আলমডাঙ্গায় কবিরাজের ভণ্ডামিতে ঝরলো কৃষকের প্রাণ

মেহেরপুরের আমঝুপিতে ও চুয়াডাঙ্গার আলডাঙ্গায় সর্প দংশনে দু নারীসহ তিনজনের মৃত্যু

 

 

অনিক সাইফুল/নূর আলী মোল্লা: ভণ্ড কবিরাজের অপচিকিৎসা থেমে নেই। ভণ্ড কবিরাজদের ভণ্ডামিতে অকালে ঝরে গেলো আলমডাঙ্গার দরিদ্র কৃষক মকলেচের তরতাজা প্রাণ এবং পাইকপাড়ার গৃহবধূ খালেদা খাতুন। এছাড়া সর্প দংশনে মারা গেছেন মেহেরপুরের আমঝুপি ময়ামারী গ্রামের গৃহবধূ নতিজান। আলমডাঙ্গার জেহালা ইউনিয়নের কৃষ্ণপুর গ্রামের দরিদ্র কৃষক মকলেচুর রহমানের সর্প দংশনে মৃত্যু হয়েছে। রাত ১১টার দিকে সাপে দংশন করে। সারারাত গ্রামের এক ভণ্ড কবিরাজের ঝাঁড়ফুঁকের পর রোগী নেতিয়ে পড়লে ভোরে নেয়া হয় চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালে। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করলে তাকে নেয়া হয় বাড়িতে। সেখানেও জীবননগর থেকে কবিরাজ এসে বলে মকলেচ বেঁচে আছে। আবারো ঘণ্টাব্যাপি ঝাঁড়ফুঁক করে বলা হয় বেঁচে আছে। অটোযোগে লাশ নেয়া হয় আলমডাঙ্গার পাঁচলিয়া গ্রামে হাটপাড়ার কথিত কবিরাজ বাসুদেবের বাড়িতে। সেখানে ঝাঁড়ফুঁক আর কাটাছেঁড়ার পর লাশ বাড়িতে নিয়ে বিকেলে দাফন কাজ সম্পন্ন করা হয়।

জানা গেছে, আলমডাঙ্গার জেহালা ইউনিয়নের কৃষ্ণপুর গ্রামের বুদো মণ্ডলের ছেলে দু সন্তানের জনক মকলেচকে (৩০) গত পরশু মঙ্গলবার রাত ১১টার দিকে ঘরে ঘুমিয়ে ছিলো। এ সময় তাকে সাপে কামড় দেয়। ডাকা হয় একই গ্রামের রিয়াজের ছেলে কবিরাজ ইয়াছিনকে। সারারাত ধরে ঝাঁড়ফুঁক আর কাটাছেঁড়া ও অপচিকিৎসার পর ভোর সাড়ে ৪টার দিকে রোগী নেতিয়ে পড়ে। অবস্থা বেগতিক দেখে সটকে পড়ে ইয়াছিন কবিরাজ। মকলেচের শোয়ার ঘর খুঁজে পাওয়া যায় বিষধর ডোরাকাটা লাউডগা সাপ। সাপটিকে ধরে ভাঁড়ে বন্দি করা হয়। রোগী নেয়া হয় চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালে। কর্তব্যরত সেবিকা মোসা. ফরিদা খাতুন জানান, রোগী যখন হাসপাতালে ভর্তি হয় তখনই সে নেতিয়ে পড়েছিলো। তাও তাকে এন্টিস্নেক ভেনম দেয়া হয়। তিনি জানান, মানুষকে এত সচেতন করার পরেও সাপে কাটা রোগীকে হাসপাতালে না নিয়ে কবিরাজের কাছে নেয়া হয়। যখন মুমূর্ষু অবস্থায় দাঁড়ায় তখন হাসপাতালে নেয়া হয়; কিন্তু তখন আর কিছুই করার থাকে না।

