ব্যবসায়ী ও সাংবাদিকদের দোষে চালের দাম বাড়ছে

ভারত চাল রফতনি বন্ধ করেনি : এক কোটি টনেরও বেশি চাল আছে ভারতের

স্টাফ রিপোর্টার: দেশে চালের কোনো সঙ্কট নেই দাবি করে সরকারের দুজন মন্ত্রী দাম বাড়ার জন্য অসাধু ব্যবসায়ীদের তৎপরতাকে দায়ী করেছেন। একই সঙ্গে তারা চাল নিয়ে সংবাদ পরিবেশন করার ক্ষেত্রে সাংবাদিকদের দায়িত্বশীলতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। গতকাল বৃহস্পতিবার সচিবালয়ে নিজ নিজ কার্যালয়ে বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ ও খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম সাংবাদিকদের কাছে এসব মন্তব্য করেছেন। গতকাল সচিবালয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ বলেছেন, ভারত চাল রফতানি বন্ধ করেনি। রফতানি করার জন্য ১ কোটি টনেরও বেশি চাল আছে ভারতের। অথচ একদল অসাধু ব্যবসায়ী টাকা খরচ করে চালের বাজার অস্থিতিশীল করতে ভুয়া চিঠি বানিয়ে বলেছে যে ভারত বাংলাদেশের কাছে চাল রফতানি করবে না। স্বাক্ষরবিহীন এই ভুয়া চিঠির ওপর ভিত্তি করে কিছু পত্রিকা ও টিভি চ্যানেল প্রতিবেদনও তৈরি করেছে।

প্রতিবেদন তৈরির আগে তা সাংবাদিকদের আরও পরীক্ষা করা উচিত বলে উল্লেখ করেন বাণিজ্যমন্ত্রী। তিনি বলেন, বাংলাদেশের ১৬ কোটি মানুষের প্রতি তাদের (সাংবাদিক) আরও দায়িত্বশীল হওয়া উচিত। হাওয়ার ওপর প্রতিবেদন করা ঠিক নয়। চালের অবৈধ মজুতদারদের বিরুদ্ধে অভিযান চালাতে জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারদের নির্দেশ দেয়া হয়েছে বলেও জানান বাণিজ্যমন্ত্রী। তিনি বলেন, সরকারের ভাবমূর্তি নষ্ট করতে যারা এসব কাজ করছে, তাদের কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না। সত্যি সত্যিই ভারত চাল রফতানি বন্ধ করলে সরকার তা কীভাবে জানবে এমন প্রশ্নের জবাবে বাণিজ্যমন্ত্রী বলেন, ‘আগে জানবে ভারতে আমাদের হাইকমিশন অফিস এবং বাংলাদেশে ভারতের হাইকমিশন অফিস। দুই অফিসেই খোঁজ নিয়েছি এবং তারা বলেছে খবরটি মিথ্যে।’

খাদ্যমন্ত্রীর ক্ষোভ: মন্ত্রণালয়ের সম্মেলনকক্ষে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম দাবি করেন, দেশে ১ কোটি টন চাল আছে এবং দেশে চালের কোনো সংকট নেই। দামও এত বাড়ার কথা নয়। তিনি চালের দাম বাড়ার জন্য ব্যবসায়ী ও গণমাধ্যমকে দায়ী করে বলেন, ‘চাল নিয়ে রাজনীতি চলছে, চাল নিয়ে সমস্ত দেশকে একটা বিভ্রাটের মধ্যে ফেলার চেষ্টা করা হচ্ছে। উদ্দেশ্যমূলকভাবে চাল নিয়ে চালবাজি হচ্ছে, চাল নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে আতঙ্ক ও ভীতি সৃষ্টির চেষ্টা করা হচ্ছে।’ চাল আমদানির জন্য মিয়ানমার সফরে যাওয়ার বিষয় উল্লেখ করে খাদ্যমন্ত্রী বলেন, এটা নিয়ে অনেক কথা হয়েছে। তিনি একটি ইংরেজি দৈনিকের নাম উল্লেখ করে বলেন, ‘ওই পত্রিকা লিখেছে, মিয়ানমারের চাল আমরা আনতে পারবো না। কিন্তু সত্য হলো, আগামী রোববার চাল রফতানির ব্যাপারে চুক্তি করতে মিয়ানমারের একটি প্রতিনিধিদল বাংলাদেশে আসছে। তাদের সঙ্গে দাম নিয়ে আলোচনার পর ২ লাখ টন চালের জন্য চুক্তি হবে। মিয়ানমারের চাল গুণগত মানে ভালো, দাম কম এবং তাড়াতাড়ি দেশে আনা যাবে।’

