কলাসহ শাকসবজি বিষমুক্ত করার উদ্যোগ সফল হোক

অধিক ফলনের আশায় কৃষকদের অনেকেই যেমন মাত্রারিক্ত সার প্রয়োগ করে বিপাকে পড়েন, তেমনই অনেকেই মাত্রারিক্ত কীটনাশক প্রয়োগ করে পরিবেশের ভয়াবহ ক্ষতি ডেকে আনেন। শুধু তাই নয়, কীটনাশক প্রয়োগের পর নিয়ম না মেনেই ক্ষেত থেকে শাকসবজি তুলে বাজারে বিক্রি করেন। ভোক্তা সাধারণ তা খেয়ে জটিল রোগে আক্রান্ত হন। কেউ কেউ হারান প্রাণ, অধিকাংশকেই চিকিৎসার খরচ জোগাতে গিয়ে সর্বস্বান্ত হন। সমাজের চরম এ বাস্তবতা উপলব্ধি করে প্রশাসন সচেতনতা সৃষ্টির পাশাপাশি আইন প্রয়োগেরও বিশেষ উদ্যোগ নিয়েছে।

আম-লিচুসহ মরসুমি সকল প্রকারের ফলফলারি মানব শরীরের জন্য খুবই উপকারী। কালক্রমে এ মরসুমি উপকারী ফলও স্বাস্থ্যের জন্য ভয়ানক ঝুঁকিপূর্ণ করে তোলেন কিছু অসাধু বাগানমালিক ও ব্যবসায়ী। পুষ্ট হওয়ার আগেই গাছ থেকে পেড়ে রাসায়নিক পদার্থ প্রয়োগে যেমন পাকানো হয়, তেমনই মাত্রারিক্ত কীটনাশক প্রয়োগের মাধ্যমে তা খাবার অনুপযোগী করে ফেলা হয়। এবারও লিচু খেয়ে রংপুর এলাকার বহু শিশুর মৃত্যু হয়েছে। যদিও চুয়াডাঙ্গা-মেহেরপুরসহ খুলনা বিভাগের ১০টি জেলায় প্রশাসনিক বাড়তি তৎপরতায় আম এবার বিগত বছরগুলোর তুলনায় অনেকটাই নিরাপদ ছিলো। তারই ধারাবাহিকতায় কলাসহ শাকসবজি বিষমুক্ত করতে প্রশাসন বিশেষ উদ্যোগ নিয়েছে বলে পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। প্রশাসনিক তৎপরতার পাশাপাশি কৃষি সম্প্রসারণের কর্তব্যরত মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের আন্তরিকতা থাকলে এ উদ্যোগ সফল হতে বাধ্য।

মাত্রারিক্ত রাসায়নিক সার জমিতে প্রয়োগে যতোটা না ফলন পাওয়া যায়, তার চেয়ে অধিক ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। নানাভাবেই এটা পরীক্ষিত। সচেতনতার অভাবেই যে, বহু চাষি তাদের জমিতে অধিক পরিমাণের রাসায়নিক সার প্রয়োগ করেন, তা বলাই বাহুল্য। কেননা, আমাদের দেশ কৃষি প্রধান হলেও কৃষকদের সিংহভাগই বংশ পরম্পরায় দেখেই চাষাবাদ করে আসছেন। এ বিষয়ে যেমন দরকার সচেতনতা, তেমনই দরকার কীটনাশক প্রয়োগে লাভ-ক্ষতির বিষয়ে সচেতন করে তাদেরকে দায়িত্বশীল করে তোলা। অবশ্য মাত্রারিক্ত কীটনাশক প্রয়োগের আড়ালে বাজারের ভেজাল কীটনাশকও বহুলাংশে দায়ী। কৃষকদের অনেকেই এ বিষয়ে বলে থাকেন, বাজার থেকে বোতল বোতল কীটনাশক নিয়ে ক্ষেতে দেয়ার পরও তেমন কাজ হয় না বলেই তো অতিরিক্ত প্রয়োগ করতে হয়।

