে সবাই শারীরিকভাবে অসুস্থ। ঠিকমত কাজ করতে পারছে না। এখান থেকে ওষুধ এবং টাকা পয়সা পাঠাতে হচ্ছে।

পরিবারের লোকেরা অভিযোগ করে বলেন, দালাল আব্বাস আলী খুব প্রভাবশালী। তার বিরুদ্ধে কেউ কথা বলতে পারে না। ছেলেগুলোর খবরাখবর জানতে চাইলে সেই আবার উল্টো ভয়ভীতি দেখায়। আনারুলের স্ত্রী টাকা ফেরত চাইলেও সে নানাভাবে হয়রানি করছে এবং ভয়ভীতি দেখাচ্ছে। আব্বাস আলী কাজ করছেন ঢাকার আদমব্যবসায়ী মহিউদ্দিনের সাথে।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, ঢাকার আদম ব্যবসায়ী মহিউদ্দিন এভাবে বিদেশ লোক পাঠানোর মূল হোতা। তার বাড়ি যশোর জেলায়। তার সহযোগী গাংনী উপজেলার কসবা গ্রামের বদর উদ্দীনের ছেলে আব্বাস আলী। আর আব্বাস আলীর সহযোগী হয়ে কাজ করছে সাদের ও সিদ্দিক। শুধু ঝাঁঝা গ্রামের নয়; বিভিন্ন গ্রামে বিশেষ করে প্রত্যন্ত এলাকায় দালাল লাগিয়ে একই ধরনের প্রলোভন দেখিয়ে এভাবে বিদেশ পাঠানো হচ্ছে। এতে অনেকেই সর্বস্বান্ত হচ্ছে। আরেক আদম ব্যবসায়ী গাংনী উপজেলার খড়মপুর গ্রামের আহম্মদ আলী এ উপজেলার খড়মপুর গ্রামের সাদাত আলীর ছেলে আসান আলী, একই গ্রামের জাকিরুল (৩৮), ওয়াসিম (২৩), কসবা গ্রামের জিয়াউর (৩৬), শানঘাটের সাইফুল (২২), পাকুড়িয়ার রুস্তুম (২৮), আড়পাড়ার মিনারুল (৩১) ও মেহেরপুর সদরের আমদহ গ্রামের লালনকে একই রকমের ফাঁদে ফেলে টাকা আদায়ের পর মালয়েশিয়া পাঠায় ২০১৩ সালে আগস্ট মাসে। তারা এখনও অবৈধভাবে মালয়েশিয়া অবস্থান করছেন। চুরি করে এক স্থান থেকে আরেক স্থানে গিয়ে কাজ করতে হচ্ছে তাদের। শারীরিকভাবে তারাও দুর্বল হয়ে পড়েছেন। এমন অভিযোগ ভুক্তভোগীদের পরিবারের।

মেহেরপুর সদর থানার ওসি শেখ আতিয়ার রহমান জানান, বিষয়টি তিনি তদন্ত করে দোষী আদম ব্যবসায়ীদের আইনের আওতায় আনবেন।