খাদ্যমন্ত্রী সাংবাদিকদের উদ্দেশে বলেন, ‘আপনাদের কাছে হাত জোর করে অনুরোধ করছি, আপনারা এমন কোনো উত্তেজক সংবাদ প্রকাশ করবেন না, যাতে দেশে চালের দাম বাড়ে।’  খাদ্যমন্ত্রী বলেন, ‘আমি মজুতদার, আড়তদার, মিলমালিকসহ সবার প্রতি আহ্বান জানাব, এখনই ভালো হয়ে যান, সময় আছে। আপনারা যেভাবে (চালের) দাম বাড়াচ্ছেন, যেভাবে সিন্ডিকেট ও চালবাজি শুরু করেছেন, রাজনীতি শুরু করেছেন, একটা বিভ্রাট সৃষ্টির চেষ্টা করছেন, তা কোনো অবস্থাতেই বরদাশত করা হবে না। এখনই শেষ সুযোগ আপনাদের, ভালো হয়ে যান।’ ১৯ সেপ্টেম্বর মিলমালিক ও চাল ব্যবসায়ী সমিতির নেতা এবং চাল আমদানিকারকদের ডেকেছেন জানিয়ে খাদ্যমন্ত্রী বলেন, এই সভায় বাণিজ্যমন্ত্রী ও কৃষিমন্ত্রী উপস্থিত থাকবেন। চালের বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকার পদক্ষেপ নিয়েছে জানিয়ে খাদ্যমন্ত্রী বলেন, ‘আবদুর রশিদের মিলে হানা দিয়ে ৫০ হাজার টন চাল জব্দ এবং ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৎপরতা আছে। আমি আপনাদেরও (সাংবাদিক) সাহায্য চাই।’ খাদ্যমন্ত্রী গণমাধ্যমকর্মীদের উদ্দেশে বলেন, ‘সাংবাদিকতা একটি মহান পেশা। আমি ছোটবেলায় ভেবেছিলাম সাংবাদিক বা আইনজীবী হব। সাংবাদিকেরা যদি দেশপ্রেম নিয়ে কাজ করেন, তাহলে তা দেশের জন্য ভালো।’ খাদ্যমন্ত্রী বলেন, আগামী রোববার থেকে খোলাবাজারে (ওএমএস) ১৫ টাকা কেজি দরে চাল এবং ১৭ টাকা করে আটা বিক্রি শুরু করতে যাচ্ছে সরকার। প্রাথমিকভাবে বিভাগীয় শহরগুলোতে তা চালু হবে। আর ২০ সেপ্টেম্বর থেকে চালু হবে ৫০ লাখ মানুষের কাছে ১০ টাকা কেজি দরে চাল বিক্রির কার্যক্রম, চলবে তিন মাস। এবার ১ কোটি ৯১ লাখ টন বোরো উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ছিল জানিয়ে খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম বলেন, ‘বন্যা ও রোগবালাইয়ে দেশে ২০ লাখ টন ফসল নষ্ট হয়েছে। ফসলহানির পরও ১ কোটি ৯২ লাখ টন ধান আমাদের ঘরে এসেছে। চার মাসে মানুষ ১ কোটি টন চাল খেয়েছে আর বাকি চাল এখনো বাজারে আছে। হয় মিলমালিক, আড়তদার, না হয় ছোট-বড় ব্যবসায়ী—কারও না কারও বাড়িতে এসব চাল আছে। এরপরও চালের দাম বেড়ে যাচ্ছে।’

শুল্ক কমানোর পর বেসরকারিভাবে ভারত থেকে ৬ লাখ টন চাল এসেছে জানিয়ে মন্ত্রী বলেন, চাল নিয়ে চালবাজি ও রাজনীতি হচ্ছে, বিভ্রান্তি সৃষ্টি করা হচ্ছে, সংকট সৃষ্টি এবং সরকারকে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলার চেষ্টা করা হচ্ছে। বেসরকারিভাবে ১৭ লাখ টন চাল আমদানির জন্য এলসি খোলা হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, সরকার ৩৪ টাকা দরে সাড়ে ১২ লাখ টন বোরো চাল সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করলেও মাত্র আড়াই লাখ টন সংগ্রহ হওয়ায় চাল আমদানি করতে হচ্ছে। ভিয়েতনাম থেকে আড়াই লাখ টন চাল আমদানি হচ্ছে জানিয়ে মন্ত্রী কামরুল ইসলাম বলেন, ইতিমধ্যে ভিয়েতনামের ১ লাখ ৫৪ হাজার টন চাল গুদামে ঢুকেছে। বাকি চাল খালাসের অপেক্ষায় সমুদ্রে আছে।