ভেজাল কীটনাশক প্রয়োগের পর যখন ভালো কীটনাশক মাত্রারিক্ত প্রয়োগ করেন তখন পরিবেশের ভয়াবহ ক্ষতি হয়। মারা যায় উপকারী কীটপতঙ্গ। তার কুফলও চাষাবাদে পড়ে। তা ছাড়া কীটনাশক প্রয়োগে উপকারী শাকসবজি, ফলফলারি মানবদেহের জন্য ভয়ানক ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়ে। কীটনাশকের কারণে মাঠের পাখপাখালি দ্রুত বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। পাখি না থাকলে ক্ষতিকর কীট মারতে কীটনাশকের ওপরই নির্ভরশীল হতে হয় কৃষকদের। আর আলোকফাঁদ? এ সম্পর্কেও ক’জন কৃষককে সচেতন করা সম্ভব হয়েছে? বাজারে কীটনাশকমুক্ত শাকসবজি খোঁজেন সচেতন ভোক্তা সাধারণ। বাজারে শনাক্তকরণের ব্যবস্থা নেই। কীটনাশক দেয়া এবং কীটনাশক না দেয়া শাকসবজি যখন একই সারিতে সমান দরে বিকোয়, তখন উৎপাদকরা কেন একটু বাড়তি ফলনের আশায় মাত্রারিক্ত কীটনাশক প্রয়োগ করবেন না?

মরসুমি ফল আগেভাগে পেড়ে কৃত্রিম উপায়ে পাকিয়ে বাজারে নেয়ার কারণ বাড়তি আয়। কেননা, ফল যখন প্রাকৃতিক নিয়মে পুষ্ট হয়, পাকে তখন সব বাগানেই পাকে। সব বাগানমালিকই যখন তাদের বাগানের ফল বাজারে নেন, তখন দেখা যায় চাহিদার চেয়ে আমদানি বেশি। পচে নষ্ট হয়। এ কারণেই আগাম পাকানোর দিকে ঝুঁকে মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ করে তোলেন। যদি সংরক্ষণের ব্যবস্থা তথা কোল্ডস্টোরেজ গড়ে তোলা সম্ভব হয় তাহলে কৃত্রিম উপায়ে ফল পাকানোর প্রবণতা হ্রাস পেতে বাধ্য। তা ছাড়া লিচুগাছে ভয়ঙ্কর বিষ প্রয়োগ? তাতেও সমস্যা। আড়ালে অসচেতনতা। গাছের যত্নের বদলে ফলের দিকেই অধিক নজরের প্রবণতা ক্ষতির কারণ। লিচুতে পোকা হয়। কখন? যখন গাছের প্রতিরোধ ক্ষমতা থাকে না। আর সঠিক সময়ের মধ্যে লিচু পেড়ে নিলে পোকা হওয়ার সুযোগ থাকে না। দুটোতেই সমস্যা। গাছের যত্নে আগাম প্রস্তুতিতে যথেষ্ট ঘাটতি। বাজার পাওয়ার আশায় যথাসময়ে লিচু না পাড়াও অতিরিক্ত পোকা দেখা দেয়ার অন্যতম কারণ।

বাজারে ফলফলারি, শাকসবজি বিপণন কেন্দ্রগুলোতে কীটনাশক পরীক্ষার পর্যাপ্ত ব্যবস্থা করা দরকার। ভোক্তারা জেনেশুনে নিশ্চয় বিষযুক্ত ফল, শাকসবজি কিনবেন না। এটা নিশ্চিত করতে পারলে উৎপাদকদের মধ্যেও দায়িত্ববোধ সৃষ্টি হবে। তার আগে দরকার কৃষি প্রধান দেশে কৃষকদের সচেতন করতে পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণসহ কৃষি উপকরণসমূহ ভেজালমুক্ত করা। সারে ভেজাল, বীজে ভেজাল, ভেজাল কীটনাশকেও। ভেজালের মহোৎসবে ফলফলারি, শাকসবজি স্বাস্থ্যকর থাকে কীভাবে? কলাসহ শাকসবজি বিষমুক্ত করতে প্রশাসনের বিশেষ উদ্যোগ সফল হোক।