জনকল্যাণ সংস্থার নির্বাহী পরিচালকের বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগের প্রেক্ষিতে তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন প্রকাশ
স্টাফ রিপোর্টার: চুয়াডাঙ্গার জনকল্যাণ সংস্থার নির্বাহী পরিচালক নূরুল ইসলামের বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগের প্রেক্ষিতে গঠিত তদন্ত কমিটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। তদন্তে দুর্নীতি ও আর্থিক অনিয়মের প্রমাণ মিলেছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। ১১টি অভিযোগ প্রমাণিত বলে জেলা সমাজসেবা কার্যালয়ের উপপরিচালক (অ.দা.) মো. ছানোয়ার হোসেন স্বাক্ষরিত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
তদন্ত প্রতিবেদন ছাড়াও তদন্ত কমিটি চুয়াডাঙ্গার জনকল্যাণ সংস্থার দুটি ব্যাংক হিসাব স্থগিত রাখার অনুরোধ জানিয়ে পত্র দিয়েছে। ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক লিমিটেড চুয়াডাঙ্গা শাখা ও পূবালী ব্যাংক চুয়াডাঙ্গা শাখা ব্যবস্থাপকদের জনকল্যাণের হিসাব পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত হিসাবের লেনদেন বন্ধ রাখার জন্য অনুরোধ করা হয়েছে। অপরদিকে অভিযোগকারীরা আরো কিছু অনিয়ম ও অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ তুলে বলেছেন, তদন্ত করলে আরো প্রমাণ মিলবে।
জানা গেছে, চুয়াডাঙ্গার জনকল্যাণ সংস্থার নির্বাহী পরিচালকের বিরুদ্ধে অর্থ আত্মসাৎ, নিয়োগে অনিয়মসহ বিভিন্ন অনিয়মের অভিযোগ উত্থাপনের প্রেক্ষিতে তদন্ত কমিটি গঠিত হয়। গত বছরের ২ জুন কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিক্ষোভের মুখে দায়িত্ব হস্তান্তর বা অপসারণেরও ঘটনা ঘটে। পরে অবশ্য স্থানীয় জনপ্রতিনিধির হস্তক্ষেপে সংস্থাটির কার্যক্রম অব্যাহত রাখার স্বার্থে নির্বাহী পরিচালক হিসেবে তিনিই দায়িত্ব পালন করেন। গঠিত তদন্ত কমিটি তদন্তে প্রমাণিত বিভিন্ন দুর্নীতি ও অনিয়সমূহের বর্ণনা দেয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, বিধিবহিভূর্তভাবে নিজ কন্যাকে সংস্থার সহকারী পরিচালক পদে সরাসরি নিয়োগ প্রদান করা হয়েছে। নীতিমালা অনুযায়ী আত্মীয়-স্বজনের নিয়োগ প্রদান থেকে বিরত থাকার কথা। তাছাড়া বহুল প্রচারিত পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি প্রদানের শর্ত নীতিমালায় থাকলেও তা যথাযথভাবে অনুসরণ করা হয়নি। বদলি ও পদোন্নতির ক্ষেত্রেও মানা হয়নি বিধি। বিধি বহির্ভূতভাবেই করা হয়েছে। সংস্থার চাকরি বিধিমালা অনুযায়ী জামানতনামা পরিবর্তন ও নতুন শর্ত আরোপের ক্ষেত্রে সাধারণ পরিষদের সভায় অনুমোদন নেয়া হয়নি। অফিসের মালামাল ও আসবাবপত্র ক্রয়ের ক্ষেত্রে ক্রয় কমিটি গঠন করা থাকলেও ক্রয় কমিটির মাধ্যমে মালামাল ক্রয় করা হয়নি। কোনো সভার সিদ্ধানও নেই। নির্বাহী পরিচালকের আয়কর, পাসপোর্ট তৈরি এবং মোটরসাইকেলের রেজিস্ট্রেশন বাবদ ৯৪ হাজার ২শ টাকা খরচ করা হয়েছে। যা বিধিবহির্ভূত ও অনিয়মতান্ত্রিক। উক্ত অর্থ খরচ সম্পূর্ণ আত্মসাৎ। ইএসপি