চুয়াডাঙ্গার দোস্তে দরিদ্র্যের কোষাঘাতে জর্জিত এক অসহায় পরিবারে রহস্যজনক মৃত্যু
বেগমপুর প্রতিনিধি : ছোট্ট একটা ব্লেড দিয়ে নিজেকে নিজে জবাই করা যায়? ওভাবে নিজের গলা কেটে আত্মহত্যা করা না গেলেও প্রাথমিকভাবে স্থানীয়রা সেই দাবিই করেছে। গতকার সোমবার সকালে চুয়াডাঙ্গা জেলা সদরের দোস্তগ্রামের ৬৫ বছর বয়সী বৃদ্ধা মরিয়ম খাতুনের রক্তাক্ত লাশ উদ্ধারের পর রহস্য অবশ্য দানা বেঁধে উঠেছে।
পুলিশ অবশ্য মৃত্যুর প্রকৃত নেপথ্য উন্মোচনে প্রাথমিক তদন্ত শুরু করেছে। এরই অংশ হিসেবে জবাই করা বৃদ্ধার মৃতদেহ উদ্ধার করে ময়নাতদন্ত করিয়েছে। গতকাল সোমবার চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালমর্গে ময়নাতন্ত শেষে নিজ গ্রাম জেলা সদরের দোস্তগ্রামে দাফন কাজ সম্পন্ন করা হয়েছে।
পরিবারের সদস্যরা বলেছেন, দরিদ্র্যের কোষাঘাতে মানসিক যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে ব্লেড দিয়ে নিজেকে নিজে জবাই করে আত্মহত্যা করেছে ৬৫ বছরের বৃদ্ধা মরিয়ম খাতুন। তিনি তিন কন্যার জননী। স্বামী আব্দুল জলিলও অসুস্থ। তিন কন্যার মধ্যে স্বামী পরিত্যক্তা এক কন্যা মায়ের বাড়িতেই থাকেন। তিনি মাঠে কাজ করে সামান্য রোজগার করেন। আর বৃদ্ধা মরিয়ম খাতুন কখনো গৃহপরিচারিকা, কখনো ভিক্ষাবৃত্তি করে দু বেলা দুমুঠো খাবারের ব্যবস্থা করতেন। নানা রোগেও আক্রান্ত ছিলেন তিনি। পেটের ভাতই জোটে না যে পরিবারের সদস্যদের, তাদের চিকিৎসা হবে কীভাবে? হয়নি, তাই তো শরীর হাড্ডিসার। তাহলে তাকে খুন করবে কে? কেনই বা করা হবে জবাই? এসব প্রশ্নের সদোত্তর মেলেনি। ভিটেমাটির সামান্য জমি প্রতিবেশীদের মাঝে আলোচনায় উঠে এলেও সেই কারণে কেউ খুন করতে পারে তাও তেমন কেউ প্রাথমিকভাবে বিশ্বাস করতে পারেনি। গতকাল সোমবার নিজের বাড়িতে বৃদ্ধা মরিয়ম খাতুনের রহস্যজনক মৃত্যু হয়। তার গলা কাটা। কার্যত জবাই করা। গতকালই যখন তার লাশ দেখতে পায় প্রতিবেশী এক শিশু, তখনও ঝরছিলো রক্ত। রক্তে ভিজে ছিলো লাশের পাশের মাটি।
স্থানীয়দের মধ্যে অনেকেই ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেছেন, চুয়াডাঙ্গা জেলা সদরের বেগমপুর ইউনিয়নের ভুঞাপাড়ার আব্দুল জলিল দরিদ্র। তার স্ত্রী মরিয়মের কষ্টের শেষ ছিলো না। গতকাল সোমবার সকাল সাড়ে আটটার দিকে এক প্রতিবেশীর সাথে তিনি মনের কিছু কথা বলেন। শারীরিক যন্ত্রণার বিষয়টিও তুলে ধরেন। এর ঘণ্টাখানেকের পর অপর এক প্রতিবেশী বাড়ির বাইরের বাথরুমে দেখেন বৃদ্ধা মরিয়ম খাতুনের রক্তাক্ত লাশ। চিৎকারে লোকজন জড়ো হয়। মরিয়মের বড় মেয়ে আমেনা কাঁদতে কাঁদতে বলেন, আমাদের কোনো ভাই নেই। পিতা অসুস্থ থাকায় মা পরের বাড়িতে কাজ করে সংসারের হাল ধরে। তিন কাঠা ভিটে জমি ছাড়া আর কোন জমি নেই। বর্তমানে মা বাবা অসুস্থ হওয়ায় তাই প্রতিদিনের ন্যায় বাবা মাকে সকালের খাবার খাইয়ে জীবিকার সন্ধানে কাজে বেরিয়ে পড়ি। হঠাত খবর পাই মা মারা গেছে। অপর এক প্রশ্বের জবাবে তিনি বলেন, মা মরিয়ম এজমা রোগী ছিলো। পিতার একার উপার্জনে আমরা তিন বোন খেয়ে না খেয়ে মানুষ হয়েছি। ছোট দু বোন স্বামীর ঘরে চলে গেলেও পিতা-মাতার কারণে পরের ছেলে আমাকে ছেড়ে চলে গেছে। কারণ আমার উপার্জনে সংসার চলে। খাবারের পাশাপাশি মায়ের চিকিৎসার ওষুধ কিনতে হয়। গত ৪ মাস থেকে মা স্বাভাবিকভাবে খাওয়া-দাওয়া ছেড়ে দেয়। তবে ওষুধটা ঠিক মতোই খেতো। এরই মাঝে মায়ের মৃত্যু হলো। তাও আবার গলা কেটে। ওভাবে ব্লেড দিয়ে গলা কেটে মরা যায় কি-না জানিনে।
স্ত্রীর মৃত্যুতে স্বামী আব্দুল জালাল (৭০) শিশুর মত কাঁদছিলেন। তিনি তেমন কোনো মন্তব্য করেননি। প্রতিবেশীরা জানান, কষ্ট কাকে বলে জালালের পরিবারকে না দেখলে বোঝা যাবে না। এ বয়সে বাড়তি খাবারের জন্য ভিক্ষাও করছেন জালাল। এদিকে দুপুর দুটার দিকে খবর পেয়ে চুয়াডাঙ্গা সদর থানা পুলিশ লাশের ময়না তদন্তের জন্য মরিয়মের লাশ নেয়া হয় চুয়াডাঙ্গা হাসপাতালমর্গে। বিকেলে সম্পন্ন হয় ময়নাতদন্ত। রাত ১০টার দিকে মরিয়মের দফন সম্পন্ন করা হয়। সদর থানার ওসি ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন।
পুলিশ বলেছে, মৃত্যুটি রহস্যজনক। ব্লেড দিয়ে গলা কেটে আত্মহত্যা করা হয়েছে বলে দাবি করা হলেও মৃত্যুর নেপথ্য উন্মোচনে লাশ ময়নাতদন্ত করা হয়েছে। থানায় অপমৃত্যু মামলা রুজু করা হয়েছে। ময়ানতদন্ত প্রতিবেদন হাতে পাওয়ার পর পরবর্তি পদক্ষেপ নেয়া হবে।