মালয়েশিয়ায় অবৈধ অভিবাসী আটক অভিযান এবং আমরা

মালয়েশিয়ায় অবৈধ অভিবাসী আটক অভিযান জোরদার হওয়ায় আতঙ্কে দিন কাটছে সেখানে বাংলাদেশি অসংখ্য শ্রমিকদের। এদের প্রায় সকলেই ভিটেমাটি কিংবা আবাদি জমি বিক্রির টাকায় সংসারে সুখ আনতে পাড়ি জমিয়েছেন মালয়েশিয়ায়। স্বপ্ন ছিলো- শত কষ্টের বিনিময়ে হলেও বিদেশ থেকে নিয়ে আসবেন একচিলতে সুখ। যারা বৈধভাবে কাজ নিয়ে মালয়েশিয়ায় পাড়ি জমিয়েছে এবং কয়েক মাস আগে বৈধ হওয়ার সুযোগ কাজে লাগিয়েছে তাদের অবশ্য সমস্যা হচ্ছে না, ধরপাকড় করা হচ্ছে তাদেরই যারা অবৈধভাবে অবস্থান করছে। এরকম অবস্থানকারীর সংখ্যা নাকি দু লাখ ৩০ হাজারের মতো। শুধু বাংলাদেশি নয়, প্রতিবেশী কয়েকটি দেশের নাগারিকদেরও ধরপাকড় করা হচ্ছে। অভিযানের প্রথম দিন গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে বাংলাদেশি ছিলো কমপক্ষে ৩৭ জন।

 

পূর্ব-ঘোষণা দিয়েই গত রোববার অবৈধ অভিবাসীদের ধরতে মাঠে নামে মালয়েশীয় সরকার। প্রথম দিনে দেশটির মেলাকা ও সুঙগাই পেতানি এলাকায় সাঁড়াশি অভিযান পরিচালিত হয়। এ সময় উভয় এলাকায় ধরা পড়ে ৫৩৬ জন অবৈধ অভিবাসী। তাদের বেশির ভাগই মালয়েশিয়ার প্রতিবেশী ইন্দোনেশিয়ার নাগরিক হলেও উভয় এলাকা থেকে আটক করা হয় ৩৭ জন বাংলাদেশিকে। এর মধ্যে মেলাকায় আটক হওয়া ৪০৩ জনের মধ্যে বাংলাদেশি ছিলেন ২১ জন আর সুঙগাই পেতানি এলাকায় আটক ১৩০ জন অবৈধ অভিবাসীর মধ্যে বাংলাদেশি ছিলেন ১৬ জন। বাকিদের মধ্যে ২৪৮ জন ইন্দোনেশীয় ছাড়াও মিয়ানমারের ১০০ জন, নেপালি ৬৯ জন, ভারতীয় ১১ জন, পাকিস্তানি চারজন ও ছয়জন ভিয়েতনামি নাগরিক রয়েছেন। এছাড়া দেশটির কামপার এলাকায় আরও ১২ জন এবং জহর বাহারু এলাকায় ১০১ জন অবৈধ অভিবাসী শ্রমিক আটক হয়েছে বলে একাধিক গণমাধ্যম জানিয়েছে। সংবাদসংস্থাগুলো জানায়, কামপার এলাকায় আটক অবৈধ অভিবাসীদের মধ্যে বাংলাদেশি শ্রমিক রয়েছে। এছাড়া অবৈধ শ্রমিকদের লুকিয়ে রেখে কাজ করতে দেয়ার অভিযোগে বেশ কিছু স্থানীয় অধিবাসী ও ব্যবসায়ীকেও আটক করেছে দেশটির পুলিশ। এ ঘটনায় সব অবৈধ শ্রমিকের মধ্যে আতঙ্ক তৈরি হয়েছে। মালয়েশীয় সরকারের এ সাঁড়াশি অভিযানের কারণে আতঙ্কিত সব অবৈধ বাংলাদেশি শ্রমিক। তাদের মধ্যে যারা নিকটজনদের সাথে মোবাইলফোনে যোগাযোগ করেছেন বলেছেন, বিপদে আছি। লুকিয়ে আছি। গ্রেফতারের ভয়ে কর্মস্থলে যেতে পারছি না। কর্মস্থলে যেতে প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা ইতোমধ্যেই বারণ করেছে। এই যখন অবস্থা, তখন আমাদের দেশের প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সচিব জাফর আহামেদ কি বলছেন? মালয়েশিয়ায় যারা অবৈধভাবে বসবাস করছে তাদের বিরুদ্ধে সে দেশের সরকার অভিযান চালাচ্ছে। এ বিষয়ে আমার করার কিছুই নেই। কারণ মালয়েশিয়ান সরকার অবৈধ কর্মীদের বৈধ হওয়ার সুযোগ দিয়েছিলো। কিন্তু সেই সুযোগ অনেকেই নেয়নি। আবার অনেকে ট্যুরিস্ট ভিসায় দালালদের মাধ্যমে সেখানে গেছে। সে দেশের সরকার বাংলাদেশ থেকে বৈধভাবে কর্মী নিচ্ছে। তাই সে দেশে তারা অবৈধকর্মী রাখবে না। আর বাংলাদেশ থেকে দালালদের খপ্পরে কেউ যেন ট্যুরিস্ট ভিসায় মালয়েশিয়ায় না যায়।

