–মুন্সি আবু সাইফ
১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে বাংলাকে মাতৃভাষার হিসেবে স্বীকৃতি প্রাপ্তি বাঙালির অন্যতম শ্রেষ্ঠ অর্জন। মাতৃভাষার ক্ষেত্রে আমাদের এ বিরল অর্জন জাতি হিসেবে বিশ্বের বুকে বাংলা ভাষাভাষী মানুষের স্বতন্ত্র একটি মর্যাদা দান করেছে। তাই একুশ বাঙালি আবেগের সাথে নিবিড়ভাবে গ্রথিত। বাংলা আজ বিশ্বের মর্যাদাশীল ভাষা হিসেবে পরিগণিত। কিন্তু বিশ্বায়নের এ যুগে তথ্য প্রযুক্তির অভাবনীয় উন্নতির ফলে আমাদের ভাষায় কোনো অশনি সঙ্কেত দেখা দিয়েছে কি-না সে বিষয়টি একটু খতিয়ে দেখার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।
আশঙ্কা করা হচ্ছে, কিছু দিনের মধ্যেই পৃথিবী থেকে অনেক ভাষা বিলুপ্ত হয়ে যাবে। বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা ভাষা বিলুপ্তির এই বিরূপ প্রভাব বাংলা ভাষাতেও পড়তে পারে। কারণ বর্তমান যুগের ছেলে-মেয়েরা ইন্টারনেটের ভাষায় পারস্পারিক ভাব বিনিময় করছে। জগৎ একটি নির্দিষ্ট ভাষার কাছে কেন্দ্রীভূত হয়ে পড়ছে। যার ফলে মাতৃভাষা হচ্ছে উপেক্ষিত। ভাষার প্রতি এ ধরণের অনাদর নিশ্চয়ই কোনো শুভ ইঙ্গিত বহন করে না। ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ বলেছিলেন, তিনটি বস্তু মানুষের জন্য অত্যন্ত জরুরি। বস্তু তিনটি হচ্ছে মা, মাতৃভূমি আর মাতৃভাষা। তাই মাতৃভাষার প্রতি উদাসীনতা দেখিয়ে কোনো রূপ জাতীয় উন্নতি সম্ভব নয়। এখন আমাদের সবচেয়ে বড় প্রয়োজন সমৃদ্ধ ও অপার সম্ভাবনাময় বাংলা ভাষাকে যুগোপযোগী ভাষা হিসেবে গড়ে তোলা।
বাংলা ভাষাকে সমৃদ্ধ ও সংরক্ষণ করার ক্ষেত্রে শব্দের বানানে ও বাক্যে স্থিতিশীলতা আনতে হবে। বিশেষত বাংলা ক্রিয়াপদ ব্যবহারে হতে হবে যত্নশীল। যেমন আমরা প্রায়শ বলে থাকি ‘বেরুবে’ আবার কেউ বলে ‘বের হবে’ আবার কেউকেউ বলে ‘বেরোবো’। ক্রিয়াপদের এই বহুমাত্রিক ব্যবহার ভাষায় বৈচিত্র্য আনে ঠিকই কিন্তু শব্দ ও বাক্যে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করে। মনে রাখা প্রয়োজন বৈচিত্র্য নয় সমৃদ্ধি অর্জনই বড় কথা। ভাষার শ্রীবৃদ্ধিতে শব্দ ও বাক্যে স্থিতিশীলতা বজায় রাখার কোনো বিকল্প নেই। তা না হলে ভাষা দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়বে।
দ্বিবাচনিকতা ফলে ভাষা ব্যবহারের ক্ষেত্রেও নানা অসঙ্গতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। দেখা যায় একই অর্থবহনকারী শব্দ অঞ্চলভেদে ভিন্ন ভিন্ন রুপে ব্যবহৃত হচ্ছে। আমরা বলছি বিশ্বায়ন। পশ্চিমবঙ্গের মানুষ বলছে ভুবনায়ন। আমরা বলছি ‘সভাপতিত্ব করবেন’। পশ্চিমবঙ্গের মানুষ বলছে ‘পৌরোহিত্য করবেন’। আমরা বলছি ‘ভিত্তিপ্রস্তর’ স্থাপন করবেন। ওরা বলছে ‘শিলান্যাস করবেন’। অঞ্চলভেদে শব্দের দ্বিবাচনিকতা বাংলা ভাষার শব্দ সম্ভারকে সমৃদ্ধ করছে ঠিকই কিন্তু সরলীকরণের যুগে শব্দের দ্বিবাচনিকতা অনেক বিড়ম্বনার জন্ম দিতে পারে। প্রখ্যাত ভাষা বিজ্ঞানী এল ফার্গুসন ও ড. হুমায়ুন আজাদ বাংলা ভাষায় দ্বিবাচনিকতার ব্যবহার সম্পর্কে সতর্কতা আরোপের পক্ষপাতি।