প্রকল্পের অব্যায়িত ৭৩ হাজার ১৮৬ টাকা এলএলপি খাতের ১৫ হাজার টাকা ও ডিএসএফ খাত থেকে ৩০ হাজার টাকা মোট এক লাখ ১৮ হাজার ১৮৬ টাকা উত্তোলন করা হয়েছে। তার মধ্যে ৭৩ হাজার ১৮৬ টাকা ব্যক্তিগত ব্যাংক হিসাবে জমা রাখা হয়েছে। বাকি খরচের প্রমাণাদি পাওয়া যায়নি। কার্যকরী কমিটির সভা না করে কার্যনির্বাহী কমিটির ঋণ প্রদানও বিধিবহির্ভূত। কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বাসায় আসবাবপত্র ক্রয় এবং নিজে ও স্ত্রীর নামে জমি ক্রয়ের জন্য ২ লাখ ২৫ হাজার টাকা নির্বাহী পরিচালক নীতিমালা ও শর্তাবলী পালন না করে আবেদন এবং প্রয়োজনীয় কাগজপত্র জমা না দিয়ে নিজে শুধুমাত্র শ্লিপের মাধ্যমে গ্রহণ করেছেন। যা আত্মসাতের সামিল। সংস্থার অফিস ব্যবস্থাপনা হিসাবরক্ষণ ও চাকরি বিধিমালা লংঘন করে বিধিবহির্ভূতভাবে ইউসিবি ব্যাংককর্মী জামানত তহবিল থেকে ৩ লাখ ৯ হাজার টাকা উত্তোলন করা হয়েছে। সংস্থার সভাপতিকে সংস্থা থেকে ১৫ হাজার টাকা বেতন প্রদান করা হয়েছে। যা বিধি সম্মত নয়। নীতিমালা অনুযায়ী প্রভিডেন্ট ফান্ড থেকে শুধুমাত্র সংস্থার কর্মকর্তা-কর্মচারীগণকে ঋণ প্রদান করা যায়। ৭ লাখ ৫০ হাজার টাকা বহিরাগতদের ঋণ প্রদান করা হয়েছে। যা নীতিমালা পরিপন্থি ও অর্থ আত্মসাতের সামিল। ব্যাংক থেকে টাকা উত্তোলন করে ফান্ডপ্রাপ্তির জন্য সংশ্লিষ্ট দাতাগোষ্ঠীর অবৈধভাবে টাকা প্রদান ও অন্যান্য কাজে স্পিডমানি ও আনুসাঙ্গিক খরচ নির্বাহের জন্য ১১ লাখ ৬১ হাজার ৬৫৫ টাকা খরচ করা হয়েছে। অথচ ভাউচার বা প্রমাণাদি নেই। এছাড়া দুটি চেকের মাধ্যমে নির্বাহী পরিচালক নূরুল ইসলাম ও কোষাধ্যক্ষ রুহুল আমিনের যৌথ স্বাক্ষরে ৪২ লাখ ৫০ হাজার টাকা উত্তোলন করা হয়েছে। অফিস সংরক্ষিত নথিতে যার কোনো প্রমাণ রাখেনি। এমনকি চেকের মুড়িপাতা পর্যন্ত উধাও করা হয়েছে। উক্ত অর্থ সম্পূর্ণভাবে আত্মসাৎ হিসেবে গণ্য। সংস্থার নামে ক্রয়কৃত জমি থেকে প্রাপ্ত লিজের টাকা ২০০৫ থেকে ২০১২ পর্যন্ত মোট ১৪ হাজার টাকা আদায় হয়েছে। যা নির্বাহী পরিচালকের হাতে। সংস্থার হিসাবে জমা হওয়ার কথা। তা করা হয়নি। ক্রয়ের ক্ষেত্রে ক্রয় কমিটি থাকা সত্ত্বেও ক্রয় কমিটির মাধ্যমে কোনো মালামার ক্রয় করা হয়নি। এমনকি সভা করা হয়নি। বিক্রেতা প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে চেক প্রদান না করে নগদে ৩০ হাজার টাকা প্রদান করেছেন। সফটওয়ার বাবদ ২০ হাজার টাকা খরচ হয়েছে কিন্তু ভাউচার নেই। যা আত্মসাৎ।
তদন্ত প্রতিবেদনে এসব উল্লেখ করে বলা হয়েছে, আত্মসাৎকৃত অর্থের পরিমাণ ৬৮ লাখ ৯৪ হাজার ৮৪১ টাকা। এছাড়াও কিছু অনিয়মের প্রমাণ পাওয়া গেছে বলেও তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছেন জেলা সমাজসেবা কার্যালয়ের উপপরিচালক মো. ছানোয়ার হোসেন। গত ১৭ ফেব্রুয়ারি তদন্ত প্রতিবেদন প্রদানের পাশাপাশি দুটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপককে জনকল্যাণ সংস্থার হিসেবে পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত লেনদেন না করার জন্য অনুরোধ জানিয়েছে তদন্ত কমিটি।