বর্ষণে ধসে পড়া মাটির দেয়াল চাপা পড়ে চুয়াডাঙ্গায় নারীসহ দুজনের মৃত্যু

সুমি বায়ু আর লঘুচাপের প্রভাবে সারাদেশে লাগাতার বৃষ্টি : খুলনা ও সাতক্ষীরায় একদিনেই রেকর্ড ১৩৯ মিলিমিটার

 

DSC09448

স্টাফ রিপোর্টার: লাগাতার বৃষ্টিতে মাটির দেয়াল ধসে চুয়াডাঙ্গা সদর ও আলমডাঙ্গায় দুজনের মর্মান্তিক মৃত্যু হয়েছে। গতকাল শুক্রবার পৃথক সময়ে এক নারীসহ দুজনের মৃত্যু হয়। চুয়াডাঙ্গা তিতুদহ বলদিয়ার এক বৃদ্ধা দেয়াল চাপায় গুরুতর জখম হয়েছে বলে তার পরিবারের সদস্যরা জানিয়েছেন। মরসুমি বায়ু ও বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট লঘুচাপের প্রভাবে চুয়াডাঙ্গা-মেহেরপুরসহ সারাদেশেই গত কয়েকদিন ধরে লাগাতার বৃষ্টি হচ্ছে। ভারী বর্ষরণ কুষ্টিয়া শহর যেমন জলমগ্ন হয়ে পড়েছে, তেমনই রাজধানী ঢাকাতেও জলাবদ্ধতার কারণে অবর্ণনীয় দুর্ভোগের খবর পাওয়া গেছে। এদিকে দামুড়হুদার নাপিতখালী-বদনপুর সড়কের করুণ দশা ফুটে উঠেছে। এ সড়কের একটি স্থান ধসে পড়ে বৈদ্যুতিক খুঁটি নুয়ে পড়ে গাছে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে।

চুয়াডাঙ্গায় গতকাল শুক্রবার সন্ধ্যা পর্যন্ত ৯৬ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করে আবহওয়া অধিদফতর। দেশের সর্বাধিক বৃষ্টি ছিলো সাতক্ষীরা ও খুলানায়। ও দুটি স্থানে গতকাল ১৩৯ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। যশোরেও ভারী বর্ষণ হয়েছে। যশোরে ১৩৮ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। লাগাতার বৃষ্টিতে মাটির দেয়ালের পোতা রসে ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে বহু মাটির ঘর। গতকাল চুয়াডাঙ্গা জেলা সদরের পদ্মবিলা ইউনিয়নের সুবদিয়ার মসলেম উদ্দীনের স্ত্রী শাহারণ বেগম (৫০) মাটির দেয়াল চাপা পড়ে নিহত হয়েছেন। পরিবারের সদস্যরা বলেছ্নে, গতকাল শুক্রবার সকাল আনুমানিক ১০টার দিকে বাড়ির মাটির দেয়ালের রান্নাঘরে বসে রান্নার কাজ করছিলেন শাহারণ। এ সময় মাটির দেয়াল ধসে পড়ে। চাপা পড়ে গুরুতর আহত হন। তাকে উদ্ধার করে চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালে নিয়ে ভর্তি করা হয়। অবস্থার কিছুটা উন্নতি হলে দুপুর ১২টার দিকে বাড়ি নেয়া হয়। বিকেলে আবারও অবস্থা গুরুতর হয়ে উঠলে হাসপাতালে নেয়া হয়। কর্তব্যরত চিকিৎসক ডা. এনামুল কবির তাকে মৃত ঘোষণা করেন। এছাড়া চুয়াডাঙ্গা জেলা সদরের তিতুদহ বলদিয়ার মৃত সৈয়দ মণ্ডলের স্ত্রী জরিনা বেগম (৭০) দেয়াল চাপা পড়ে আহত হয়েছেন বলে জানিয়েছেন তার পরিবারের সদস্যরা। গতকাল সন্ধ্যায় দেয়াল চাপা পড়ার ঘটনা ঘটে। উদ্ধার করে নেয়া হয় চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালে। অবস্থা আশঙ্কাজনক হওয়ায় তাকে রাজশাহী নেয়া হয়েছে। তবে মাথায় আঘাতের কারণে দেয়াল চাপা পড়ার বিষয়টি নিয়ে সন্দেহ দানা বেধেছে। ১০ সন্তানের জননী জরিনা বেগমকে হাসপাতালে নেয়ার পর যখনই জ্ঞান ফিরেছে তখনই ভাত চেয়ে বলেছেন, খিদে লেগেছে ভাত দে। এ উক্তি শুনে অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন কোথায় কীভাবে দেয়াল চাপা পড়লো? বৃদ্ধার শয্যাপাশে থাকা তার এক ছেলে বলেন, রান্নাঘরে ছিলো। সেখানেই দেয়াল চাপা পড়েছে। অপর একসূত্র বলেছে, ছেলেরা পাকা ঘরে থাকলেও মা কেন রান্নাঘরে? এ প্রশ্নের জবাব খুঁজলে অনেক তথ্যই বেরিয়ে আসবে।

