মাথাভাঙ্গা মনিটর: মুম্বাইয়ের ওয়াংখেড়ে স্টেডিয়ামের বড় পর্দা বলছিলো লেজেন্ড নেভার রিটায়ার। সত্যিই কিংবদন্তীর অবসর নেই। কিন্তু যেতে দিতে না চাইলেও তবু যেতে দিতে হয়। ২৪ বছরের বর্ণিল ক্রিকেট-জীবন শচীন টেন্ডুলকার শেষ করলেন বহু মানুষকে কাঁদিয়ে। আবেগ চেপে রাখতে অভ্যস্ত ভারতের ব্যাটিং-কিংবদন্তী নিজেও কান্না চেপে রাখতে পারেননি। মু্ম্বাই টেস্ট শেষ হওয়ার পর শচীন, শচীন চিৎকারে প্রকম্পিত স্টেডিয়ামে সতীর্থদের গার্ড অব অনারের মধ্যদিয়ে মাঠ ছেড়েছেন চোখ মুছতে-মুছতে। সেই গার্ড অব অনার ও ছিলো অভিনব, পিচ থেকে সীমানার দড়ি পর্যন্ত চলমান! এ অতুলনীয় সম্মান নিয়ে সোজা চলে যান ড্রেসিং রুমে। কিছুক্ষণ পর পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানের জন্য মাঠে ফেরেন স্ত্রী অঞ্জলী, মেয়ে সারা ও ছেলে অর্জুনকে সাথে নিয়ে। যে অনুষ্ঠানের সবটুকু আলো ছিলো তাকে ঘিরে। বেশ কিছু স্মারক তুলে দেয়া হয় তার হাতে। অনুষ্ঠানের শেষে ছিলো সবচেয়ে বড় চমক। সঞ্চালক রবি শাস্ত্রী মাইক তুলে দেন টেন্ডুলকারের হাতে। এমনিতে স্বল্পভাষী, লাজুক মানুষটি বিদায়বেলায় খুলে দেন মনের সব অর্গল।
স্টেডিয়ামভরা মানুষের সামনেবক্তব্য রাখতে গিয়ে শচীন, শচীনচিৎকারে আবার আবেগে ভেসে যাচ্ছিলেন ক্রিকেটইতিহাসের সফলতম ব্যাটসম্যান। সবাইকে শান্ত থাকার অনুরোধ জানিয়ে শুরু করেন এক আবেগঘনবক্তৃতা। ‘আমার পক্ষে কথা বলা কঠিন হয়ে যাচ্ছে, তবে নিজেকে সামলে নিচ্ছি। ২২গজের মধ্যে আমার জীবনের ২৪ বছর কেটে গেলো। অসাধারণ এ যাত্রা যে শেষ হচ্ছে তাবিশ্বাস করাই কঠিন।আপনজনদের ধন্যবাদ জানাতে গিয়ে প্রকাশ করলেন ব্যক্তিগত ওপারিবারিক জীবনের কিছু দুর্লভ তথ্য।সবার আগে ধন্যবাদ দিলেন পরলোকগতপিতাকে।‘তার প্রত্যক্ষ অভিভাবকত্ব ছাড়া আমি আজ আপনাদের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতেপারতাম না। তিনি বলতেন, ‘তোমার স্বপ্নকে তাড়া করো, কখনোই হাল ছেড়ো না, তোমার পথ খুবকঠিন হতে পারে।’ আজ আমি তাকে খুব মিস করছি।’ এ প্রথম জগদ্বিখ্যাত ছেলেরখেলা দেখতে স্টেডিয়ামে উপস্থিত টেন্ডুলকারের মা রজনী টেন্ডুলকার। মাকে শ্রদ্ধাজানিয়ে তিনি বলেন, ‘জানি না তিনি কীভাবে আমার মতো একটি অসম্ভব দুষ্টু সন্তানকেমানুষ করেছেন। আমি যেদিন থেকে খেলা শুরু করেছি, সেদিন থেকেই তিনি আমার জন্যপ্রার্থনা করে গেছেন।’ এরপর একে-একে কৃতজ্ঞতা জানান আঙ্কেল, আন্টি, দুভাই নিতিন ও অজিত এবং বোন সবিতাকে।টেন্ডুলকার জানালেন, তার জীবনের প্রথম ব্যাটউপহার পেয়েছিলেন বড় বোন সবিতার কাছ থেকে। তাকে সঠিক পথে চালিত করতে নিজের ক্যারিয়ারবিসর্জন দেয়া মেজ ভাই অজিতের কথা বলতে গিয়ে আরেকবার আবেগপ্রবণ হয়েপড়লেন।১৯৯০ সালের দিকে স্ত্রী অঞ্জলীর সাথে প্রথম পরিচয় টেন্ডুলকারেরভাষায়, ‘আমার জীবনের সবচেয়ে সুন্দর ঘটনা।’ তার পর বললেন, ‘আমি জানতাম একজনডাক্তার হিসেবে তার (অঞ্জলি) সামনে দারুণ এক ক্যারিয়ার পড়ে আছে। কিন্তু সে ভালোভাবেআমার খেলা চালিয়ে যাওয়ার জন্য নিজের ক্যারিয়ার বিসর্জন দেয়। সন্তানদের দেখা-শোনাসহসব দায়িত্ব তুলে নেয়। সে না থাকলে আমি চাপমুক্তভাবে ক্রিকেট খেলে যেতে পারতামনা।’ এ সময় রোদ-চশমায় ঢাকা চোখের জল মুছতে থাকা অঞ্জলীকে লক্ষ্য করেটেন্ডুলকার বললেন, ‘তুমিই আমার জীবনের সেরা পার্টনারশিপ।’ ১৪ বছরের ছেলেঅর্জুন আর ১৬ বছরের মেয়ে সারাকে জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান দুই রত্ন উল্লেখ করেটেন্ডুলকার বলেন, ‘আমি তাদের অনেক জন্মদিন বা ছুটির দিন মিস করেছি। গত ১৪ বা ১৬বছরে আমি তোমাদের সাথে যথেষ্ট সময় কাটাতে পারিনি। কিন্তু আমি প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি, আগামী ১৬ বছর তোমাদের সাথে যতো বেশি সম্ভব থাকার চেষ্টা করবো।’ এরপরশ্বশুর-শাশুড়ী, বন্ধু-বান্ধব, সতীর্থ, ক্রিকেট কর্মকর্তা-প্রশাসক, চিকিৎসক, সংবাদকর্মী এবং সব শেষে ক্রিকেট-গুরু রমাকান্ত আচরেকারকে শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতা জানিয়েপ্রায় ১৫ মিনিটের বক্তব্য শেষ করেন টেন্ডুলকার।