মহাসিন আলী: ‘আমাদের ছোট নদী চলে বাঁকে বাঁকে, বৈশাখ মাসে তার হাটু জল থাকে’। এখন আর হাঁটু জলও থাকে না। মেহেরপুর জেলার একমাত্র নদ ভৈরব। অনেক ঐতিহ্য আর স্মৃতি নিয়ে স্রোতহীন নিথর ভৈরব নদ এখন খাঁ খাঁ করছে পানির অভাবে। এ নদের করুণ পরিণতির কারণে আড়াই’শ প্রজাতির দেশি মাছ এখন হুমকির মুখে। দেশি মাছের স্বাদ থেকে বঞ্চিত হওয়াসহ আমিষের প্রধান উৎস মাছের অভাবে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দিন দিন লোপ পাচ্ছে এলাকার সাধারণ মানুষের। এলাকার মানুষের দীর্ঘদিনের দাবি ভৈরব নদকে পুনঃখনন করার। কিন্তু এলাকাবাসীর এ দাবি দীর্ঘদিনেও পূরণ হলো না।
সওদাগরের তালপুকুর আজ ঘটি ডোবে না। তাতে কী। বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে সবুজের ক্ষেত তো আছে। নদ পাড়ের ৬০ ঊর্ধ্ব নিয়ামত মুন্সির এ আবেগের মর্মকথার সারমর্মে কোনো সরকার মর্মার্থ না হলেও এখন এ বয়সের হাজারো মুন্সি নদপাড়ে বসে ঢেউ গোনার চেষ্টা করেন। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের দেশি মাছের একমাত্র ধারক ও বাহক ছিলো ভৈরব নদ। এর করুণ দশায় দেশি মাছের অনেক মাছ এখন বিলুপ্তির পথে। দুশ প্রজাতির দেশি মাছের স্বাদ পেতে এলাকার মানুষ এখনও নদের কাঁদা হাতড়ে ফেরে। যে সময় এ নদের যৌবন ছিলো তখন এলাকার সাধারণ মানুষের মাছের চাহিদার সবটুকুই পূরণ হতো। এখন মানুষ ধান বিক্রি করে মাছ কিনে খায়। তাও এক মণ ধানে এক কেজি ইলিশ। ‘ভ্যাঁদা মাছে কাঁদা খায়, পুটি মাছে গান গায়, আর টেংরা মাছে সেঁতারা বাজায়’ আঞ্চলিক এ কাব্য কথাটি এলাকার মানুষ আর বলে না। এলাকার মুরুব্বিরা এখনো পালন করে কোথায় বিয়ের লগন নিয়ে গেলে বড় কোনো মাছের সাথে ভ্যাঁদা মাছ নিয়ে যাওয়া। তাদের বিশ্বাস ভ্যাঁদা মাছ খুব সহজসরল মাছ। তাই ভ্যাঁদা মাছ কনের বাড়ি দিলে কনে সহজসরল হবে। ভ্যাঁদা মাছের অভাবে এখন আর কনের বাড়ি ওই মাছ যায় না।
ভৈরব নদের উৎসস্থল ভারতের গঙ্গা নদীর শাখা জলাঙ্গি নদী বাংলাদেশের মেহেরপুর জেলার শুভরাজপুর-কাথুলী সীমান্ত দিয়ে ভৈরব নাম ধারণ করে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। এ নদের প্রবেশ মুখে জলাঙ্গী নদীতে বাঁধ দেয়ায় তার পানি প্রবাহ বন্ধ হয়ে গেছে। ফলে দিনে দিনে ভৈরব নদ তার নাব্যতা হারিয়ে ফেলেছে। এছাড়াও প্রতিনিয়ত পাড়ের মানুষ ইচ্ছে মতো দখল করে নিচ্ছে পাড়। দখলের সীমা এতোটায় ছাড়িয়ে গেছে যে নদের মাঝ দিয়ে পানি প্রবাহের নালাটুকুও বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম। প্রায় ৫০ কিলোমিটার ভৈরব নদের দু পাড়ের প্রায় ২২ হাজার হেক্টর জমি প্রভাবশালীরা দখল নিয়ে মাটি ভরাট করে ধানচাষ করছে। এক সময় এ নদই ছিলো দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ব্যবসায়ীদের যোগাযোগের প্রধান মাধ্যম। বড় বড় বজ্রা নৌকাসহ বিভিন্ন নৌযান চলতো এ নদ দিয়ে। এর সুবাদে জেলার কাথুলী ও শহরের উপকণ্ঠে বন্দরে নৌ-বন্দর স্থাপিত হয়েছিলো। সেই স্মৃতি এলাকার মানুষের মন থেকে দিন দিন মুছে যাচ্ছে। আর ১০ বছর পর আগামী প্রজন্ম বিশ্বাসই করতে চাইবে না যে মেহেরপুরে ভৈরব নদ বলে কোনো নদ ছিলো। ভৈরব নদের এ করুণ দশায় নদ পাড়ের কয়েক হাজার মৎস্যজীবী তাদের পেশা থেকে ছিটকে পড়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন।
ভৈরব নদকে পুনঃখনন ও দখলমুক্ত করতে বিগত সব সরকারই উদ্যোগ নিয়েছে কিন্তু অদ্যবদি এর কোনো বাস্তবায়ন হয়নি। মাপ হয়েছে অনেকবার। পরিকল্পনা করা হয়েছে পুনঃখননের। এ পর্যন্তই শেষ। আশ্বাসের বাণী শুনেই এলাকার মানুষ তৃপ্ত থেকেছে বার বার। কর্তৃপক্ষের অবহেলার সুযোগে ভূমি দস্যুদের দখল প্রতিযোগিতায় ভৈরব নদ সমতল ভূমিতে পরিণত হয়ে যাচ্ছে। জরুরি ভিত্তিতে ভৈরব নদ খনন কিংবা দখলমুক্ত করতে পদক্ষেপ না নিলে আগামী ১০ বছরের মধ্যে নদের কোনো অস্তিত্ব থাকবে না। ভৈরব নদের এ করুণ দশায় একদিকে এলাকার সাধারণ মানুষ যেমন মাছ খাওয়া থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। অন্যদিকে বাঙালি ঐতিহ্যের একটি বিরাট অংশ দেশীয় মাছ বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। শুধু মেহেরপুর জেলাবাসীর দাবি নয়; দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর অনেক দিনের দাবি এ নদ দখলমুক্ত এবং পুনঃখনন করা হোক।