আলমডাঙ্গা ব্যুরো জানিয়েছে, লাগাতার বর্ষণে ঘরের দেয়াল ধসে চাপা পড়ে নির্মম মৃত্যু হয়েছে আলমডাঙ্গার নওদা বণ্ডবিল গ্রামের বয়োবৃদ্ধ দিনমজুর নবিসদ্দীন ওরফে নবুর। গতকাল সকাল ১০টার দিকে মুষলধারে বৃষ্টির মধ্যে ঘরের ফাটা দেয়ালে ঠেকনা দেয়ার সময় এ দুর্ঘটনা ঘটে। বেশ কয়েক দিন ধরে লাগাতার বৃষ্টির কারণে আলমডাঙ্গা পৌরসভাধীন নওদা বণ্ডবিল গ্রামের মৃত দানেশ মণ্ডলের ছেলে দরিদ্র দিনমজুর নবিসদ্দীন নবুর (৭০) কাঁচা ঘরের দেয়ালে ফাটল ধরে। গতকাল শুক্রবার সকাল ১০টার দিকে যখন মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছিলো, সে সময় তিনি ফাটা দেয়ালে মই লাগিয়ে দেয়ালে ঠেকনা লাগানোর চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু বিধিবাম! মাথার ওপর থেকে দেয়াল ধসে চাপা পড়ে ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হয় হতভাগ্য বয়বৃদ্ধ দিনমজুর নবুর। সহায় সম্বলহীন নবু ছিলেন ২ কন্যা ও ১ বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী ছেলের জনক। মেয়ে ২টি বিবাহিত হলেও একমাত্র ছেলে বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী হওয়ায় বয়োবৃদ্ধ নবুর উপার্জনেই চলতো পরিবার। নবুর মর্মান্তিক মৃত্যুতে পরিবারে নেমে এসেছে ভয়াল দুর্যোগ। গতকাল বাদ জোহর জানাজা শেষে গ্রামের গোরস্তানে তার লাশ দাফন করা হয়েছে।

দামুড়হুদা প্রতিনিধি জানিয়েছেন, দামুড়হুদায় একটানা বৃষ্টির ফলে উপজেলার অধিকাংশ সড়কই চলাচলের অযোগ্য হয়ে পড়ায় জনদুর্ভোগ দেখা দিয়েছে। বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে এক গ্রামের সাথে আরেক গ্রামের যোগাযোগ। ফলে ঈদে ঘরমুখো মানুষজনকে অনেক কষ্টে পৌঁছুতে হচ্ছে নিজ বাড়িতে। পিচরোডের পাশে মাটি না থাকায় এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।

জানা গেছে, দামুড়হুদা সদর ইউনিয়নের নাপিতখালী গ্রামের রেজাউলের বাড়ির কাছে প্রায় ২০ ফুট পিচরোড গত বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে ১১টার দিকে প্রবল বর্ষণের সময় ভেঙে পার্শ্ববর্তী গর্তে বিলীন হয়ে যায়। পিচরোড ভেঙে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে নাপিতখালী-বদনপুর গ্রামের সাথে পার্শ্ববর্তী পাটাচোরা গ্রামের। ভাঙা স্থানে থাকা পল্লি বিদ্যুতের একটি পোলও পড়ে যায়। বিদ্যুতের পোল পড়ে সড়কের পাশের দুটি গাছে আগুন ধরে যায়। বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় বিদ্যুত ব্যবস্থা। গ্রামবাসী টের পেয়ে তড়িঘড়ি আগুন নিভিয়ে ফেলে। ফলে বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতির হাত থেকে এ যাত্রায় রক্ষা পায় গ্রামবাসী। গতকাল বেলা সাড়ে ১১টার দিকে পল্লি বিদ্যুতের লোকজন গিয়ে ওই পোলটি পুনরায় অন্যস্থানে পুঁতে বিদ্যুত সংযোগ দেন। খবর পেয়ে দামুড়হুদা সদর ইউপি চেয়ারম্যান প্রভাষক শরীফুল আলম মিল্টন ইউপি সদস্য রাশেদুল ইসলামকে সাথে নিয়ে গতকাল দুপুরে ছুটে যান ঘটনাস্থলে। এ সময় তিনি গ্রামবাসীকে আশ্বস্ত করে বলেন, রাস্তাটি চলাচলের উপযোগী করতে আজই প্রাথমিক পদক্ষেপ নেয়া হবে। এদিকে উপজেলার কুড়ুলগাছি ইউনিয়নের সদাবরী-দূর্গাপুর সড়কের একমাত্র কালভার্ট গত বৃহস্পতিবার রাতে অতি বর্ষণের কারণে ভেঙে গেছে। ফলে সদাবরী, দূর্গাপুরসহ পাশবর্তী বুইচিতলা, নুতনগ্রাম, ফুলবাড়িসহ বেশ কয়েকটি গ্রামের লোকজনের কার্পাসডাঙ্গার সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে।