 

যারা মালয়েশিয়ায় অবৈধ অভিবাসী হিসেবে এখন চিহ্নিত হচ্ছে তাদের প্রায় সবই বেশির ভাগই ট্যুরিস্ট ভিসায় কিংবা কর্মস্থল পরিবর্তন করেছে। যাদের চোখেমুখে এখন গ্রেফতার আতঙ্ক বিরাজ করছে। গ্রেফতারের পর কি হবে? প্রাথমিকভাবে অভিবাসীদের বৈধ কাগজপত্র উপস্থাপন করতে ১৪ দিন সময় দেয়া হবে। এতে ব্যর্থ হলে তাদের ডিটেনশন সেন্টারে বন্দি রাখা হবে। আর এখানে বন্দি হওয়ার আগ পর্যন্ত তাদের দেশে ফেরত পাঠাতে কোনো সহায়তা করতে পারবে না আটক নাগরিকের নিজ দেশের হাইকমিশন বা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। এরপর? শেষ পর্যন্ত অবশ্য অবৈধ অভিভাবাসীদের দেশে ফেরত পাঠানোরই সিদ্ধান্ত নেয়া হতে পারে। দেশে ফিরে ওরা কি করবে? শূন্য হাতে দেশে ফেরা মানে নতুন সংকটের মধ্যে পড়া। বিষয়টি কোনোভাবেই খাটো করে দেখা যায় না। কারণ ওদের অধিকাংশই সে দেশে গেছে পরিবারে আর্থিক সচ্ছলতা আনার স্বপ্নে সর্বস্ব বিকিয়ে ঋণ গ্রহণ করে। শূন্যহাতে ফিরলে পরিবারের তার অবস্থান কেমন হবে, পাওনাদারারাই কি তাকে ছাড়বে? এ অভিযানের প্রথম ধাপ চলতি বছরের শেষ পর্যন্ত, অর্থাৎ আগামী ডিসেম্বর পর্যন্ত চলবে। পরিত্যক্ত বাড়ি, খামার, বিনোদনকেন্দ্র এবং ম্যাসাজ পার্লারও এ অভিযান থেকে বাদ যাবে না। অভিযানের ধরণ দেখে ধরেই নেয়া যায় অবৈধভাবে এখন আর সেখানে কেউই থাকতে পারবে না। ফলে সরকারিভাবে বিশেষ উদ্যোগ দরকার। যে উদ্যোগ অবৈধ অভিভাসীদের বৈধ করে সেখানে শ্রমিক বিক্রির সুযোগ দেয়। এতে দেশের যেমন কল্যাণ, তেমনই ওদের মধ্যেও ফিরবে স্বস্তি।

 

কোনো দেশেই কাজের অনুমোদনপত্র এবং কাজ করার দক্ষতা অর্জনসহ সেদেশের ভাষা সম্পর্কে ধারণা না নিয়ে ভাগ্যের চাকা ঘোরানোর জন্য ছোটা উচিত নয়। দেশে জনসংখ্যা চক্রবৃদ্ধিহারে বাড়ছে। জনসংখ্যাকে জনশক্তিতে রূপান্তর করার কথাও বলা হচ্ছে। সে পথে হাঁটাও হচ্ছে। কিন্তু সম্ভাববনাময় ওই পথে যে গতিতে হাঁটা দরকার ততোটা গতি নেই। অবশ্য সীমাবদ্ধতার কারণেই উন্নয়নের প্রায় প্রতিটি ধারাতেই প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হচ্ছে। বিদেশে যেভাবে শ্রম বিক্রির জন্য দেশের যুব সমাজ যায়, সেভাবে গেলে দেশের মর্যাদাও হুমকির মুখে পড়ে। দক্ষতা বৃদ্ধির পাশাপাশি ভাষা রপ্ত করিয়ে নির্দিষ্ট কাজের বিপরীতে শ্রমিক পাঠাতে পারলে দেশের মর্যাদা যেমন বৃদ্ধি পাবে তেমনই শ্রমের উপযুক্ত দামও মিলবে। বিষয়টি নিশ্চিত করতে সরকারের বিশেষ উদ্যোগী হতে হবে।