বাংলা ভাষাকে আন্তর্জাতিকীকরণের ক্ষেত্রে আমাদের একটা বড় ভূমিকা পালন করতে হবে। আশার কথা সম্প্রতি ইউনেস্কো বাংলা ভাষাকে পৃথিবীর সবচেয়ে মিষ্টি ভাষা হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বাংলাকে জাতিসংঘের দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে ঘোষণার জোর দাবি জানিয়ে আসছেন। এ দাবিকে আরো যৌক্তিক করে তুলতে হলে আমাদেরকে পারিভাষিক শব্দ ব্যবহারের প্রতি সবিশেষ গুরুত্বারোপ করতে হবে। পারিভাষিক শব্দ একটি ভাষার আন্তর্জাতিক মান নির্ণয়ের ক্ষেত্রে জোরালো ভূমিকা পালন করে। তাছাড়া অনুবাদ সাহিত্যের মাধ্যমে ভাষার একটি বিশ্বজনীন রূপ দাঁড় করানো যেতে পারে।
জনসংখ্যার সংখ্যাতাত্বিক বিচারেও বাংলা ভাষার ব্যাপক প্রচার ও প্রসার সম্ভব। বিশ্বের অপরাপর দেশগুলোর মানুষের কাছে বাংলা ভাষার সংগ্রামী মাহত্ম্য তুলে ধরতে হবে। ভাষার সামাজিক সেন্সর বা টেবু যথা সম্ভব তুলে নিতে হবে।
বিখ্যাত জার্মান পণ্ডিত মাক্সমুলার মনে করেন, পৃথিবীর কোনো ভাষাই অন্যের শব্দের সাহায্য ছাড়া সমৃদ্ধি অর্জন করতে পারে না। অনেকের মধ্যে এ ধরনের হীনমন্যতা কাজ করে যে, বাংলা ভাষার শব্দ সম্ভার খুবই দুর্বল। কৃত ঋণের মাধ্যমে এ ভাষা সমৃদ্ধি অর্জন করেছে। এ ধরনের ভাবনা নিতান্তই অমূলক। আজকের যে ইংরেজি ভাষা পৃথিবীময় দাপট দেখিয়ে বেড়াচ্ছে তার এক বিশাল শব্দ সম্ভার ল্যাটিন ও গ্রিক ভাষা থেকে এসেছে। তাই বিদেশি শব্দ গ্রহণের ক্ষেত্রে উদারতা দেখানো অতি আবশ্যক। তা না হলে ভাষার বুকে সর্বনাশ নেমে আসতে পারে। বিদেশি শব্দ ব্যবহারে সেন্সর আরোপ করলে সংস্কৃত শব্দের মতো আমাদের ভাষাও একদিন মৃত ভাষায় পরিণত হতে পারে। অবশ্য এক্ষেত্রে আশার কথা বাংলা ভাষা এ বিষয়ে খুবই উদার। উদার ছন্দে পরমানন্দে বাংলা ভাষা অন্যের শব্দ নিজ গোত্রভূক্ত করে নিজ শব্দসম্ভারকে সমৃদ্ধ করেছে। এটা সময়েরও দাবি।
পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী রয়েছে। তাদের রয়েছে নিজস্ব সংস্কৃতি ও ভাষা। তাদের ভাষাকেও বাঁচিয়ে রাখতে হবে। এজন্য তাদের শিশুদেরকে নিজ ভাষা অর্থাৎ মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষা দান করতে হবে। গড়ে তুলতে হবে স্বতন্ত্র ভাষা গবেষণা প্রতিষ্ঠান। সৃষ্টি করতে হবে সৃষ্টিশীল ও মৌলিক সাহিত্যকর্ম। এতে নৃগোষ্ঠীর যেমন ভাষা সমৃদ্ধি আসবে তেমন গতিশীল হবে মূল জাতীয় চেতনা। আসবে বহুর মধ্যে ঐক্য এবং ঐক্যের মধ্যে বৈচিত্র্য। জাতীয় চেতনার ভিত্তি হবে সুদৃঢ়।
ভাষার প্রচার-প্রসারে ও সমৃদ্ধিতে সরকার এবং গণমাধ্যম অবিসংবাদিত ভূমিকা পালন করতে পারে। বিশেষত বাংলা একাডেমী ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ভাষা গবেষণা প্রতিষ্ঠানসমূহ বড় ভূমিকা রাখতে পারে। সেখান থেকে মাতৃভাষার সমস্যা ও সম্ভাবনাগুলো চিহ্নিতকরণের মাধ্যমে ভাষা গবেষণায় গতিশীলতা আনা যেতে পারে। গণমাধ্যমগুলো নিয়মিত ক্রোড়পত্র প্রকাশ ও ভাষা আলোচনার জন্য বিশেষজ্ঞগণের সুচিন্তিত মতামত গ্রহণ করতে পারে। একথা সত্য ভাষার সর্বোচ্চ শ্রীবৃদ্ধি সাধনে সরকার ও গণমাধ্যমই সবচেয়ে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে। আশার কথা, বাংলাদেশের হাইকোর্ট মাতৃভাষাকে বিকৃতভাবে উপস্থাপনকারী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের বিরদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দান করেছে। যা ভাষা ও জাতির জন্য কল্যাণ বহন করে আনবে বলে আমরা বিশ্বাস করি।
লেখক
বিভাগীয় প্রধান, বাংলা
চুয়াডাঙ্গা সরকারি কলেজ ।