ভোর ৬টায় হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মকলেচের মৃত্যু হয়। লাশ নেয়া হয় নিজ গ্রাম কৃষ্ণপুরে। জীবননগর উপজেলার মাধবখালী গ্রাম থেকে আসেন মৃত তাহের আলীর ছেলে কবিরাজ আশরাফ আলী। তিনি প্রচার করতে থাকেন রোগী বেঁচে আছে। ঘণ্টাব্যাপি করা হয় ঝাঁড়ফুঁক। অবশেষে কবিরাজ আশরাফ জানান, অনেক দেরি হয়ে গেছে। আগে আমাকে জানালে আমি ধাওয়া মেরে সাপের বিষ গাছের মাথায় বেঁধে দিতাম। এখন আর কিছু করার নেই। এরপর মকলেচের পরিবারের লোকজন মোটরসাইকেলযোগে আলমডাঙ্গার পাঁচলিয়া গ্রামের হাটপাড়ার কবিরাজ বাসুদেবের বাড়িতে যায়। কবিরাজ হাত চালান দিয়ে জানান, বেঁচে আছে। রোগী আর রোগীর সাথে দুজন লোক ছাড়া কেউ যেন না আসে। এমনই সতর্কবাণী দেন কবিরাজ। এরপর লাশ নিয়ে যাওয়া হয় আলমডাঙ্গার জামজামি ইউনিয়নের পাঁচলিয়া গ্রামের হাটপাড়ার কথিত কবিরাজ বাসুদেবের বাড়ি। সেখানে কয়েক ঘণ্টা ঝাঁড়ফুঁকের পর তাকে মৃত বলে ঘোষণা করেন কবিরাজ।

গ্রামবাসী জানায়, রাতেই যদি মকলেচকে হাসপাতালে নেয়া হতো তাহলে সে মারা যেতো না। ভণ্ড কবিরাজের অপচিকিৎসার কারণে তার মৃত্যু হয়েছে। কবিরাজ যদি চিকিৎসা করতে পারতো তবে কেন এতো টাকা পয়সা খরচ করে মানুষ ডাক্তারি পড়ে। পাড়া গ্রামের কোনো কবিরাজের কাছ থেকে কবিরাজি শিখলেইতো চলে যেতো। গ্রামবাসী আরো জানায়, মৃত মকলেচের রয়েছে মেয়ে মোহনা (১০) ছেলে সাধন (৫) স্বামীকে হারিয়ে মকলেচের স্ত্রী শিল্পী এখন দিশেহারা হয়ে পড়েছে। কোনোভাবেই তাকে সান্ত্বনা দেয়া যাচ্ছে না। মকলেচের মা ও স্ত্রীর কান্নায় এলাকার বাতাস ভারী হয়ে ওঠে। গতকাল বিকেল ৩টায় মকলেচের লাশ গ্রামের কবরস্থানে দাফন করা হয়েছে।

ঘোলদাড়ি প্রতিনিধি জাহাঙ্গীর আলম জানিয়েছে, আলমডাঙ্গার পাইকপাড়া গ্রামের গৃহবধূ দু সন্তানের জননী খালেদা খাতুনের করুণ মৃত্যু হয়েছে। গত পরশু মঙ্গলবার সকালে সর্প দংশনের শিকার হন তিনি। পরে পার্শ্ববর্তী গ্রামে ওঝার নিকট নিলে ঝাঁড়ফুঁকের এক পর্যায়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন খালেদা খাতুন।

জানা গেছে, চুয়াডাঙ্গা আলমডাঙ্গা উপজেলা আইলহাস ইউনিয়নের পাইকপাড়া গ্রামের ইউসুফ আলীর স্ত্রী খালেদা খাতুন (৪৫) সকালে ঘুম থেকে উঠে নিজ ঘরের পেছনে ইঁদুরের গর্ত বন্ধ করতে যান। এ সময় বিষধর সাপ তাকে দংশন করে। পরিবারের লোকজন খালেদা খাতুনকে পার্শ্ববর্তী শিশিরদাড়ি গ্রামের কথিত ওঝার নিকট  নেয়া হলে ঝাঁড়ফুঁকের এক পর্যায়ে মারা যান। নেয়া হয় নিজ গ্রামে। দুপুরে গ্রাম্য কবরস্থানে তার লাশ দাফন সম্পন্ন করা হয়।

আমঝুপি প্রতিনিধি সাদ আহাম্মদ জানিয়েছেন, মেহেরপুর সদর উপজেলার আমঝুপি ইউনিয়নের ময়ামারী গ্রামে বিষধর সাপের দংশনে এক সন্তানের জননী নতিজান মারা গেছেন।

এলাকাসূত্রে জানা যায়, ময়ামারী গ্রামের মৃত দুখু মণ্ডলের স্ত্রী ১ সন্তানের জননী নতিজান (৩৮) রাতে ঘরে ঘুমিয়ে ছিলেন। মাটির দেয়াল বেয়ে একটি বিষধর সাপ তার পায়ে দংশন করে। ঘুম থেকে জেগে বিষয়টি পরিবারের লোকজনকে জানালে এলাকার কবিরাজের সহায়তা নেন। পর্যায়েক্রমে তার অবস্থার অবনতি হলে গত মঙ্গলবার রাতে মেহেরপুর জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এক পর্যায়ে  গতকাল ভোরে তিনি মারা যান।