সদাবরী গ্রামের আওয়ামী লীগ নেতা সরোয়ার হোসেন জানান, ওই কালভার্টটি ভেঙে যাওয়ায় সদাবরী, দূর্গাপুরসহ পাশবর্তী বুইচিতলা, নুতনগ্রাম, ফুলবাড়ি, বড়বলদিয়া গ্রামের মানুষ ঈদের কেনাকাটা করতে কার্পাসডাঙ্গায় যেতে পারছে না। তাদের মদনা এবং ঠাকুরপুর ঘুরে কার্পাসডাঙ্গায় যেতে হচ্ছে। ভেঙে যাওয়া সড়ক ও কালভার্টটি জরুরি ভিত্তিতে মেরামত পূর্বক চলাচলের উপযোগী করতে উপজেলা প্রকৌশলী, উপজেলা নির্বাহী অফিসার এবং চুয়াডাঙ্গা-২ আসনের এমপির সার্বিক সহযোগিতা কামনা করেছে এলাকার ভুক্তভোগী জনসাধারণ।

আবহওয়া অধিদফতর জানিয়েছে, গাঙ্গেয় পশ্চিম বঙ্গ ও তৎসংলগ্ন এলাকায় অবস্থানরত লঘুচাপটি ঘনীভূত হয়ে স্থল নিম্নচাপ হিসেবে বিহার ও তৎসংলগ্ন এলাকায় অবস্থান করছে। মরসুমি বায়ুর অক্ষ রাজস্থান, উত্তর প্রদেশ, মধ্য প্রদেশ, নিম্নচাপের কেন্দ্রস্থল ও বাংলাদেশের মধ্যাঞ্চল হয়ে উত্তর-পূর্ব দিকে আসাম পর্যন্ত বিস্তৃত। এর একটির বর্ধিতাংশ উত্তর-পশ্চিম বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত বিস্তৃত। মরসুমি বায়ু বাংলাদেশের ওপর সক্রিয় এবং উত্তর বঙ্গোপসাগরের অন্যত্র প্রবল অবস্থায় রয়েছে। ফলে ঢাকা, রাজশাহী, রংপুর, খুলনা ও বরিশাল বিভাগের অধিকাংশ জায়গায় এবং চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের অনেক জায়গায় অস্থায়ী দমকা/ঝড়ো হাওয়াসহ হালকা থেকে মাঝারি ধরনের বৃষ্টি অথবা বজ্রসহ বৃষ্টি হতে পারে। সেই সাথে দেশের কোথাও কোথাও মাঝারি ধরনের ভারী থেকে অতি ভারী বর্ষণ হতে পারে। সারাদেশের দিনের এবং রাতের তাপমাত্রা ১-২ ডিগ্রি সে. বৃদ্ধি পেতে পারে।

কুষ্টিয়া প্রতিনিধি জানিয়েছেন, ভারী বর্ষণে কুষ্টিয়া পৌর এলাকা ও শহরতলীর প্রায় সকল অঞ্চল ভয়াবহ জলবদ্ধতার শিকার হয়েছে। অচল হয়ে পড়েছে কুষ্টিয়া শহর। শহরের প্রায় সকল রাস্তা, হাট, বাজার তলিয়ে গেছে পানির নিচে। অসংখ্য ঘরবাড়ির মধ্যে পানি প্রবেশের ফলে দুর্বিষহ জীবনযাপন করছে অনেকেই। শিশু ও পশুপাখি নিয়ে বিপাকে পড়েছে জলাবদ্ধ এলাকার মানুষ। বিশেষ করে শুক্রবারের এ ভারী বর্ষণে শহরের কোর্টপাড়া, আড়ুয়াপাড়া, থানাপাড়া, আমলাপাড়া, মিলপাড়া, কমলাপুর, হরিশংকরপুর, হাউজিং, চৌড়হাস ও মজমপুরসহ বিভিন্ন এলাকা ব্যাপক জলাবদ্ধতার শিকার হয়েছে।

আলমডাঙ্গা জামজামি প্রতিনিধি জানিয়েছেন, জামজামি ইউনিয়নের নিম্নাঞ্চল ঘোষবিলা মধুপুর বাণিনাথপুর পাঁচলিয়া শ্রীনগর ভারী বর্ষণে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়েছে। জলমগ্ন হয়ে পড়েছে শীত মরসুমে রোপণের জন্য প্রস্তুতকৃত জমি। ধানের পাতু। নদ-নদী, খাল বিল ভরাট করার কারণে মাঠের পানি নিষ্কাশন না হওয়ায় ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। বেশ কিছু পুকুরে পানি ছাপিয়ে মাছ বের হয়ে যাওয়ারও খবর পাওয়া গেছে। দৃশ্য দেখে মাছচাষিদের মাথায় হাত উঠেছে। ভারী বৃষ্টির কারণে গাছপালা উপড়ে ১১০০০ কেভি বিদ্যুত লাইনে বিপর্যয় দেখা দিয়েছে। দিনভর বিদ্যুতবঞ্চিত এলাকার সকল বিদ্যুত গ্রাহক সাধারণ।